স্কুল সংস্কার কাজ না করেই ভুয়া বিল-ভাউচারে টাকা উত্তোলন

রংপুর প্রতিনিধি |

রংপুর শহর থেকে একটু নিভৃতে মনোরম পরিবেশে দেওয়ান টুলি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পাঠদানের জন্য তৈরি করা হয়েছে একটি নতুন ভবন। আর পুরোনো ভবনটি মেরামতের জন্য চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির (পিইডিপি-৪) আওতায় বরাদ্দ দেয়া হয়েছে দুই লাখ টাকা। কিন্তু পুরোনো ভবনটি মেরামত না করেই নতুন ভবনের গ্রিল নির্মাণ, ভেতরের সজ্জিতকরণ দেখিয়ে তুলে নেয়া হয়েছে সেই টাকা।  

কাজ না করে টাকা কীভাবে তুলে নেয়া হয়েছে জানতে চাইলে ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রাবেয়া খাতুন বলেন, ‘অফিশিয়াল সিস্টেম অনুযায়ী আগে বিল ভাউচার জমা দিয়েছি। ইঞ্জিনিয়ারের দেয়া এস্টিমেট অনুযায়ী এই বিল-ভাউচার তৈরি করেছি। বিল-ভাউচার জমা না দিলে তো ট্রেজারি থেকে টাকা ছাড় দেয় না। কাজ করিনি, এখন করব।’

রংপুর নগরীর প্রাণকেন্দ্রে গুপ্তপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কেও মেরামতের জন্য দুই লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। কিন্তু গতকাল পর্যন্ত বিদ্যালয়টিতে কোনো কাজ করা হয়নি। পলেস্তারা খসে পড়া ভবনে চলছে পাঠদান। যদিও বরাদ্দের টাকা পেতে এরই মধ্যে বিল-ভাউচার জমা দেয়া হয়ে গেছে।

জানতে চাইলে ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফরহাদ জাহান বলেন, ‘বিল-ভাউচার ও এস্টিমেট জমা দিয়েছি। টাকা বা চেক—কোনো কিছুই পাইনি। টাকা পেলে জুলাইয়ের মধ্যে কাজ শেষ করব।’

কেবল রংপুর সদরের ওই দুটি বিদ্যালয় নয়; ২০২২-২৩ অর্থবছরে পিইডিপি-৪ এর আওতায় দ্বিতীয় ধাপে রংপুরের ৮টি উপজেলার ১৮০টি বিদ্যালয়ের বিপরীতে ৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হলেও অধিকাংশ বিদ্যালয়ে কোনো কাজ হয়নি। অথচ কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে দেখিয়ে বরাদ্দের টাকা লোপাটের জন্য ভুয়া ভাউচার জমা নেয়া হয়েছে। তুলে নেয়া হয়েছে টাকাও।

৯ থেকে ১০ জুলাই পর্যন্ত রংপুর সদরের মাহিগঞ্জ বালক, মাহিগঞ্জ বালিকা, তাজহাট, আশরতপুর, গঙ্গচড়ার লালচাঁদপুর, শালবাড়ি, পূর্ব খলেয়া উপরতলা, তারাগঞ্জের শেরমস্ত, মধুরামপুর, তেঁতুলতলা, দোয়ালীপাড়া, মানব মঙ্গলসহ ১৫টি বিদ্যালয় সরেজমিনে ঘুরে একই চিত্র পাওয়া গেছে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের প্রায় অভিন্ন কথা—কাজ করিনি, এখন করব। টাকা মেরে খাব না।

শিক্ষক ও উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসগুলোর কর্মকর্তারা জানান, টাকা উত্তোলন করা না হলে তা সরকারি কোষাগারে ফেরত যেত। তাই বরাদ্দের টাকা উত্তোলন করে শিক্ষা কর্মকর্তাদের ব্যাংক হিসাব নম্বরে রাখা হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের উচ্চমান সহকারী (বড় বাবু) লিটন মিয়া বলেন, ‘পিইডিপি-৪ এর ২য় পর্যায়ের ৭৬ লাখ টাকা শিক্ষা কর্মকর্তার ব্যাংক হিসাবে আছে। কাজ করলে প্রত্যয়ন দেখে শিক্ষকদের ওই টাকা দেয়া হবে।’

সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আনোয়ারুল ইসলামের কার্যালয়ে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। গত সোমবার তাঁর মুঠোফোনে একাধিকবার কল ও খুদে বার্তা পাঠিয়েও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

গঙ্গাচড়া উপজেলার গঞ্জিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দেয়ালের রং উঠে গেছে। এর দেয়ালের বিভিন্ন জায়গায় খসে পড়ছে পলেস্তারা, টিনে ধরেছে মরিচা। কিন্তু বিদ্যালয়টি মেরামতের দুই লাখ টাকা উত্তোলন হলেও সেখানে কোনো কাজ করা হয়নি।

জানতে চাইলে ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রওশন আরা বেগম বলেন, ‘বিল-ভাউচার জমা দিয়েছি। টাকা এখনো পাইনি। কাজও করিনি। কাজ করব। স্যাররা দেখে টাকা দেবে।’

গঙ্গাচড়ার চকচকে-ঝকঝকে ধনতোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দুই লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হলেও সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, কোনো কাজ করা হয়নি। 

যোগাযোগ করা হলে গঙ্গাচড়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নাগমা সিলভিয়া মুঠোফোনে বলেন, ‘কোনো কাজ করা হয়নি। টাকা তুলে অফিশিয়াল সিস্টেমে রাখা হয়েছে। আমি অসুস্থ। ছুটিতে আছি। পরে কথা হবে।’

কাজ না করে টাকা তুলে নেয়ার বিষয়টি রংপুরের জেলা প্রশাসক ড. চিত্রলেখা নাজনীনের নজরে আনা হলে তিনি বলেন, কাজ না করে টাকা উত্তোলনের কোনো সুযোগ নেই। কর্মকর্তার হিসাবে টাকা রাখা অবৈধ। শিক্ষা কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখা হবে।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আবারো ভর্তি পরীক্ষা চালু হবে - dainik shiksha জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আবারো ভর্তি পরীক্ষা চালু হবে সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি: দুই দিনে আবেদন প্রায় দুই লাখ - dainik shiksha সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি: দুই দিনে আবেদন প্রায় দুই লাখ শিক্ষক নিয়োগেও নামকাওয়াস্তে মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা হয়: গণশিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha শিক্ষক নিয়োগেও নামকাওয়াস্তে মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা হয়: গণশিক্ষা উপদেষ্টা পাঠ্যপুস্তক থেকে শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার বিষয়বস্তু অপসারণের দাবি - dainik shiksha পাঠ্যপুস্তক থেকে শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার বিষয়বস্তু অপসারণের দাবি এসএসসির ফরম পূরণ শুরু ১ ডিসেম্বর - dainik shiksha এসএসসির ফরম পূরণ শুরু ১ ডিসেম্বর কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের গল্প - dainik shiksha পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের গল্প কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক পাঠ্যপুস্তকে একক অবদান তুলে ধরা থেকে সরে আসার আহ্বান হাসনাতের - dainik shiksha পাঠ্যপুস্তকে একক অবদান তুলে ধরা থেকে সরে আসার আহ্বান হাসনাতের ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ - dainik shiksha ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0030050277709961