সেন্ট মার্টিনে রাজনীতির ঢেউ

বোরহানুল হক সম্রাট |

যে দ্বীপের তিনদিকেই ভিতশিলা, যা জোয়ারের সময় তলিয়ে যায় আর ভাটায় জেগে ওঠে, যে ক্ষুদ্র দ্বীপটি সাগরের পানিতে কখনো বিচ্ছিন্ন হয়ে ছেড়াদ্বীপে পরিণত হয়, যে দ্বীপের প্রস্থ ২শ থেকে সর্বোচ্চ ৭শ মিটার, সেই মাত্র ৮ কিলোমিটার লম্বা দ্বীপের কারণে আজ ১ লাখ ৪৮ হাজার ৪৬০ বর্গ কিলোমিটারের বাংলাদেশের, ১৮ কোটি মানুষের ঘুম হারাম। পায়ের নিচের মাটির গঠন অথবা টপোগ্রাফির কারণে প্রায় আড়াই একর আয়তনের সংকটাপন্ন দ্বীপটিকে বাঁচাতে মাঝে-মধ্যে নিজের দেশের পর্যটকের যাতায়াত-ই নিষিদ্ধ করে পরিবেশ অধিদপ্তর, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ঠেকাতে জারি হয় নানা বিধি-নিষেধ, সেই ক্ষুদ্রতম ভূ-খন্ডের সামরিকায়ন নিয়ে রাজনীতির মহলে আজ নানা আলোচনা।

 

বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্বাংশে অবস্থিত সেই প্রায় ভেসে থাকা প্রবাল দ্বীপে যাবার সুযোগ হয়েছিল একাধিকবার। এখন কেমন আছে সেই প্রবাল দ্বীপ।

এই ক্ষুদ্রতম দ্বীপের হাজার হাজার নারকেল আর সুপারি গাছের সমারোহে উত্তাল সাগরের মাঝে ভিন্ন নামের নারিকেল জিনজিরা এখনো প্রকৃতির এক অসামান্য সৃষ্টি। নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের অধিকারী এই প্রবাল দ্বীপের আশপাশে ৬৬ প্রজাতির প্রবাল রয়েছে। সামুদ্রিক মাছের পাশাপাশি সরকারি হিসাবেই রয়েছে ৩০০ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ৫ প্রজাতির উভচর টিকটিকি ও গিরগিটি, ৫ প্রজাতির সামুদ্রিক কাছিম, ১৫ প্রজাতির সাপ, ২০ প্রজাতির পাখি এবং ২০ প্রজাতির শুন্যপায়ী প্রাণী। এ ছাড়া বহুসংখ্যক উদ্ভিদ প্রজাতি দ্বীপটিকে সমৃদ্ধ করেছে। এখানে রয়েছে ৪৮৩ ধরনের ফলজ ও বনজ উদ্ভিদ। সরকারের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের এক পরিসংখ্যানে দাবি করা হয়েছে, ভারত মহাসাগরের অন্যান্য দ্বীপের মধ্যে স্বল্প পরিসরে এত বৈচিত্র্য অন্য কোথাও দেখা যায় না। অথচ সকল প্রকার নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে দ্বীপে জমে বসেছে পযটক। একটি উদাহরণ যথেষ্ট হতে পারে। সেন্টমার্টিন টমটম মালিক সমিতির হিসেব বলছে, সমিতির নথিভুক্ত ১৪০ টি হলেও আদতে সেই বালুকালয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ৪ শতাধিক টমটম। আর এই টমটমের নীচে পিষ্ঠ হচ্ছে বৈচিত্রময় শামুক-ঝিমুক। বদলে যাওয়া প্রবাল দ্বীপের রিপোর্টে যে আক্ষেপটি উঠে এসেছিল তা হচ্ছে ইটবালির নতুন আস্তরণে ঢাকা পড়ছে আদি সেন্টমার্টিন বা নারিকেল জিনজিরা দ্বীপটি। কিন্তু ঢাকা পড়ছে না এই ভূমির মানবসন্তানদের অশিক্ষা, অস্বাস্থ্য আর ধর্মীয় গোঁড়ামি। 

শিক্ষা ও সচেতনতার অভাবে নিয়ন্ত্রণহীন জনসংখ্যা এই দ্বীপের গুরুতর সমস্যা। এক সময় অভিযোগ উঠেছিল, ধনী লোকেরা কাড়ি কাড়ি টাকা দিয়ে এই ক্ষুদ্র দ্বীপের সাগর পাড়গুলো কিনে নেয়ার চেষ্টা চালায়। 

তবে প্রাণ-প্রকৃতির বৈচিত্র্যে ভরপুর সেন্টমার্টিনের ভৌগলিক অবস্থান আশির দশকে রাজনীতির মাঠে যে আলোচনার জন্ম দিয়েছিল, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার উত্থান-পতনের যুগে তা আবার ফিরে এসেছে। এটি কক্সবাজার জেলার টেকনাফ থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার দক্ষিণে আর মিয়ানমার-এর উপকূল থেকে ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে নাফ নদীর মোহনায় অবস্থিত। 

 গত ২১ জুন ‘‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সেন্ট মার্টিন দ্বীপ বা দেশ কাউকে 'লিজ' দিলে ক্ষমতায় থাকার কোন অসুবিধা নেই। বুধবার গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি একথা বলেন।’’(বিবিসি বাংলা)। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে যুক্তরাষ্ট্রের নাম উচ্চারণ করেননি। তবুও মার্কিন দূতাবাস এই ইস্যুতে তাদের অবস্থান তুলে ধরেছে। ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র ব্রায়ান শিলার বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশ শক্তিশালী ও সহযোগিতামূলক অংশীদারত্ব বজায় রাখে। আমরা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে সম্মান করি। দেশটির কোনো ভূখণ্ডের ওপর আমরা কোনো দাবি করিনি।’ বিএনপি বলছে, সেন্টমার্টিন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য রাজনৈতিক কৌশল। 

বিএনপির এমন মন্তব্যরও জবাব দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেছেন, সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন,‘‘ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গ্যাসের কথা যেমন বলেছেন, তেমনি সেন্টমার্টিনেরও কথা বলেছেন। সেন্টমার্টিন অন্য একটা দেশ লিজ নিতে চায়। অথচ মির্জা ফখরুল আজকে বলেন, এটা কৌশল! শেখ হাসিনার ক্ষমতায় থাকার কৌশল।’’(সমকাল)। 

অবশ্য বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের দাবি ‘সেন্টমার্টিন দিয়ে ক্ষমতায় থাকতে পারলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগেই দিয়ে দিতেন’(যুগান্তর)। 

যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট আলী রীয়াজ এই সংবাদ সম্মেলনের পর ফেসবুকে একটি স্টাটাস দিয়েছেন। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘‘এই রকম একটি বিতর্কে দেশকে যুক্ত করার অভিপ্রায় থেকেই এখন সেন্ট মার্টিনস দ্বীপে মার্কিন ঘাঁটি নির্মানের কথা বলা হচ্ছে। এই বিষয়টি অনেক আগেই নিষ্পত্তি হয়ে গেছে যে, যুক্তরাষ্ট্র সেন্ট মার্টিন্স দ্বীপে ঘাঁটি বানাতে আগ্রহী নয়। অন্যান্য ভূ-রাজনীতির কথা বাদ দিয়েও এই কারণে ঘাঁটি প্রসঙ্গ অবান্তর কেননা টপোগ্রাফির কারণে ওই দ্বীপে কোনও ধরণের সামরিক স্থাপনা তৈরি করা যাবে না। এই প্রসঙ্গ মীমাংসিত। তার দাবি ‘ যেহেতু এখন বাংলাদেশের নাগরিকদের এক বড় অংশই তরুণ তাঁরা সম্ভবত এই ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত নন। ফলে এখন আবার ‘দেশপ্রেমের’ এবং ‘মার্কিন বিরোধিতার’ প্রমাণ হিসেবে এই কথাগুলোর অবতারণা করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য সাম্প্রতিককালে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার করার যে কথা বলা হচ্ছে তাঁকে মোকাবেলা করার সহজ পথ দেখানো।’’ 

তবে পৃথক একটি লেখায় অধ্যাপক রীয়াজ বলছেন, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে তুমুল প্রতিযোগিতার কারণে দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ে ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক গুরুত্বের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আকাঙ্খাটা ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনার বাইরে নয়।

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘‘সেন্টমার্টিন নিয়ে আসা বক্তব্যগুলো হুজুগে মন্তব্য। আমাদের আশপাশে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশ রয়েছে। ফলে সেন্টমার্টিনে তাদের ঘাঁটি করার প্রয়োজন নেই।’’

মুক্ত বিশ্বকোষ উইকিপিডিয়া বলছে, দ্বীপটির পূর্ব, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে সাগরের অনেক দূর পর্যন্ত অগণিত শিলাস্তূপ আছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সেন্ট মার্টিন্স দ্বীপের গড় উচ্চতা ৩.৬ মিটার। সেন্ট মার্টিন্সের পশ্চিম-উত্তর-পশ্চিম দিক জুড়ে রয়েছে প্রায় ১০-১৫ কিলোমিটার প্রবাল প্রাচীর। সেই প্রাচীরে এবার রাজনীতিও ঢুকে পড়েছে।

সেন্ট মার্টিন্স প্রকৃতির অকৃপণ দান হলেও সেখানে নানামাত্রিক আশঙ্কা অনেক। বৃষ্টির পানিই এই দ্বীপের সুপেয় পানির একমাত্র উৎস এবং এই পানি বালুর সামান্য নিচে অবস্থান করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরিকল্পিত পয়ঃনিষ্কাশনের ফলে যেকোনো সময় সুপেয় পানি সম্পূর্ণরূপে দুষিত হয়ে পুরো দ্বীপটিই বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়তে পারে। শুধু তাই নয়, দ্বীপে যে হারে মানুষ বসতি স্থাপন ও অপরিকল্পিতভাবে ঘরবাড়ি, হোটেল-রেস্তরা গড়ে উঠেছে তাও উদ্বেগজনক। সরকারিভাবে দ্বীপের বর্তমান আশঙ্কাজনক অবস্থা স্বীকার করে ইতিমধ্যে সেন্ট মার্টিন্স 'পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা’  হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। তবুও এই ভূখন্ডের শেষ মাথায় ছেঁড়াদিয়া দ্বীপে গিয়ে শেষ বিকেলে এখনও যদি আপনি একমুঠো বালি ধরেন সেই হাতে উঠবে নীল, লাল, শুভ্র সাদা চূর্ণবিচূর্ণ শামুক। সেই বালুকণা আজ সুর্যের তাপে নয় ভূ-রাজনীতির উত্তাপে চিকচিক করছে। 

শিক্ষার সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক শিক্ষার ইউটিউব চ্যানেলের সাথেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।

দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল  SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আবারো ভর্তি পরীক্ষা চালু হবে - dainik shiksha জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আবারো ভর্তি পরীক্ষা চালু হবে সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি: দুই দিনে আবেদন প্রায় দুই লাখ - dainik shiksha সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি: দুই দিনে আবেদন প্রায় দুই লাখ শিক্ষক নিয়োগেও নামকাওয়াস্তে মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা হয়: গণশিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha শিক্ষক নিয়োগেও নামকাওয়াস্তে মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা হয়: গণশিক্ষা উপদেষ্টা পাঠ্যপুস্তক থেকে শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার বিষয়বস্তু অপসারণের দাবি - dainik shiksha পাঠ্যপুস্তক থেকে শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার বিষয়বস্তু অপসারণের দাবি এসএসসির ফরম পূরণ শুরু ১ ডিসেম্বর - dainik shiksha এসএসসির ফরম পূরণ শুরু ১ ডিসেম্বর কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের গল্প - dainik shiksha পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের গল্প কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক পাঠ্যপুস্তকে একক অবদান তুলে ধরা থেকে সরে আসার আহ্বান হাসনাতের - dainik shiksha পাঠ্যপুস্তকে একক অবদান তুলে ধরা থেকে সরে আসার আহ্বান হাসনাতের ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ - dainik shiksha ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0023930072784424