বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাদর্শন মূলত বাঙালি জাতির মুক্তি ও বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে নেতৃত্ব দেয়ার দর্শন। তিনি শুধু স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নই দেখেননি, তিনি একটি উন্নত-সমৃদ্ধ ‘সোনার বাংলা’ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। যুগোপযোগী ও টেকসই শিক্ষা অর্জনের স্বপ্নকে বঙ্গবন্ধু আজীবন আত্মার সন্তান হিসেবে লালন করেছিলেন। তিনি বলতেন, ‘সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই। সোনার মানুষ আকাশ থেকে পড়বে না, মাটি থেকেও গজাবে না। এই বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের মধ্য থেকেই তাঁদের সৃষ্টি করতে হবে। আর তা সৃষ্টির জন্য চাই সুশিক্ষার প্রসার।’ তিনি দক্ষ, যোগ্য, অসাম্প্রদায়িক, দেশপ্রেমিক, আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মানবসম্পদ তৈরি করতে চেয়েছিলেন। তাই ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে ভাষার ওপর আঘাত এলে তিনি প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিলেন। ১৯৬২ খ্রিষ্ঠাব্দের শিক্ষা আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নকালে ‘রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি’ অংশে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা-ভাবনা অন্তর্ভুক্ত করে ঐ সংবিধান প্রণীত হয়। এতে গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল শিক্ষার্থীকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদান, সমাজের প্রয়োজনের সঙ্গে শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন।
১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনের আগে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছেন,‘সুষ্ঠু সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা খাতে পুঁজি বিনিয়োগের চেয়ে উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ আর কিছু হতে পারে না। মেধাবী ছাত্রদের উচ্চশিক্ষার জন্য দারিদ্র্য যাতে অভিশাপ হয়ে না দাঁড়ায় সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে।’ শিক্ষার ওপর বঙ্গবন্ধু যে অধিক গুরুত্বারোপ করেছেন তার প্রমাণ মেলে বাংলাদেশের প্রথম বাজেটে। সে বাজেটে প্রতিরক্ষা খাতের চেয়ে শিক্ষা খাতে ৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতি সত্ত্বেও শিক্ষাক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু সরকার অনেক যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। স্বাধীনতা অর্জনের পর জাতির পিতা যুগপৎভাবে শিক্ষার সকল স্তরে, সকল ক্ষেত্রে উন্নয়নের কার্যক্রম গ্রহণ করেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত এবং সীমিত সম্পদের দেশে শিক্ষা বিস্তারে বঙ্গবন্ধু যেসব পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তা ছিল অত্যন্ত দুঃসাহসিক। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে দেশের শতকরা ষাট ভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ধ্বংসপ্রাপ্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। বিধ্বস্ত সেই প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনর্গঠনের জন্য ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ২০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু কর্তৃক নির্দেশিত হয়ে একান্ন কোটি টাকা ব্যয় করার ঘোষণা দেন তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলী। তাছাড়া পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক প্রদান ও ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে চল্লিশ ভাগ কম দামে বই সরবরাহের ঘোষণাও দেয়া হয়েছিল। তিনি বিশৃঙ্খল শিক্ষাব্যবস্থাকে সুশৃঙ্খল অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য নানামুখী কর্মকৌশল গ্রহণ করেন।
১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে দেশের সাধারণ মানুষের সন্তানদের শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণের জন্য ৪০ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারিকরণ ও কয়েক লাখ শিক্ষককে সরকারি কর্মচারীর মর্যাদা প্রদান; ১১ হাজার নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বহু স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা; উচ্চশিক্ষার প্রসারের জন্য বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স ঘোষণা করা হয়েছিল, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল চিন্তার স্বাধীনতা ও মুক্ত-বুদ্ধিচর্চার পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক ধারায় বিদ্যাপীঠগুলো পরিচালিত করা। উচ্চশিক্ষা স্তরের প্রতিষ্ঠানগুলোতে থাকবে না সরকার বা রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ। জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি ছাত্র-শিক্ষকরা রাজনীতি চর্চা করবেন নিজেদের মতো করে। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয়ে উঠবে মেধাবী প্রজন্মের চারণভূমি। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর অনেক সম্ভাবনার মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ঘিরে যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল তা নির্বাপিত হয়। ১৯৭৩-এর অধ্যাদেশ বহাল রইল। কাগজে-কলমে গণতান্ত্রিক ধারাগুলোও রইল। তবে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন থেকে মুক্তবিবেক একটি রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে জাতীয় রাজনীতির নিয়ন্ত্রকদের হাতে চলে গেল। আজ বুঝতে পারি বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে এই অনাচারটি হতে পারত না।
যথোপযুক্ত এবং প্রয়োগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা ছাড়া আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সম্ভব নয়- এই উপলব্ধি থেকেই শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিজ্ঞানভিত্তিক, গণমুখী করে ঢেলে সাজানোর লক্ষ্যে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে ২৬ জুলাই ড. কুদরাত-এ-খুদাকে সভাপতি করে বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন করেন বঙ্গবন্ধু এবং ২৪ সেপ্টেম্বর শিক্ষা কমিশনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনকালে বলেন, ‘বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার নানাবিধ ত্রুটি-বিচ্যুতি দূরীকরণ, শিক্ষার মাধ্যমে সুষ্ঠু জাতি গঠন এবং দেশকে আধুনিক জ্ঞান ও কর্মশক্তিতে বলীয়ান করার পথ নির্দেশের উদ্দেশ্যেই এই কমিশন গঠন করা হয়েছে।’ এই কমিশন শিক্ষা খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ, বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসার, শিক্ষকের মর্যাদা বৃদ্ধি ও গবেষণার ওপর গুরুত্ব দিয়েছিল। তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘শিশুদের যথাযথ শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে না পারলে কষ্টার্জিত স্বাধীনতা অর্থহীন হবে।’ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের মাঝে বিনামূল্যে বই, খাতা, পেনসিল, দুধ, ছাতু, বিস্কুট বিতরণ করা হতো।
ড. কুদরাত-এ-খুদা কমিশনের সুপারিশমালায় বলা হয় যে, উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্য হবে এমন একটি শিক্ষিত গোষ্ঠী তৈরি করা যারা কর্মানুরাগ, জ্ঞানস্পৃহা, চিন্তার স্বাধীনতা, ন্যায়বোধ ও মানবিক মূল্যবোধ সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন করবে; গবেষণার মাধ্যমে জ্ঞানের নবদিগন্ত উন্মোচন করবে; সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাবলি সমাধানের পন্থা নির্দেশ করবে।
বঙ্গবন্ধু মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির জন্যই শিক্ষকের বৈষয়িক সুবিধাদির পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনচিন্তা এবং মুক্তবুদ্ধি চর্চার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির ওপর জোর দিয়েছিলেন, যেন শিক্ষকরা স্বাধীনভাবে গবেষণাকর্ম পরিচালনা, জ্ঞান অন্বেষণ, জ্ঞানের বিস্তারণ ঘটাতে পারেন।
শিক্ষাব্যবস্থাকে গণমুখী এবং মানসম্পন্ন করার তাগিদ থেকে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবীদের এক সভায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘গণমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতেই কমিশন গঠন করা হয়েছে এবং কমিশনের সদস্যদের মধ্যে কোনো দল-মত নেই। যারা উপযুক্ত তাদেরকে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর নিযুক্ত করছি। তাদেরকেই আমরা বসানোর চেষ্টা করছি যারা গুণগত পরিবর্তন আনতে পারবে, এর মধ্যে আমি রাজনীতি আনতে চাই না। এ সেক্টরে রাজনীতি না হওয়াই বাঞ্ছনীয়।’ শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং জাতীয় উন্নয়নের স্বার্থেই বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যের মর্ম উপলব্ধি করা প্রয়োজন।
শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য মূল্যায়ন করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘আমলা নয়, মানুষ সৃষ্টি করুন।’ শিক্ষকদের উদ্দেশে বলেছিলেন, আগামী প্রজন্মের ভাগ্য নির্ভর করে গুণগত মানসম্পন্ন যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষক সুনিশ্চিতকরণের উপর। সুতরাং শিক্ষকদের মানোন্নয়নের উপর গুরুত্ব দিতে হবে।(পূর্ব প্রকাশের পর) ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সাহিত্য সম্মেলনের বক্তৃতায় তিনি বলেছেন, একটি সুষ্ঠু জাতি গঠনে শিল্প, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে যেমন উন্নয়ন প্রয়োজন, তেমনি উপযুক্ত শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে মানুষের চিন্তা ও চেতনার ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন প্রয়োজন।
বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিজীবন চর্চায়ও শিক্ষক, কবি, শিল্পী ও সাহিত্যিকদের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধার বহু দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। চট্টগ্রামের শ্রমিকনেতা জহুর আহমেদের আচরণে কোনো এক শিক্ষক অপমানিত হলে বঙ্গবন্ধু নিজে গিয়ে ওই শিক্ষকের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। ছাত্রদের পরীক্ষা পিছানোর দাবি না মানায় অবরুদ্ধ শিক্ষকদের মুক্ত করতে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার জরুরি সভা বাদ দিয়ে তিনি ছুটে গিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলের সভাকক্ষে। স্বাধীন বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিকল্পনায় তিনি শিক্ষকদের যুক্ত করেছিলেন। পরিকল্পনা কমিশনে ড. নূরুল ইসলাম, প্রফেসর রেহমান সোবহান, প্রফেসর আনিসুর রহমান, ড. মোশাররফ হোসেনসহ অসংখ্য শিক্ষক, প্রকৌশলী ও পেশাজীবীকে জড়ো করেছিলেন। প্রফেসর কবীর চৌধুরীকে তিনি শিক্ষাসচিব নিযুক্ত করেছিলেন। প্রফেসর মোজাফফর আহমদ চৌধুরী ও ড. এ আর মল্লিককে মন্ত্রিসভায় নিয়েছিলেন। সাহিত্যিক আবুল ফজলকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য করেছিলেন। জয়নুল আবেদিনসহ সব শিল্পী ও শিক্ষাবিদকে তিনি শিক্ষকতুল্য সম্মান করতেন এবং তাঁদের উপদেশ শুনতেন। পাকিস্তানি শাসন আমলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালী জাতির মুক্তির সংগ্রামের মূল লক্ষ্য ছিল বাঙালিদের জন্য একটি গণতান্ত্রিক, কল্যাণকামী, অসাম্প্রদায়িক জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। তিনি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন যে, শিক্ষা আলোকবর্তিকাস্বরূপ। শিক্ষিত কোনো জাতি পশ্চাৎপদ থেকেছে এমন নজির কোথাও নেই।
শিক্ষার মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী নিজেকে, চারপাশের পরিবেশ-প্রতিবেশ, সমাজ, সংস্কৃতি, ভাষা, সাহিত্য, কৃষ্টি, শিল্পকলা, দেশ, ইতিহাস-ঐতিহ্য, জীবন সংগ্রাম, মানবসভ্যতা ইত্যাদি সম্পর্কে জানার সুযোগ পায়। শিক্ষা একজন মানুষকে সচেতন, সংবেদনশীল, নৈতিক, সৃষ্টিশীল, আত্মপ্রত্যয়ী ও মানবিক গুণে গুণান্বিত করে তোলে। তবে এর মূলে থাকা চাই সুশিক্ষা- যা দেশপ্রেম, মানবকল্যাণ ও মূল্যবোধ সৃষ্টিতে সহায়ক। তাই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ঔপনিবেশিক ধাঁচের প্রতিক্রিয়াশীল শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে বাংলার ছাত্র-সমাজের বৃহত্তর আন্দোলনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত হয়েছিলেন।
পাকিস্তান আমলে ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচন উপলক্ষে দেশবাসীর উদ্দেশে বঙ্গবন্ধুর দেয়া বেতার-টেলিভিশন ভাষণ থেকে আমরা তাঁর শিক্ষা-ভাবনা সম্বন্ধে সম্যক ধারণা পাই। তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলার মাটি থেকে নিরক্ষরতা অবশ্যই দূর করতে হবে। শিশুদের বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষাদানের জন্য একটা ক্রাশ প্রোগ্রাম চালু করতে হবে। মাধ্যমিক শিক্ষার দ্বার সকল শ্রেণির জন্য খোলা রাখতে হবে। দ্রুত মেডিক্যাল ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়সহ নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে।’ ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের প্রথম বার্ষিক সম্মেলন উদ্বোধনকালে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে শিক্ষার উদ্দেশ্য ও নারী শিক্ষা সম্বন্ধে বলেন, ‘দেশে শিক্ষিত নারীর সংখ্যা খুবই নগণ্য। সুতরাং নারী শিক্ষার উপর আরো গুরুত্ব দিতে হবে।’
বঙ্গবন্ধুর ভাষণগুলোতে তাঁর শিক্ষা-ভাবনার যে বিষয়গুলো গুরুত্ব পেয়েছে সেগুলো হলো: দেশ-জাতি-সমাজ গড়তে শিক্ষার অপরিহার্যতা; শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যয় ভবিষ্যতের জন্য শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ; নারীশিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ; গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষা নিশ্চিতকরণ; নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূরীকরণ; পাঁচ বছর বয়সী সকল শিশুর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গমন নিশ্চিতকরণ; শিক্ষার মাধ্যমে সমাজ চাহিদা ও জাতীয় প্রয়োজন পূরণে সক্ষম আলোকিত মানুষ তৈরি করা; সবার জন্য অন্তত মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত রাখা; অর্থাভাবে কোনো শিক্ষার্থীর শিক্ষালাভ যাতে ব্যাহত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা এবং শিক্ষাক্ষেত্রে মেধার লালন ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান; শিক্ষাব্যবস্থাকে যুগোপযোগী ও চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করা; শিক্ষালব্ধ জ্ঞান বাস্তবে প্রয়োগ করে সামাজিক সমস্যাসমূহ সমাধানের মাধ্যমে উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা ইত্যাদি।
সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমাদের সমাজের মৌলিক প্রয়োজনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রত্যেকটি নাগরিকের সর্বাধিক উন্নতি সম্ভব করে তোলাই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য।’ শিক্ষকতা পেশা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু আরও বলেন, ‘আমাদের দেশের শিক্ষিত সমাজের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিরা যাতে শিক্ষকতা পেশার প্রতি আকৃষ্ট হন, সেই পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সব রকম চেষ্টা করা হবে। এজন্য কেবল তাঁদের বেতন বৃদ্ধি ও বৈষয়িক সুবিধা দিলেই চলবে না, সঙ্গে সঙ্গে কাজ করার উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি এবং শিক্ষকদের ন্যায্য মর্যাদা এবং সম্মানও দিতে হবে।’ বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাদর্শন নিয়ে অধিক গবেষণা করা হলে এবং তার আলোকে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করা হলে বাঙালির শিক্ষামুক্তির পথ আরো মসৃণ ও যথাযথ হবে।
বঙ্গবন্ধু তাঁর চিন্তার আলোকে বাংলাদেশকে গড়ে তোলার সুযোগ বেশিদিন পাননি। তিনি সরকার ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অনেক কিছু শুরু করেছিলেন এবং সেসবের ভিত্তিও রচনা করেছিলেন। এরই মধ্যে সংঘটিত হয় আগস্টের ট্র্যাজেডি। মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত দেশি-বিদেশি শত্রুদের গভীর ষড়যন্ত্রের ফলে ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগস্ট পরিবারের উপস্থিত সকল সদস্যসহ অত্যন্ত নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে তাঁকে জীবন দিতে হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের প্রতিটি স্তরেই রেখে গেছেন কালোত্তীর্ণ মুক্তিদর্শনের পথ।
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত ও আরাধ্য পথে তাঁর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে তিনিও শিক্ষাকে বিশ্বমানে উন্নীত করতে চান। আর এ জন্যই তিনি প্রয়োজনে বিদেশ থেকে শিক্ষক আনার কথা উল্লেখ করেছিলেন। তাঁর সাথে সুর মিলিয়ে আমিও বলতে চাই, শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি এবং শিক্ষার মানোন্নয়নের স্বার্থে প্রয়োজনে বিদেশ থেকে দক্ষ ও অভিজ্ঞ শিক্ষক খণ্ডকালীন বা চুক্তিভিত্তিতে আনা যেতে পারে। তবে তার আগে প্রয়োজন এন্ট্রি লেভেলে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, নিরপেক্ষতা, অবাধ প্রতিযোগিতা এবং ব্যক্তিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত একটি আদর্শমান উত্তীর্ণ নিয়োগ প্রক্রিয়ার নিশ্চয়তা বিধান। বর্তমান সামাজিক বাস্তবতায়, এন্ট্রি লেভেলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগের ক্ষমতা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে রেখে তা বাস্তবায়ন করা অসম্ভব ব্যাপার। ধাপভিত্তিক পদ্ধতি (লিখিত, মৌখিক এবং প্রদর্শনী ক্লাস) অনুসরণপূর্বক বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বা উচ্চশিক্ষা কমিশনের মাধ্যমে এন্ট্রি লেভেলে শিক্ষক নিয়োগের লক্ষ্যে বাছাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হলে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের পক্ষে ব্যক্তিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত এবং অনাকাঙ্ক্ষিত চাপমুক্ত হয়ে মেধাবী, দক্ষ ও কার্যকর শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হবে।
এক দশকে বাংলাদেশের সর্বক্ষেত্রে যে অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়েছে, তা আজ বিশ্ববাসীর কাছে বিস্ময় ও রোল মডেল। এর মূলে রয়েছে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বুদ্ধিবৃত্তিক ও সৃষ্টিশীল নেতৃত্ব এবং তাঁর সততা, বলিষ্ঠতা ও দেশের প্রতি শতভাগ অঙ্গীকার। শেখ হাসিনা জাতির পিতার কন্যা। তিনি শুধু পিতার রক্তের উত্তরাধিকারীই নন, তাঁর আদর্শের ধারক ও বাহক। জাতির পিতার স্বপ্ন ছিল ‘সোনার বাংলা’ গড়ার। পিতার সে স্বপ্ন বাস্তবায়নই তাঁর একমাত্র ব্রত। তাই তিনি ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে মধ্যম আয়ের দেশ, আর ২০৪১ খ্রিষ্টাব্দে উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়েই কাজ করে যাচ্ছেন। ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে বসেই তিনি ২১০০ খ্রিষ্টাব্দের বাংলাদেশের স্বপ্ন এঁকেছেন ডেল্টা প্লান বাস্তবায়নের। এমন দেশপ্রেমিকের হাতে নেতৃত্ব ন্যস্ত থাকলে দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি ঘটবেই। শিক্ষাক্ষেত্রে যেখানে দেশের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ জড়িত, সেখানে সঠিক নেতৃত্ব ও দিকনির্দেশনা থাকলে শিক্ষাই পূরণ করবে বঙ্গবন্ধুর ‘সোনার বাংলা’ গড়ার স্বপ্ন।
আমাদের সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর বিভিন্ন ভাষণে জ্ঞানভিত্তিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ওপরে জোর দিচ্ছেন। বিশ্বের অন্যতম বুদ্ধিভিত্তিক শাসকের স্বীকৃতিও তিনি পেয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাদর্শনের আলোকে একটি সুখী-সমৃদ্ধ ও সমুন্নত বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে তিঁনি বলেছেন, ‘শিক্ষাকে আমি খরচ মনে করি না, এটিকে আমি একটি সমৃদ্ধ জাতিগোষ্ঠী গড়ে তোলার বিনিয়োগ মনে করি।’ দীর্ঘদিন ধরে আমাদের দেশে জাতীয় শিক্ষানীতি বলতে কিছু ছিল না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের আমলে ২০১০ সালে সর্বমহলের মতামতের ভিত্তিতে বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতা, যুগের চাহিদা ও দেশের প্রয়োজন উপযোগী একটি সর্বজনগ্রাহ্য জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণীত হয়, যা এখন বাস্তবায়নও প্রক্রিয়াধীন। শেখ হাসিনা সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০’ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের দিক থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হচ্ছে সফল মন্ত্রণালয়ের মধ্যে অন্যতম। এ সাফল্যের মূলে রয়েছে তাঁর সার্বিক নির্দেশনা ও তত্ত্বাবধায়ন এবং শিক্ষাপ্রশাসনের অক্লান্ত পরিশ্রম ও কর্তব্যনিষ্ঠা।
বর্তমান সরকার স্কুলগামী প্রায় শতভাগ শিশুর বিদ্যালয়ে ভর্তি ও তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধরে রাখার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ঝরে পড়া রোধে অঞ্চলভেদে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিদ্যালয়ে দুপুরে টিফিনের ব্যবস্থা করা হয়েছে; বিভিন্ন ধরনের বৃত্তি, উপবৃত্তি ও মেধাবৃত্তির প্রচলন করেছে যা ঝরে পড়া রোধে সহায়ক হচ্ছে; ২০১০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে প্রাক প্রাথমিক, প্রাথমিক, এবতেদায়ী, মাধ্যমিক, দাখিল স্তরের প্রায় ৫ কোটি শিক্ষার্থীর হাতে নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী প্রায় ৩৭ কোটি নতুন বই বছরের প্রথম দিন বিনামূল্যে বিতরণ করছে, নারীর ক্ষমতায়ন ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির লক্ষ্যে স্নাতক স্তর পর্যন্ত নারীশিক্ষা অবৈতনিক এবং তাদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে ইত্যাদি। বর্তমানে প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত মেয়ে শিক্ষার্থীদের হার ছেলেদের তুলনায় অধিক। নারী শিক্ষা প্রসারের মাধ্যমে বাল্যবিবাহ হ্রাস পেয়েছে। বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা ভাবনাই শেখ হাসিনা সরকারের শিক্ষানীতি ও আদর্শ। একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, তাঁর সরকারের আমলে বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে নীরব বিপ্লব সাধিত হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে সাক্ষরতা ৭৩ শতাংশের ঊর্ধ্বে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকলে এবং আমাদের সকলের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ অব্যাহত থাকলে শিগগিরই সাক্ষরতার হার শতভাগ উন্নীত হবে, ইনশাল্লাহ।
লেখক: প্রফেসর ড. মো. লোকমান হোসেন, সাবেক মহাপরিচালক, নায়েম, ঢাকা ।