স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের জীবন যায় সরকারির আশায়

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

প্রত্যেক উপজেলায় অন্তত একটি কলেজকে সরকারি করার লক্ষ্যে ২০১৬ সালে জাতীয়করণে সম্মতিদান শুরু করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এখন পর্যন্ত ৩২৪টি কলেজকে জাতীয়করণের গেজেট জারি হয়েছে। তবে গত ৬ বছরে মাত্র ১০টি কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরি সরকারি হয়েছে।

ইতিমধ্যে প্রায় ৪ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী অবসরে চলে গেছেন। সরকারি কলেজে চাকরি করেও শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরি সরকারি না হওয়ায় তাদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে। সরকারিকরণের সুবিধা না পাওয়ায় অনেক কলেজ এখনো বেসরকারি কলেজের মতো শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে উচ্চ টিউশন আদায় করছে। ফলে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের মধ্যেও অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। এতে জাতীয়করণের মাধ্যমে শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্য ব্যাহত হচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ‍বৃহস্পতিবার (৪ আগস্ট) দেশ রুপান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন শরীফুল আলম সুমন।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ‘নির্বাচিত ৩২৪ কলেজের মধ্যে গত ২৪ জুলাই পর্যন্ত ২২৬ কলেজের ফাইল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এখনো ৯৮ কলেজের কাজ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চলমান রয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কাজ শেষে ১৩৫ কলেজের ফাইল গেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ে। আর অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাজ শেষে ৬৭ কলেজের ফাইল প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটিতে পাঠানো হয়েছে। তাদের অনুমোদন নিয়ে কতটি ফাইল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ফেরত এসেছে তা জানা যায়নি।

এখন পর্যন্ত ৮ কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরি সরকারি করার আদেশ জারি হয়েছে। সেটাও আংশিক। অর্থাৎ কোনো কলেজে শিক্ষকদের, কোনো কলেজে কর্মচারীদের আবার কোনো কলেজে কিছু শিক্ষক ও কিছু কর্মচারীর চাকরি সরকারি করার আদেশ জারি হয়েছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (কলেজ) মু. ফজলুর রহমান  বলেন, ‘জাতীয়করণকৃত কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীদের আত্মীকরণের কাজ পুরোদমে চলছে। বেশিরভাগ কাজ শেষ পর্যায়ে। সচিব কমিটিতে একটি কলেজের একাংশের ফাইল পাঠালেও তাতে তারা অনুমোদন দিচ্ছেন। আমাদের কাজ ত্বরান্বিত হয়েছে। এখন নিয়মিতভাবে শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরি সরকারিকরণের গেজেট জারি হতে থাকবে। কলেজ জাতীয়করণের গেজেট যেদিন জারি হয়েছে সেদিন পর্যন্ত যাদের বয়স ৫৯ বছর ছিল, তারা সরকারিকরণের সুবিধা পাবেন।’ 

জাতীয়করণের তালিকাভুক্ত বেশিরভাগ কলেজ সরকারিকরণে প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি পায় ২০১৬ সালে। প্রধানমন্ত্রীর এ সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে ‘নো বিসিএস নো ক্যাডার’ আন্দোলনে নামেন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির সাবেক মহাসচিব ও বর্তমান সভাপতি অধ্যাপক শাহেদুল খবির চৌধুরী ও তার অনুসারীরা। তারা এ ব্যাপারে রিট পিটিশনও করেন। মামলা সামাল দিয়ে ২০১৮ সালের ৮ আগস্ট বেশিরভাগ কলেজকে জাতীয়করণের গেজেট জারি হয়। মামলার কারণে প্রায় দুই বছর পিছিয়ে যায় জাতীয়করণের কাজ।

জাতীয়করণের পর শিক্ষক-কর্মচারীদের তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের কাজ শুরু করে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর। তারা এ কাজে তিন বছর সময় নেয়। এরপর আবার যাচাই-বাছাই করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। একই কাজ দুই দপ্তর থেকে দুইবার করায় অনেক সময় লেগে যায়। এরপর ফাইল যায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। পরে অর্থ মন্ত্রণালয়ে, সবশেষে ফাইল যায় সচিব কমিটিতে। এরপর আবার ফাইল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ফেরত এলে শিক্ষক-কর্মচারীদের অ্যাডহক নিয়োগ দিয়ে চাকরি সরকারিকরণের আদেশ জারি হয়। 

গতকাল ৩ আগ পর্যন্ত যে ১০ কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরি সরকারি হয়েছে, তার মধ্যে দিনাজপুরের পার্বতীপুর কলেজের শিক্ষক-কর্মচারী, সিলেটের কানাইঘাট কলেজের শিক্ষক, কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ কলেজের কর্মচারী, ঢাকার সাভার কলেজের কর্মচারী, বরিশালের হিজলা কলেজের কর্মচারী, চুয়াডাঙ্গার জীবননগর আদর্শ মহিলা কলেজের শিক্ষক, মাগুরার মুক্তিযোদ্ধা আসাদুজ্জামান কলেজের শিক্ষক, চাঁদপুরের মতলব জেবি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক, পাবনার ঈশ^রদীর সাঁড়া মাড়োয়ারী মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক-কর্মচারী এবং একই জেলার শ্রীপুর কলেজের শিক্ষকরা রয়েছেন।

চাকরি সরকারিকরণের গ্যাঁড়াকলে পড়ে একে একে অবসরে যাচ্ছেন শিক্ষক-কর্মচারীরা। সরকারি কলেজ শিক্ষক সমিতি (সকশিস)-এর তথ্যানুযায়ী, জাতীয়করণকৃত ৩২৪ কলেজের এমপিও ও নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা ১৯ হাজার ২০৬ জন। শিক্ষকের সংখ্যা ১৩ হাজার ২১৭ জন ও কর্মচারীর সংখ্যা ৫ হাজার ৯৮৯ জন। ৬ বছরে অবসরে গেছেন ৪ হাজার ১০৬ জন শিক্ষক-কর্মচারী।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, শিক্ষক-কর্মচারীরা অবসরে চলে গেলেও যেদিন জাতীয়করণের গেজেট জারি হয়েছে সেদিন থেকে বৈধ নিয়োগপ্রাপ্তরা সরকারিকরণের সুবিধা পাবেন, যদি সেদিন তাদের বয়স ৫৯ বছর হয়ে থাকে।

সাভার কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক রেজাউল করিম অবসরে যান ২০২০ সালের জানুয়ারিতে। তিনি বলেন, ‘আমাদের কলেজ জাতীয়করণের গেজেট হয়েছে ২০১৮ সালের আগস্টে। তখন আমার বয়স সাড়ে ৫৮ বছর। আমাদের বিভাগে ১০টি পদ সৃষ্টি করার কথা থাকলেও হয়েছে সাতটি। আমি সেখানে নেই, কারণ আমি অবসরে গেছি। অথচ মন্ত্রণালয়ের কথা অনুযায়ী আমার সরকারিকরণের সব সুবিধা পাওয়ার কথা। আমাকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। সামনে হয়তো আমাকে আপিল করতে হবে, দৌড়াদৌড়ি করতে হবে। অবসরের পরেও এত ভোগান্তি আর অনিশ্চয়তার দায় কে নেবে?’  

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর কলেজ থেকে অবসরে যাওয়া পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষক হারুনুর রশীদ বলেন, ‘আমাদের কলেজ জাতীয়করণের সম্মতি পায় ২০১৬ সালের জুনে। জাতীয়করণের গেজেট প্রকাশিত হয় ২০১৮ সালের ৮ আগস্ট। এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের নিয়মানুযায়ী ৬০ বছর বয়সে আমি ২০১৯ সালের ২৯ জুন অবসরে যাই। প্রায় ৩ বছর সরকারি কলেজে চাকরির পর আমি সরকারিকরণের সুবিধা পাব কি না তা কেউ বলতে পারছে না। প্রধানমন্ত্রীর সম্মতির পর জাতীয়করণের গেজেট হতে যদি দুই বছর সময় লাগে সে দায় কেন আমরা নেব? আমার তিন মেয়ে লেখাপড়া করছে। আমি অনেক সমস্যায় আছি। সরকারিকরণের সুবিধা পেলে আমি বেঁচে যাই।’ 

সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা বলছেন, চাকরি সরকারিকরণে দীর্ঘদিন লেগে যাওয়ায় কলেজগুলোতে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। জাতীয়করণকৃত কলেজে নিয়মিত শিক্ষক-কর্মচারীদের পদায়ন করা হচ্ছে না। অনেক বিষয়ের শিক্ষক নেই বলা যায়। এক বিষয়ের শিক্ষক পড়াচ্ছেন আরেক বিষয়। চাকরি সরকারিকরণের গেজেটে শেষ পর্যন্ত নাম থাকবে কি না এ আতঙ্কেও আছেন অনেক শিক্ষক-কর্মচারী। এর প্রভাব পড়ছে পাঠদানে। ফলে মানসম্মত শিক্ষা অর্জনের লক্ষ্য ব্যাহত হচ্ছে।

বাংলাদেশ সরকারি কলেজ গ্রন্থাগার পেশাজীবী পরিষদের সভাপতি আবুল কালাম মোহাম্মদ ফরহাদ বলেন, ‘আমরা বেসরকারি থাকা অবস্থায় ৯ম ও ১০ম গ্রেডে যোগদান করে টাইমস্কেল পেয়ে ৭ম এবং ৬ষ্ঠ গ্রেডে কর্মরত আছি। চাকরি সরকারিকরণের পর গ্রেড অবনমন করে গ্রন্থাগারিকদের ৯ম গ্রেডের পরিবর্তে ১০ম গ্রেড ও সহকারী গ্রন্থাগারিকদের ১০ম গ্রেডের পরিবর্তে ১৪তম গ্রেড দেওয়া হচ্ছে। ফলে চাকরি সরকারি হলেও বেতনভাতা বেসরকারি আমলে প্রাপ্ত বেতনের অর্ধেকে নেমে এসেছে। শিক্ষকদের মধ্যে এসব অসন্তোষ রেখে শিক্ষার মান উন্নয়ন দুরূহ।’

কলেজ জাতীয়করণ করা হলেও শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরি সরকারি না হওয়ায় আগের মতো বেসরকারি টিউশন ফি-ই আদায় করছে বেশিরভাগ কলেজ। শিক্ষকরা যেহেতু এখনো এমপিওভুক্তির সুবিধা পাচ্ছেন, তাই সরকারি অংশের বাইরে কলেজের বেতনের অংশ নিতে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টিউশন ফি আদায় করা হচ্ছে। এতে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের মধ্যেও অসন্তোষ বাড়ছে।

সরকারি কলেজ শিক্ষক সমিতির (সকশিস) সভাপতি  জহুরুল ইসলাম  বলেন, ‘শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরি সরকারিকরণ নিয়ে আমরা ধূম্রজালে আছি। ৬ বছর পার হয়ে গেল, কবে গেজেটে অন্তর্ভুক্ত হব জানি না। কতদিন লাগবে সে ব্যাপারেও মন্ত্রণালয়ের সদুত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। আবার যে কয়জনের চাকরি সরকারিকরণের গেজেট জারি হয়েছে, তাদের অনেকের বেতন অবনমন হয়েছে। শিক্ষকদের মধ্যেও অসন্তোষ বাড়ছে। আমাদের সমস্যার বিষয়ে জানাতে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেও পারিনি। প্রধানমন্ত্রীর সম্মতিতে কলেজগুলো সরকারি হয়েছে, এখন জটিলতা ও অসংগতি দূর করার জন্য আবারও প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি।’


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন - dainik shiksha জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো - dainik shiksha ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা - dainik shiksha তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণ ও ‘বিশ্ব বই দিবস’ - dainik shiksha স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণ ও ‘বিশ্ব বই দিবস’ শিক্ষার মান পতনে ডক্টরেট লেখা বন্ধ জার্মান পাসপোর্টে - dainik shiksha শিক্ষার মান পতনে ডক্টরেট লেখা বন্ধ জার্মান পাসপোর্টে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0028879642486572