স্কটল্যান্ড কড়চা

নাইমুল আজম খান |

অবশেষে দীর্ঘ বিরতির পর আবার বিদেশ এলাম। এবার স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো। এখান থেকে লন্ডন হয়ে ফিরব বাংলাদেশে। পৃথিবীতে মানুষ নাকি বারোয়ারি হয়। এ তত্ত্বের উদ্ভাবক কে, জানি না। তবে এটা জানি, মানুষের শখ বড় বিচিত্র। কেউ মাছ ধরে, কেউ বাঁশি বাজায়, কেউ স্ট্যাম্প জমায়, কেউ বা কয়েন। এক বন্ধুকে দেখেছি, সে তার জীবনের বিভিন্ন স্তরে প্রেম করতে গিয়ে যেসব চিঠিপত্র লেখালেখি করেছে, তা সংরক্ষণ করত। সে যা হোক, আমার শখ হলো লেখালেখি আর ঘুরে বেড়ানো। ১৯৮৬ থেকে ২০০১ খ্রিষ্টাব্দ সময়কালে দেশের ভেতরে ঘুরেছি প্রচুর। ৬৪ জেলার মধ্যে ৫৪ জেলা দেখা হয়ে গেছে ওই সময়ে। 

আমি বড় হয়েছি পুরনো ঢাকায়। সে সূত্রে লালবাগ কেল্লা, আহসান মঞ্জিল, ছোট কাটারা, বড় কাটারা এসব দেখে বড় হয়েছি। ছাত্রাবস্থায় মহাস্থানগড়, পাহাড়পুর, ষাট গম্বুজ, ময়নামতিসহ অনেক জায়গায় বেড়িয়েছি। কর্মজীবনে এসে দেখেছি কান্তজি মন্দির, বালিয়াটি, মুক্তাগাছা জমিদারবাড়ী, কুমিল্লা ওয়ার সিমেট্রি, সোনা মসজিদ, লালনের চেউরিয়া, শিলাইদহ কুঠিবাড়ি, মুজিবনগর আম্রকানন, সাজেক, নীলগিরি, কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, শ্রীমঙ্গলসহ কত কী? পাশের দেশ ভারতেও গেছি বেশ কয়েকবার। কিন্তু ইউরোপযাত্রা শুরু হয়েছিল ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে বিলেত সফর দিয়ে। এবার আবার এলাম সে যুক্তরাজ্যভুক্ত দেশ স্কটল্যান্ডে।

এবারের এ বিদেশ সফর নির্বিঘ্ন ছিল না। এবারে আসাটা বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৬ এ যোগ দিতে। দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। তিনি ক্লাইমেট ভার্নারেবল ফোরামের সভাপতি হিসেবে এবার বাংলা দেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার নেতা। গেল দু’বছর কোভিড ভয়াবহতায় নিশ্চিত ছিল না সম্মেলনটা শরীরী উপস্থিতিতে হবে নাকি ভার্চুয়াল? প্রতিনিধিদলের দৈর্ঘ্য বড় হবে, না ছোট হবে? ভিসা পাওয়া যাবে, না যাবে না? ভ্রমণ শুরু হবার ৪৮ ঘণ্টা আগে কোভিড পরীক্ষার ফলাফল নেগেটিভ আসবে তো? এত সব কিন্তুর উত্তর মেলাতে গিয়ে বিদেশ সফরের আবেগটা পরিণত হয়েছিল উদ্বেগে। 

মনটা অন্য কারণেও খারাপ ছিল। গেলবার যখন বিদেশে গেলাম, তখন মা জীবিত ছিলেন। বিদায়ের সময় মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করেছিলেন। এবারে মেয়েরা সে চেষ্টা করেছে। কিন্তু মায়ের ওই স্পর্শটা খুব মিস করছি। এবার আর খুঁজে খুঁজে মায়ের জন্য নরম সেন্ডেল কিংবা ভেসলিন কিনতে হবে না। ভাবতেই মনটা মোচড় দিয়ে উঠছে। ছোট্ট শিশুদের মত ভাবতে ইচ্ছে হচ্ছে, আকাশের ওপার থেকে মা আমাকে দেখছেন। কেবল যোজন যোজন দূর থেকে তাকে ছুঁয়ে দেখতে পারছি না। এই কষ্টটা বোধ হয় কেবল আমার মত মা-হারারাই বুঝতে পারবেন। মায়ের সঙ্গে নাড়ীর যোগ ছিল বলেই হয়তো প্রতিদিন মাকে মনে পড়ে। বিচ্ছেদের অনলটা যেন ক্রমশই গ্রাস করে  আমার হৃদয়ের কূল-উপকূল। তবুও এভাবেই হয়তো বাঁচতে হয়। এভাবেই হয়তো বাঁচতে হবে।

যুক্তরাজ্যভুক্ত কয়েকটি রাজ্যের একটি স্কটল্যান্ড। ইংল্যান্ডের রানী এলিজাবেথের শ্বশুরবাড়ি এডিনবরা হচ্ছে স্কটল্যান্ডের রাজধানী। শিল্প, শিক্ষা ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় স্কটল্যান্ড যুক্তরাজ্যভুক্ত অন্য রাজ্যগুলোর চেয়ে এগিয়ে। স্কটল্যান্ডের মোটামুটি আয়তন ৭৮ হাজার ৩শ’ ৮৭ বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যা ৫৩ লাখ ২৭ হাজার ৭শ। আমাদের দেশে যেখানে প্রতি কিলোমিটারের জনসংখ্যা ৩ হাজারেরও বেশি, সেখানে ওদের জনসংখ্যা ৬৫ জন। জলবেষ্টিত স্কটল্যান্ডের উত্তর ও পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগর, পূর্বে উত্তর সাগর এবং দক্ষিণে আইরিশ সাগর। মোটামুটিভাবে ৭৯০টি দ্বীপ আছে এদের দখলে। স্কটল্যান্ডের সরকারি ভাষা ইংরেজি, কিন্তু আঞ্চলিক স্কটিশ-গ্যালিক ভাষাও চালু আছে। বলা হয়, আমাদের দেশে নাকি ভাষা নোয়াখালীতে গিয়ে আহত আর চট্টগ্রামে গিয়ে নিহত হয়েছে। স্কটিশ-গ্যালিক তেমন নয়। ওই উচ্চারণের ভিন্নতা আর কী? স্কটল্যান্ডের জনসংখ্যার ৯৬ শতাংশ শে^^তাঙ্গ, দক্ষিণ এশীয় আছে ২.৭ শতাংশ। জনসংখ্যার হিসেবে ওটা দ্বিতীয়। আরবীয়ও আছে ০.২ শতাংশ।

 ১৭০৭ খ্রিষ্টাব্দে Treaty of unity-র মাধ্যমে স্কটল্যান্ড আর ইংল্যান্ড নিয়ে গ্রেট ব্রিটেন হলেও স্কটিশরা নিজেদের ইংলিশ বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন না। যুক্তরাজ্যের অধীনে স্বায়ত্তশাসিত দেশ হলেও ওদের বর্তমান প্রজন্ম নিজেদের স্বাধীন ভাবতেই পছন্দ করে। তাই আপনি যখন ওদের জিজ্ঞেস করবেন  ‘Are you English?" ও তখন ভ্রু কুঁচকে জবাব দেবে ‘No, I am Scottish’। জাত্যাভিমান আর কাকে বলে? 

১৬০৩ খ্রিষ্টাব্দে রাজা প্রথম জ্যাকবের সময় ইংল্যান্ড এবং স্কটল্যান্ড একত্রিত হলেও ওদের শিক্ষা, বিচারব্যবস্থা এমনকী মুদ্রাব্যবস্থা থেকে যায় স্বতন্ত্রই। স্বাধীন হবার দাবিটাও হয়তো পুঞ্জীভূত হচ্ছে ভেতরে ভেতরে। তাই ১৯৭৯ ও ১৯৯৭ তে দু’দফা গণভোট হবার পর ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে পৃথক আইনসভা গঠিত হয়েছে। ১২৯ আসনের এই আইনসভায় এলেক্স সালমন্ডের নেতৃত্বাধীন স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি সংখ্যাগুরু। যাদের এজেন্ডা ওই স্বাধিকার।

স্কটল্যান্ড এমন এক দেশ, যেখানে প্রতিরক্ষাখাতে কোনও বাজেট বরাদ্দ নেই। মাত্র ১১ হাজার ১শ সদস্যের সেনাবাহিনী আছে ওদের। ৪ হাজার এমওডি সেনা, সাড়ে ১১ হাজার স্কাউট আর ২ হাজার ২শ  প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক আছে ওদের নিরাপত্তা রক্ষায়। সামরিক  প্রতিযোগিতার এ বিশ্বে ভাবা যায় কীরকম শৃঙ্খলার দেশ এটি?

ওদের দেশে মজার একটি বিষয় লক্ষ্য করলাম। তা হলো ওদের গাড়িগুলোর ড্রাইভিং সিট বামপাশে অর্থাৎ গাড়িগুলো বামদিক থেকে চালিত। ডানদিকে অভ্যস্ত হওয়ায় প্রথম প্রথম একটু সমস্যাই হয়। ওদের খাদ্যভ্যাস ভাল। পানিবেষ্টিত হওয়ায় ডীপ ফ্রাইডফিস থাকে ওদের খাদ্যতালিকায়। রুটি, কেক, জাউভাত--সবই খায় ওরা। মার্সবার নামে এক ধরনের খাবার থাকে ওদের পছন্দ তালিকায়। তবে সবচেয়ে পছন্দের খাবার হলো হ্যাগিস, যা ভেড়ার হৃৎপিণ্ড, পাকস্থলী, যকৃত দিয়ে তৈরি। স্কটল্যান্ডকে বিবেচনা করা হয় উৎসবের দেশ হিসেবে। সারা বছরই নানা উৎসব চলতে থাকে দেশটিতে। আর্ট, ট্যাটু, বইসহ নানা কিছুর উৎসব। প্রধান উৎসবের মধ্যে আছে বার্নস নাইট, এডিনবার্গ ফেস্টিভ্যাল। প্রতিবছর এডিনবরায় ২৫ দিনব্যাপী ফিন্সলে আর্ট ফেস্টিভ্যাল হয় দু'শর বেশি ভেন্যুতে। বিশ্বের নানা জায়গা থেকে দশ লাখেরও বেশি দর্শক অংশ নেয় এতে। বৃটিশদের সম্পর্কে আমাদের দেশে নানা প্রবাদ, প্রবচন আছে। কেউ বলে বেনিয়ার জাত, কেউ বলে কাঠখোট্টা, কেউ আবার একধাপ এগিয়ে বলে বৃটিশ মানে খাটাস। আসলে এ অঞ্চলের মানুষ দীর্ঘদিন ওদের দ্বারা নির্যাতিত হওয়ায় এসব বলা। স্কটল্যান্ডে গিয়ে আমার তেমনটা মনে হলো না। ওদের মানুষজন শিল্পরসিক, স্মিতহাস্য। ওদের মেয়েরা স্মার্ট, সুদর্শনা।  প্রায় সবাই নীলচোখের অধিকারিণী।

এবার বিদেশ সফরে আসতে অন্য সব বারের চেয়ে যন্ত্রণা পোহাতে হয়েছে বেশি। সম্মেলনে সব দপ্তর মিলে সরকারি  প্রতিনিধি দলের সদস্য সংখ্যাই হবে শতাধিক। জাতীয় সংসদ থেকে ৫ জন সংসদ সদস্য আর আমি আছি সরকারি দলে। যেহেতু সংসদ থেকে একমাত্র কর্মকর্তা আমি, কাজেই ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক, পুরো বিষয়টি আমাকেই সমন্বয় করতে হচ্ছে। আর সেখানেই সব জটিলতা। দলভুক্ত সব কর্তাব্যক্তিরই ইচ্ছে, সঙ্গে একজন করে লোক নেয়া। তাদের এ ইচ্ছার নেপথ্যে কাজ করে নানা কারণ। কেউ মনে করেন ইংল্যান্ডের ভিসা মানে Gate way to Europe, আবার কারও ধারণা, এটা রাষ্ট্রীয় সফর হলেও হানিমুনের সুযোগ কে মিস করে? বিনা ভাড়ায় হোটেল ও ভিসার ব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় প্রটোকল পাওয়া যায়। স্ত্রী বা এলাকাবাসীর কাছে নিজের গুরুত্ব ও ক্ষমতা প্রদর্শনের সুযোগও থাকে এতে। আবার কতিপয় কর্মকর্তার ব্যক্তিচরিত্র নিয়ে নানা কথা আছে। সেক্ষেত্রে স্বচ্ছতা প্রমাণে কর্ত্রীদের সঙ্গে রাখা কারো কারো জন্য প্রয়োজনও। দু’একজনের কাছে এ ভ্রমণ আবার হিসাবের খেরোখাতা। তারা ভাবেন, সফরে যে অপচয় হবে, তা পোষাতে একজন সঙ্গী নেয়া তো অন্যরকম ব্যাপার। নিজেরও খরচ করতে হলো না, আবার সঙ্গীরও ইউরোপে ঢোকা নিশ্চিত হলো। সে যা হোক, কোভিড বাস্তবতায় এবারের সম্মেলনে প্রবেশাধিকার সীমিত। কিন্তু কর্তাদের কী নিরলস চেষ্টা, তাদের সঙ্গীদের সঙ্গে নেয়ার। কিন্তু বৃটিশ মানে তো অন্য কিছু। ওদের যাচাইয়ে বাদ পড়লেন একজন কর্ত্রী। কর্তা মনে মনে খুশি, কিন্তু ভাব দেখালেন খুবই ব্যথিত। আমাকে অনুরোধ করলেন, আমি যেন কর্ত্রীকে বলি, কর্তার সব চেষ্টা সত্ত্বেও ভিসা হয়নি। এতে কর্তার কোনও হাত ছিল না। কিছুদিন আগে কর্তার একটি রগরগে ভিডিও ভাইরাল হওয়ায় হয়তো এই অনুরোধ। 

ডাবল স্ট্যান্ডার্ড আর কাকে বলে?

লেখক : নাইমুল আজম খান, উপসচিব, জাতীয় সংসদে কর্মরত।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0025148391723633