সিন্ডিকেট করে শিক্ষকদের টাকা হাতিয়ে নেন তিনি

রুম্মান তূর্য |
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের সিলেট অঞ্চলের উপপরিচালক পদে ১৩ বছরের বেশি সময় ধরে কর্মরত আছেন জাহাঙ্গীর কবির। শিক্ষকদের এমপিওভুক্তিতে অনিয়ম ও দুর্নীতি করে ঘুষ বাবদ লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। সিন্ডিকেট করে এমপিওভুক্তি, উচ্চতর গ্রেড, নিয়োগ সংক্রান্ত কাজে আদায় করেছেন ঘুষ। 
 
উপপরিচালক (ডিডি) জাহাঙ্গীর কবির শিক্ষকের এমপিওভুক্তির আবেদনে আপত্তি তোলেন। পরে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ওই শিক্ষক বা কর্মচারীকে দেখানো হয় ভয়ভীতি। ঘুষ বাবদ নেয়া হয় মোটা অংকের টাকা। পরে আগের আপত্তি জানানো রেকর্ডের ভিত্তিতেই ওই শিক্ষক বা কর্মচারীকে এমপিওভুক্তি করেন তিনি। বিধি মোতাবেক এমপিও আবেদন করার পর তাতেও আপত্তি দেন এ কর্মকর্তা। দীর্ঘদিন ঝুলিয়ে রেখে ঘুষের টাকা হাসিল করা হয়। পরে ওই শিক্ষককেই এমপিওভুক্ত করা হয়। দীর্ঘ একযুগ সিলেট অঞ্চলের বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষক-কর্মচারীদের এভাবেই জিম্মি করে রেখেছেন ডিডি জাহাঙ্গীর।
 
সম্প্রতি পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে ডিডি জাহাঙ্গীরের এসব অপকর্মের কথা উঠে এসেছে। গত ১৬ মে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন ডিআইএ কর্তারা। প্রতিবেদনটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগে পাঠানো হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র দৈনিক আমাদের বার্তাকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
 
জানা গেছে, ডিডি জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে শিক্ষকরা হয়রানির অভিযোগ তুললে তা তদন্তের দায়িত্ব পড়ে ডিআইএ কর্মকর্তাদের ওপর। অভিযোগ তদন্তের দায়িত্বে ছিলেন ডিআইএর যুগ্ম পরিচালক বিপুল চন্দ্র সরকার, সহকারী শিক্ষা পরিদর্শক মনিরুজ্জামান ও অডিট অফিসার মো. মতিয়ার রহমান। 
 
এসব অভিযোগের বিষয়ে মন্তব্য জানতে গত কয়েকদিন ধরে দৈনিক আমাদের বার্তার পক্ষ থেকে দফায় দফায় যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় ডিডি জাহাঙ্গীরের সঙ্গে। কিন্তু তার অফিসিয়াল মুঠোফোন নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। তাই তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। 
 
এমপিও দুর্নীতি হয় যেভাবে 
 
দৈনিক আমাদের বার্তার হাতে থাকা ওই তদন্ত প্রতিবেদনে ডিডি জাহাঙ্গীরের অপকর্মের খতিয়ান উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, নিয়োগ রেকর্ড যথাযথ না থাকা সত্ত্বেও প্রথমে এমপিওভুক্তির আবেদনে আপত্তি দেয়া হয় এবং একই রেকর্ডের ভিত্তিতে পরবর্তীতে এমপিও  করা হয়েছে। যা দুর্নীতির উদ্দেশ্যে হয়রানি ও অনিয়ম করে এমপিওভুক্তির উদাহরণ বলে মন্তব্য করেছেন ডিআইএ কর্মকর্তারা। তিনি নতুন এমপিওভুক্তির ক্ষেত্রে ডিজি প্রতিনিধির স্বাক্ষর যাচাই করা হবে বলে অনলাইন নথিতে আপত্তি দিলেও পরে অজ্ঞাত কারণে স্বাক্ষর যাচাই না করেই এমপিওভুক্ত করা হয়েছে। এতে অনিয়ম করে এমপিওভুক্তির প্রমাণ পাওয়া যায়। কৃষি শিক্ষকের কাম্য যোগ্যতা বিএজিএড ডিগ্রি থাকা সত্ত্বেও ই-নথিতে আপত্তি দেয়া হয় এবং শিক্ষককে হয়রানির মাধ্যমে দীর্ঘদিন পর এমপিওভুক্ত করা হয়েছে। যা দুর্নীতি বলছেন কর্মকর্তারা।
 
প্যাটার্নভুক্ত পদ শূন্য থাকার পরেও এক গণিত শিক্ষকের এমপিওর আবেদনে আপত্তি দিয়েছিলেন ডিডি জাহাঙ্গীর। পরে দীর্ঘদিন হয়রানি করে তাকে এমপিওভুক্ত করেন। বিএড সনদ না থাকায় প্রধান শিক্ষকের এমপিওর আবেদনে আপত্তি জানান ডিডি। কিন্তু পরে মানবিক কারণে দেখিয়ে বিএড সনদ ছাড়াই তাকে এমপিওভুক্ত করে। এসব ঘটনা অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে এমপিওভুক্তির দৃষ্টান্ত বলে প্রতিবেদনে মন্তব্য করেছেন ডিআইএ কর্মকর্তারা। এছাড়া সিনিয়র প্রভাষককে সহকারী অধ্যাপক স্কেল না দিয়ে জুনিয়র প্রভাষককে এ স্কেল পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন এ ডিডি। যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা থাকলেও একাধিক প্রধান শিক্ষকের এমপিওভুক্তির আবেদন রিজেক্ট করেছেন এ ডিডি। তদন্ত কর্মকর্তাদের ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, তারা এসব কারণে সিলেট আঞ্চলিক শিক্ষা অফিস ও সিলেট জেলা শিক্ষা অফিসের বিভিন্নজনের মাধ্যমে এসব কাজে ঘুষ দিয়েছেন। ডিডি জাহাঙ্গীরের আর্থিক দুর্নীতি বা ঘুষ নেয়ার প্রমাণ মিলেছে বলে জানা গেছে। এসব কারণে ডিডি জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছে ডিআইএ। 
 
এমপিওভুক্তিতে সিন্ডিকেট 
 
এমপিওভুক্তির সিন্ডিকেট নিয়ে তদন্ত প্রতিবেদনে ডিআইএ কর্মকর্তারা বলছেন, মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও জেলা শিক্ষা কর্মবর্তা এমপিও আবেদন ফরোয়ার্ড করলে ডিডি যখন ফাইল রিজেক্ট করেন তখন আবার এমপিও আবেদন করলে মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ফাইল আর ফরোয়ার্ড করেন না। তাহলে প্রশ্ন আসে প্রথমে মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা কিভাবে ফাইল ফরোয়ার্ড করলেন। সিনিয়র অধ্যাপকের স্কেল পাওয়ার আবেদন বিধি বহির্ভুতভাবে রিজেক্ট করে জুনিয়র শিক্ষককে সহকারী অধ্যাপক স্কেল দেয়া হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তাদের মতে, এসব প্রমাণ করে সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে এমপিওভুক্তি কার্যক্রম চলছে।
 
সরকারি নির্দেশনাও মানেন না ডিডি জাহাঙ্গীর। তদন্ত কর্মকর্তারা প্রতিবেদনে জানিয়েছেন, সরকারি নির্দেশনা আছে এমপিও অনুমোদিত আবেদন প্রিন্ট নিয়ে নিজের স্বাক্ষরসহ তা সংরক্ষণ করতে হবে আঞ্চলিক পরিচালক ও উপপরিচালকদের। কিন্তু জাহাঙ্গীরের কাছে ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই থেকে ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ পর্যন্ত কোনো রেকর্ড নেই। তা থেকে ওই সময়ে এমপিও কার্যক্রমে অনিয়ম হয়েছে বলে ধরণা করছেন কর্মকর্তারা। 
 
আর্থিক অনিয়ম 
 
অভিযুক্তের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আর্থিক অনিয়মের প্রমাণও পেয়েছে ডিআইএ। অনেক কাজেরই অনুমোদন নেয়া হয়নি। মালামাল কিনতে চাহিদাপত্র চাওয়া হয়নি। ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ২০২০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত অনুষঙ্গিক ও পোশাকখাতে ব্যয় করা ৬ লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা নেয়ার সুপারিশ করেছে ডিআইএ।

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ইএফটিতে বেতন দিতে এমপিও আবেদনের সময় এগোলো - dainik shiksha ইএফটিতে বেতন দিতে এমপিও আবেদনের সময় এগোলো জবিতে ভর্তির প্রাথমিক আবেদন শুরু ১ ডিসেম্বর - dainik shiksha জবিতে ভর্তির প্রাথমিক আবেদন শুরু ১ ডিসেম্বর সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি: দশ দিনে আবেদন প্রায় ৬ লাখ - dainik shiksha সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি: দশ দিনে আবেদন প্রায় ৬ লাখ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৮ সদস্যের কমিটি ঘোষণা - dainik shiksha বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৮ সদস্যের কমিটি ঘোষণা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে ধারণা বাড়াতেই পাঠ্যক্রমে তথ্য অধিকার আইন বিষয় যুক্ত: এনসিটিবি চেয়ারম্যান - dainik shiksha ধারণা বাড়াতেই পাঠ্যক্রমে তথ্য অধিকার আইন বিষয় যুক্ত: এনসিটিবি চেয়ারম্যান কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক শিক্ষক নিবন্ধন ভাইভা: ২১তম দিনে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি - dainik shiksha শিক্ষক নিবন্ধন ভাইভা: ২১তম দিনে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি সরকারি কলেজ প্রদর্শকদের পদোন্নতির খসড়া প্রকাশ - dainik shiksha সরকারি কলেজ প্রদর্শকদের পদোন্নতির খসড়া প্রকাশ সুইডেনে স্কলারশিপে স্নাতকোত্তরের সুযোগ - dainik shiksha সুইডেনে স্কলারশিপে স্নাতকোত্তরের সুযোগ পঞ্চমে ফিরছে বৃত্তি পরীক্ষা, বার্ষিকে ৪ স্তরে মূল্যায়ন - dainik shiksha পঞ্চমে ফিরছে বৃত্তি পরীক্ষা, বার্ষিকে ৪ স্তরে মূল্যায়ন দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0032410621643066