স্কুল-কলেজে বিশৃঙ্খলা : কোথাও জবরদস্তি কোথাও পালিয়ে থাকা

দৈনিক শিক্ষাডটকম প্রতিবেদক |

গড়পরতা হিসেবে সারাদেশে গত দুই সপ্তাহে অন্তত হাজারখানেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চরম বিশৃঙ্খলতা ও জবরদস্তির খবর মিলছে। এ সময়ে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান অপদস্ত হয়ে পদ ছেড়েছেন আবার কেউ স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আবার প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে জোর করে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। সবচেয়ে বিব্রত হয়েছেন সরকারি কলেজ ও হাইস্কুলের প্রধানরা। 

অনুসন্ধানে জানা গেছে বছরের পর বছর ধরে দলবাজি করা ও নিজের করা দুর্নীতি ও অপকর্মের কারণেও ফেঁসেছেন অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান প্রধান। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর আন্দোলনের মুখে বাসভবন ছেড়ে প্রধান শিক্ষকের পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। ঝালকাঠির নলছিটি সরকারি ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ রফিকুল ইসলাম কবির মোল্লা পলাতক রয়েছেন ৫ আগস্ট থেকে। 

পদ ছাড়তে বাধ্য হওয়া কয়েকজন দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেছেন, জবরদস্তির ঘটনাই বেশি। তাদের বিরুদ্ধে দলবাজি, নোট-গাইড কোম্পানি থেকে টাকা খাওয়া, সহকর্মীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহারসহ হাসিনা সরকারের আমলে নানা অপকর্মের অভিযোগ আছে বলে দাবি করা হচ্ছে। অভিযোগ থাকলে ব্যবস্থা নেওয়ার নিয়মতান্ত্রিক ও যথাযথ প্রক্রিয়া থাকলেও তা অনুসরণ করা হচ্ছে না।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় চিঠি দিয়েছে মঙ্গলবার। এর আগে গত ২১ আগস্ট শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, শিক্ষাঙ্গনে বলপ্রয়োগ বা কাউকে ব্যক্তিগতভাবে অপমানিত করা যাবে না। যে যত অন্যায় করুক না কেন, নিয়মমাফিক যত দ্রুত পারা যায়, ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

নানা অপকর্মে লিপ্ত ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরী ও কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. ফারহানা খানমকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। ১১ আগস্ট ভিকারুননিসার সাবেক ও বর্তমান ছাত্রীদের আন্দোলনের মুখে তারা পদত্যাগপত্র দেন। এ ব্যাপারে অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরী দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, ছাত্রীদের দাবির প্রতি সম্মান রেখে আমি পদত্যাগ করছি। আর ড. ফারহানা খানম বলেন, আমাকে জোর করে পদত্যাগ করতে বাধ্য করানো হয়েছে। 

গত দুই সপ্তাহে ঢাকা জেলা শিক্ষা অফিস থেকে ৩৬ জন প্রধান শিক্ষকের পদ হারানোর বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালককে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে। এই ৩৬ জনের মধ্যে পদত্যাগ করেছেন আটজন, পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন ২০ জন, পলাতক তিনজন, বাধ্যতামূলক ছুটিতে তিনজন, অপসারিত হয়েছেন একজন এবং আন্দোলনের মুখে বাসভবন ছেড়ে পালিয়েছেন একজন। 

ঢাকা জেলা শিক্ষা অফিস জানায়, এখন পর্যন্ত ৩০ জনের বেশি প্রধান শিক্ষকের তথ্য আছে। মাউশিকে বিস্তারিত জানিয়েছি। প্রতিষ্ঠানের প্রধান না থাকা বিদ্যালয়গুলোতে একাডেমিক কার্যক্রমে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। সহকারী প্রধান শিক্ষকরা চালিয়ে নিচ্ছেন। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পদত্যাগ করা অধ্যক্ষ ও প্রধান শিক্ষকরা হলেন– রাজধানীর খিলগাঁও গভর্নমেন্ট স্টাফ কোয়ার্টার হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক সরদার মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন, বনানী মডেল স্কুলের প্রধান শিক্ষক কাজী শফিকুল ইসলাম, বিসিএসআইআর স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রধান শিক্ষক ভুয়া ডক্টরেট ড. মো. ইদ্রিস আলী, রামপুরা একরামুন্নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হোসনে আরা, নবাবগঞ্জ সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মুহাম্মদ আবদুল মান্নান, ঢাকা কটর মিল আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. নুরুল ইসলাম, শ্যামপুর ভাষাপ্রদীপ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. ইশারত আলী এবং দোহারের জয়পাড়া সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এ এস এম আবদুল খালেক।

পদত্যাগ করতে বাধ্য করা অধ্যক্ষ ও প্রধান শিক্ষকরা হলেন– গুলশান মডেল হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ এম মুস্তফা জামান মিয়া, সিদ্ধেশ্বরী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের সিনিয়র সহকারী শিক্ষক জোহরা জবীন, মিরপুর নাজনীন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মো. নুরুল ইসলাম, ধামরাই ওদুদুর রহমান উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আবদুর রাজ্জাক, কেরানীগঞ্জ কলাতিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কামরুজ্জামান জামাল, লালবাগ সালেহা উচ্চ বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ মো. নজরুল ইসলাম, কোতোয়ালি থানার আনোয়ারা বেগম মুসলিম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এবং কলেজের অধ্যক্ষ আবদুর রশীদ মোড়ল, একই প্রতিষ্ঠানের সহকারী প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ কামরুল হাসান মুন্সী, ধামরাই সূয়াপুর নান্নার স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ আনোয়ার ইসলাম তালুকদার, এই একই থাকার বাড়িগাঁও কৈলাশ চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. ফরহাদ হোসেন, কোতোয়ালি থানার আনন্দময়ী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাজমা বেগম, মিরপুর নিউ মডেল বহুমুখী হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক আ স ম ফিরোজ, লেক সার্কাস উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোস্তফা কামাল, লালবাগ থানার রায়েরবাজার উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মেহেরুন্নেসা, নতুন জুরাইন কে এম মাঈনুদ্দীন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শেখ মো. আবদুল হাই, বনানী মডেল স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম, শ্যামপুর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. শফিকুল ইসলাম, শ্যামপুরের বর্ণমালা আদর্শ স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী প্রধান শিক্ষক খান নাসির উদ্দিন, ডেমরার অগ্রদূত বিদ্যানিকেতন হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক তালুকদার আবদুল মন্নাফ এবং কেরানীগঞ্জের আগানগর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তোফাজ্জল হোসেন।

 অপসারণ করা হয়েছে লালবাগের আহমেদ বাওয়ানী একাডেমী স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মোশাররফ হোসেন মুন্সী, বরখাস্ত হয়েছেন ডেমরার মানিকনগর মডেল হাই স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মোসা. ফেরদৌসী ইয়াসমিন এবং ছয় মাসের বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়েছে ডেমরার মান্নান হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. শফিকুল ইসলাম ও মিরপুর মডেল একাডেমির প্রধান শিক্ষক শুভাশীষ কুমার বিশ্বাসকে। আর শিক্ষক-শিক্ষার্থীর আন্দোলনের মুখে বাসভবন থেকে পালিয়ে গেছেন বাড্ডা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের প্রধান শিক্ষক আবদুল্লাহ আল মামুন। সরকারি নথিতে এই প্রধান শিক্ষকেক ‘পলাতক’ দোখানো হয়েছে।
এ ছাড়া দোহারের আয়েশা বেগম পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে ‘খুঁজে যাওয়া যাচ্ছে না’ ।  তেজগাঁও আদর্শ স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ আবদুল মান্নানকেও অপদস্ত করা হয়েছে। তিনিও প্রতিষ্ঠানে যান না। 

আহমেদ বাওয়ানী একাডেমী স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মোশাররফ হোসেন মুন্সীকে অপসারণ করা হয় গত ১৯ আগস্ট। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে পদত্যাগ দাবিতে ৬ আগস্ট থেকে ছাত্ররা আন্দোলন করে এলেও পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন অধ্যক্ষ মোশাররফ।

সিদ্ধেশ্বরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা প্রতিষ্ঠানের সহকারী প্রধান শিক্ষক দেলোয়ার হোসেনের পদত্যাগের দাবিতে ১৯ আগস্ট শান্তিনগর মোড়ে বিক্ষোভ করেন। 
খিলগাঁও গভ. স্টাফ কোয়ার্টার হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ করেছেন একই বিদ্যালয়ের এক শিক্ষিকা। এ ঘটনায় খিলগাঁও থানায় মামলাও হয়েছে।

সায়েন্স ল্যাবরেটরি পরিচালিত বিসিএসআইআর স্কুল ও কলেজের প্রধান শিক্ষক মো. ইদ্রিস আলীকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন শিক্ষকরা। অনিয়ম, নিয়োগ-বাণিজ্য ও দুর্নীতির অভিযোগ এনে অনতিবিলম্বে তাঁর পদত্যাগ দাবি করেন তারা। 

বিক্ষোভ হয়েছিল রামপুরা থানার একমাত্র গার্লস স্কুল একরামুন্নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়েও। প্রধান শিক্ষক হোসনে আরার পদত্যাগ দাবিতে বিটিভি ভবনের সামনে সড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। অভিযোগ রয়েছে, হোসনে আরা একাডেমিক ভবনের পঞ্চম তলায় ১ হাজার ৬০০ বর্গফুটের বিলাসবহুল ফ্ল্যাট নির্মাণ করে বসবাস করতেন, যা অনৈতিক ও নিয়মবহির্ভূত। 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আবারো ভর্তি পরীক্ষা চালু হবে - dainik shiksha জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আবারো ভর্তি পরীক্ষা চালু হবে সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি: দুই দিনে আবেদন প্রায় দুই লাখ - dainik shiksha সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি: দুই দিনে আবেদন প্রায় দুই লাখ শিক্ষক নিয়োগেও নামকাওয়াস্তে মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা হয়: গণশিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha শিক্ষক নিয়োগেও নামকাওয়াস্তে মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা হয়: গণশিক্ষা উপদেষ্টা পাঠ্যপুস্তক থেকে শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার বিষয়বস্তু অপসারণের দাবি - dainik shiksha পাঠ্যপুস্তক থেকে শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার বিষয়বস্তু অপসারণের দাবি এসএসসির ফরম পূরণ শুরু ১ ডিসেম্বর - dainik shiksha এসএসসির ফরম পূরণ শুরু ১ ডিসেম্বর কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের গল্প - dainik shiksha পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের গল্প কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক পাঠ্যপুস্তকে একক অবদান তুলে ধরা থেকে সরে আসার আহ্বান হাসনাতের - dainik shiksha পাঠ্যপুস্তকে একক অবদান তুলে ধরা থেকে সরে আসার আহ্বান হাসনাতের ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ - dainik shiksha ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0026941299438477