শিক্ষা বিষয়ক দেশের একমাত্র দৈনিক পত্রিকা দৈনিক শিক্ষাডটকম-এ প্রকাশিত সংবাদে দেখলাম রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির বার্ষিক সভায় উপস্থিত মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীদের সামিতির পক্ষ থেকে দাবি জানানো হয়, ‘বই বিক্রিতে মাঠ পর্যায়ে যাতে তাদের হয়রানি করা না হয়।’ ২৩ জানুয়ারি প্রকাশক ও বই বিক্রেতাদের এই দাবিতে হয়রানি বন্ধের আশ্বাস দিয়েছেন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী। তবে, সভায় উপস্থিত কৃষিমন্ত্রী ড. মো: আবদুর রাজ্জাক এমপি যথার্থই বলেন, “চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে প্রকাশনা শিল্পকে কীভাবে টিকিয়ে রাখা যাবে, সে উপায় প্রকাশকদেরই খুঁজে বের করতে হবে।’
পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতাদের রাতারাতি বড়লোক হওযার সুযোগ নেই। এটি একটি অত্যন্ত মহৎ, সৃজনশীল ও মেধা বিকাশের পেশা। মানবসভ্যতার বিকাশ ও উন্নয়নে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে পুস্তক শিল্পের আকার বড় হয়েছে, প্রিন্টিং শিল্পও আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে এ শিল্পের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে।” চমৎকার কথা বলেছেন মাননীয় মন্ত্রী। বইয়ের আকর্ষণ সবসময়ই থাকবে, তারপরও উন্নত আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কীভাবে মুদ্রিত বইয়ের আকর্ষণ বৃদ্ধি করা যায সেদিকে প্রকাশকদের দৃষ্টি দিতে হবে। প্রযুক্তির কল্যাণে কাগজে মুদ্রিত বই পড়ার প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে গেছে তবে কম্পিউটার বা মোবাইল স্ক্রিনে বই পড়ার আনন্দ এক নয়। এই পার্থক্যটুকু নিয়েই প্রকাশকদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে।
২৩ জানুয়ারিরর অনুষ্ঠানে পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সভাপতি মো. আরিফ হোসেন ছোটন বলেন, বিদ্যমান আইনে সৃজনশীল বই বিক্রিতে আইনগত কোনও বাঁধা নেই। সৃজনশীল বই নোট-গাইড় নয়। তাই আইনের দোহাই দিয়ে মাঠ পর্যায়ে হয়রানি বন্ধ করতে হবে।’
প্রকাশকদের দাবির প্রেক্ষিতে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, ’ যাতে হয়রানির শিকার হতে না হয় সে বিষয়টি আমরা দেখবো। সন্তানের শিক্ষায় বিনিয়োগই শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ। সন্তানকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে। এজন্য পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি পাঠ্যক্রম বহির্ভূত সৃজনশীল বই পাঠে শিশুদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।’
দেশের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া, বুদ্ধিজীবী সমাজ সবাই নোট-গাইড নিয়ে শঙ্কিত। এ নিয়ে কথাবার্তা, আলোচনা-সমালোচনা ও লেখালেখি হচেছ দেদার। কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতা বিশেষ করে মূল্যায়ন পদ্ধতির সমস্যার কারণে নোট ও গাইড বইয়ের বাজার বিস্তৃতি লাভ করেছে। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে পরীক্ষা চালু করায় বিষয়টি আরও গতিলাভ করে। আমরা তো বহু বছর যাবতই আমাদের ভবিষ্যত বংশধরদের শিক্ষার্থীর পরিবর্তে পরিক্ষার্থী বানিয়ে রেখেছি, জ্ঞান দেওয়া ও আহরনের পরিবর্তে মার্কিং এর ওপর জোর দিয়ে এসেছি।
বিভিন্ন ভর্তি পরীক্ষায়ও মার্কস প্রাপ্তিই গুরুত্ব পাচেছ তাহলে শিক্ষার্থী তথা অভিভাবকগন নম্বরের পেছনে দৌড়াবে না কেন? নোট গাইড যারা তৈরি করেন, বিক্রি করেন তারা তো সেই কাজটিই করছেন। তাহলে তাদের দোষ কোথায়? সৃজনশীল নামে মূলত নোট-গাইড বই বিক্রি করা হচেছ। এখন নোট-গাইড বিষয়টি কী? বিদ্যালয়, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং বৃহত্তর অর্থে পুরো দেশ চাচেছ হু হু করে পাসের হার বেড়ে যাক, জিপিএ-৫ পাওয়ার হার বেড়ে যাক যাতে এর সাথে জড়িত সবারই সুনাম হয়। শিক্ষার্থীরা কি শিখতে পারল কিংবা না পারলো সেটি নিয়ে খুব একটা কেউ ভাবছিনা। । তাদের উচচ শিক্ষায় ভর্তি হতে হবে সেখানে তাদের নম্বর দেখা হয়, জিপিএ- কত আছে সেটি দেখা হয়। তাহলে অন্য কিছু কেন? জিপিএ-৫ যাতে তারা পায় সেই চেষ্টাই তো সবাই করবে। এটিইতো স্বাভাবিক। সেই চেষ্টার সাথে শামিল হয়েছে নোট-গাইড প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি। তারা দাবি করছেন তাদের বইগুলো সৃজনশীল, নোট-গাইড নয়।তারা তো সে দাবি করতেই পারেন।
বাংলাদেশে দুই ধরনের প্রকাশক রয়েছেন। দুই দলই নিজেদের সৃজনশীল প্রকাশক বলে দাবি করেন। পার্থক্য হচেছ একদল শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠবই ও পাঠ্যবইয়ের সহায়ক বই ছেপে থাকেন। আর একদল প্রকাশক পাঠ্যপুস্তক ব্যতীত বিভিন্ন লেখকের বই ছেপে থাকেন। দ্বিতীয় ধরনের প্রকাশকদের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকটি ছাড়া অধিকাংশই নামে সৃজনশীল প্রকাশক। তারাও এক ধরনের ব্যবসায়ী।
তারা বিভিন্ন লেখকদের কাছ থেকে মানহীন বই নিয়ে অর্থের বিনিময়ে ছেপে থাকেন। বড় বড় ব্যবসায়ী, অসৎ কর্মকর্তাদের বই, বিদেশে অবস্থানরতদের বই প্রচুর অর্থের বিনিময়ে ছেপে থাকেন। ফলে, বই বিতরণ বা মার্কেটিং-এর কোন চিন্তা তাদের মধ্যে থাকেনা। মানসম্পন্ন বই যারা লেখেন তাদের বইয়ের প্রতি তারা খুব একটা আগ্রহ দেখা যায় না।কারন তাদের বই ছাপলে পাঠকদের কাছে পৌঁছাতে হবে। কষ্ট করতে হবে, অর্থ খরচ করতে হবে। পাঠকদের কাছে পৌছানোর একমাত্র মাধ্যম তারা মনে করেন ’ অমর একুশে বইমেলা’।
এটি ছাড়া তাদের আর কোন চেষ্টা নেই, মেকানিজম নেই।তারা মানহীন বই প্রকাশ করে একবারে যে অর্থ হাতিয়ে নিতে পারেন, মানসম্পন্ন বই পাঠকের হাতে পৌছে দিয়ে অল্প অল্প করে অর্থ লাভ তাদের কাছে আকর্ষণীয় বা উপযোগী মনে হয়না। যে কারণে কাঙ্খিতহারে পাঠকের সংখ্যা বাড়েনি, ভাল মানের বই প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছানো কাজটি হচেছনা। একবার চুন খেয়ে মুখ পুড়লে সে তো আর দই, দুধ কিংবা মিষ্টি আর সহজে খেতে চাবেনা। আমাদের পাঠকদের রুচি আমরা নষ্ট করে ফেলেছি এই ধরনের প্রকাশকদের কারণে। নতুন ও উদীয়মান লেখক সৃষ্টিতেও তারা কোন ভূমিকা রাখেন না। দেশে দু’চারজন প্রতিষ্ঠিত লেখকদের পান্ডুলিপি সংগ্রহের জন্য তারা বহু অর্থ ব্যয় করেন, বহু কৌশল অবলম্বন করেন। আবার যারা মানসম্পন্ন বই লেখেন তাদের দিকে তারা ফিরেও তাকান না। ভালো ও নতুন লেখা, প্রয়োজনীয় লেখা পাঠকদের কাছে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্বও তারা পালন করেন না।
বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সহসভাপতি শ্যামল পাল জানান, স্বাভাবিক অবস্থায় এই সময়ের মধ্যে বই বিক্রি হতো প্রায় ৭ হাজার ২০০ কোটি টাকার। সেখানে করোনার নয় মাসে মাত্র ৭২০ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে। সে হিসেবে নয় মাসে ৬ হাজার ৪৮০ কোটি টাকার বই বিক্রি কমেছে। প্রকাশনা সংস্থা টিকিয়ে রাখতে ৮০ শতাংশ জনবলকে বিনা বেতনে ছুটি দেয়া হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে জেলায় জেলায় বই বিক্রিতে প্রশাসন ও আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী বাঁধা দেয় তাহলে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এখানে একটি অমিমাংসিত বিষয় রয়ে গেছে।
সেটি হচেছ আমরা সৃজনশীল প্রকাশনা কোনটিকে বলবো? শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি যেসব বই তাদের পাস করতে, গ্রেড পেতে সহায়তা করে সেগুলোকে নাকি পাঠ্যপুস্তক বহির্ভূত যেসব পুস্তক বিভিন্ন লেখকগন লিখেন আর প্রকাশকগন প্রকাশ করেন?
সাহায্যকারী বই কি শিক্ষার্থীরা পড়বে না? আমরা কি শুধু সাদাভাত খাই? ভাতের সাথে বিভিন্ন ধরনের তরকারি, সবজি খেয়ে থাকি খাবারকে উপাদেয় ও সহজপাচ্য করার জন্য। একইভাবে, শুধুমাত্র ক্লাসের বই পড়ে শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের পরিধি বাড়ানো যায়না। বিভিন্ন ধরনের আইডিয়া নেওয়া, তুলনা করা, যুক্তিতর্ক তুলে ধরার জন্য মূল বইযের সাথে কিছু সাহায্যকারী বই শিক্ষার্থীদের পড়া উচিত। কিন্তু আমাদের পুস্তক প্রকাশনীগুলো কি সেই ধরনের কাজ করছে? তারা শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করে। শিক্ষার্থীরা যেসব উত্তর লিখবে সেগুলো হুবহু নোট-গাইড বইয়ে পাওয়া যায় যা তাদের সৃজনশীলতাকে প্রস্ফুটিত হতে দেয়না, ধীরে ধীরে তাদের সৃজনশীল প্রতিভাকে চেপে রেখে রেখে ধ্বংস করে দেয়।
তাই, নোট-গাইড বই বন্ধ করে দেওয়ার জন্য শিক্ষাবিদগন সরকারকে চাপ দিয়ে যাচেছন, অনুরোধ করছেন । পুরাতন ঢাকাকেন্দ্রিক যে প্রকাশনাশিল্প গড়ে উঠেছে তার সাথে জড়িত কয়েক লক্ষ মানুষ। তারা এক ধরনের দক্ষতা অর্জন করেছে। এটিকে শিল্পের রূপ দেয়া হয়নি, স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। অথচ এটি একটি বাস্তবতা, এটি এক ধরনের বাণিজ্যিক শিক্ষা। এটিকে কী আমরা টিকিয়ে রাখবো? নাকি বাদ দেব?
শহরাঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সূত্র থেকে , অভিজ্ঞ শিক্ষকের কাছ থেকে, কোচিং সেন্টার থেকে তাদের পঠিত বিষয় সম্পর্কে জানতে পারে, শিখতে পারে যা গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের এবং শিক্ষকদের নেই। তাদের সঙ্গী হচেছ এসব নোট বা গাইড বই। এটি আমরা অস্বীকার করতে পারিনা। কিন্তু আমরা তো এটাও চাবনা যে, গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা এসব নি¤œমানের বই পড়ে সারাজীবন পেছনেই পড়ে থাকবে। তাহলে কি করা?
সমাজের সব স্তরে, সব সেক্টরে চলছে টাকার খেলা সেখানে পুস্তক ব্যবসায়ীরা, শিক্ষার সাথে জড়িত ব্যবসায়ীরা কেন ব্যবসা করবেন না? দৈনিক শিক্ষায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, শিক্ষক সমিতিগুলোর নেতারা এই প্রকাশকদের কাছ থেকে নোট-গাইড বইয়ের জন্য কোটি কোটি টাকা চাঁদা নেন। প্রকাশকরা প্রকাশ্যেই বলেছেন, টাকার জন্য সমিতির নেতারা তাদের নিয়োজিত জেলা ও উপজেলা প্রতিনিধিদের কাছে ধর্ণা দেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়েও ঘুষ দিয়ে আসেন।
প্রশ্ন হলো কেন এই চাঁদা নেন? মানহীন বই চালিয়ে দিয়ে শিক্ষার্থীদের সর্বনাশ করার জন্য আর যেনতেন প্রকারে গড়ে ওঠা প্রকাশকদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য। প্রতিবছর জানুয়ারি মাসে নতুন নতুন সমিতি ও কমিটি গঠিত হয় নিজেদের মতো করে। কেন্দ্রীয় বিভাগ-জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কমিটি হয়।
সেই কমিটির ছবি ও সংবাদ পত্রিকা ও টিভিতে ফলাও করে প্রচার হয়। সব স্তরে, সব পেশায় চলছে এই টাকার খেলা, কোথাও কোথাও প্রকাশে কোথাও অপ্রকাশ্যে। সবক্ষেত্রে চললেও শিক্ষাক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম থাকা দরকার। প্রকাশকরা যে দক্ষতা অর্জন করেছেন, এ শিল্পের সাথে যারা জড়িত তাদের টিকে থাকার জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কিছু নির্দেশনা থাকা প্রয়োজন। লেখকদের কাছ থেকে অর্থের বিনিময়ে মানহীন বই প্রকাশ করে বস্তাবন্দী করে রাখা কিংবা জোরপূর্বক কিছু বিক্রির চেষ্টা করা আর নোট-গাইড দিয়ে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা নষ্ট করা দুটোই সমান অপরাধ এবং অনৈতিক কাজ।
কিন্তু এগুলো নিয়ন্ত্রণের তো কোন নিয়ম-কানুন সে রকম নেই। এখানে চলছে এক ধরনের দেনা-পাওনা, ধস্তাধস্তি, জোরাজুরি, চোর-পুলিশ খেলা। এ বিষয় দুটো একশত শতাংশ নিয়ন্ত্রণও করা যাবেনা। এখানে সৎভাবে প্রকৃত শিক্ষিত একদল মানুষ দিয়ে একটি কমিটি গঠন করতে হবে। সেই কমিটি একটি নির্দেশনা দেবে যার আলোকে বাণিজ্যিক প্রকাশনাগুলো শিক্ষার্থীদের জন্য মানসম্পন্ন সাহায্যকারী বই প্রকাশ ও বিতরণ করবেন। মানহীন বই ঘুষ দিয়ে বিক্রি করার প্রথা বন্ধ করতে হবে।
মাছুম বিল্লাহ
(শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক)