শিক্ষার মান উন্নয়নে শিক্ষায়তনিক গ্রন্থাগারের গুরুত্ব অনস্বীকার্য বিধায় ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ডঃ কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্টে গ্রন্থাগারকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হৃদপিণ্ড হিসেবে উল্লেখ করে দেশের প্রতিটি বিদ্যালয়ে গ্রন্থাগার স্থাপনের সুপারিশ করা হয়। শিক্ষায়তনিক গ্রন্থাগারে কর্মরত গ্রন্থাগারিকদের গুরুত্ব বুঝাতে ভারতের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট ১৯৪৮-৪৯-এ উক্ত কমিশনের চেয়ারম্যান ডঃ রাধাকৃষ্ণনান (পরবর্তীতে ভারতের রাষ্ট্রপতি) বলেছেন “the librarian is the teacher of teachers”। শিক্ষাক্ষেত্রে গ্রন্থাগার ও গ্রন্থাগারিকতা পেশা গুরুত্বপুর্ণ বিধায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গ্রন্থাগারিকগণকে শিক্ষক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।
এদেশের গ্রন্থাগারিকগণও শিক্ষক হিসেবে স্বীকৃত ছিল তবে ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে জারীকৃত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চাকুরী বিধিমালায় বিদ্যালয়ের সহকারী গ্রন্থাগারিক পদটি কর্মচারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়। সেই সময় থেকেই দেশের গ্রন্থাগারিকগণ শিক্ষক মর্যাদার দাবী জানাতে থাকে এবং ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বাংলাদেশ গ্রন্থাগারিক ও তথ্যায়নবিদ সমিতি (বেলিড), বাংলাদেশ বিদ্যালয় গ্রন্থাগার সমিতি ও অন্যান্য সহযোগী সংগঠন দাবি আদায়ে শিক্ষামন্ত্রী-উপমন্ত্রী, সচিব, অতিরিক্ত সচিবদের সঙ্গে সাক্ষাত করে আবেদন, সভা, সেমিনার, টকশো ও লেখালেখি এমনকি রাজপথেও নামেন। অতঃপর শিক্ষা মন্ত্রণালয় গত ২৮ মার্চ বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (স্কুল ও কলেজ) জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা ২০২১-এ সহকারী গ্রন্থাগারিক পদটির নতুন নামকরণ করা হয় ‘সহকারী শিক্ষক’ (গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান)।
এ পদটির নতুন নামকরণে অনেকের মনেই প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক (গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান)-র পেশাগত দায়িত্ব ও কর্তব্য কি হবে? তারা কি শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করবেন নাকি গ্রন্থাগার সেবার মাধ্যমে শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করবেন। যদি শ্রেণী কক্ষে পাঠদান করতে হয় তবে তাদের সিলেবাস ও পাঠ্য পুস্তক কি হবে? বিদ্যালয় গ্রন্থাগারটিই বা পরিচালনা করবে কে? এসব প্রশ্নের উত্তর হলো সহকারী শিক্ষক (গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান) নিজ বিদ্যালয় গ্রন্থাগারে তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করবেন। তিনি সর্বদা শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও জ্ঞানচর্চায় সহায়তা ও নির্দেশনা দেবেন অর্থাৎ শিক্ষাদান করবেন। এ প্রেক্ষিতে সহকারী শিক্ষক (গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান)-এর দায়িত্ব ও কর্তব্য দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারেঃ (ক) গ্রন্থাগার পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা ও (খ) শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা। এসব কার্যক্রমে অন্তর্ভূক্ত বিষয়গুলো সহকারী শিক্ষক (গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান)-গণ নিম্নোক্তভাবে সম্পাদন করবেন।
(ক) গ্রন্থাগার পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনাঃ
যেহেতু শিক্ষায়তনিক গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠানের জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রবিন্দু তাই গ্রন্থাগারকে তথ্যসামগ্রী সমৃদ্ধ ও জ্ঞানচর্চার উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। এজন্য গ্রন্থাগারের জন্য পৃথক কক্ষ, পাঠের প্রয়োজনীয় উপকরণ, জ্ঞানচর্চার পরিবেশ ও পৃথক গ্রন্থাগার বাজেট থাকতে হবে। শিক্ষার্থীদের নিকট থেকে প্রাপ্ত গ্রন্থাগার ফি শুধু গ্রন্থাগার উন্নয়নেই ব্যয় করতে হবে। গ্রন্থাগারের সার্বিক উন্নয়নে সহকারী শিক্ষক (গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান)-গণ নিজেদের আত্মনিয়োগ করবেন। তাঁরা গ্রন্থাগারের সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও নিম্নোক্ত দৈনন্দিন কার্যক্রম গ্রন্থাগারে সম্পাদন করবেন।
১। গ্রন্থাগারের সার্বিক পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা।
২। গ্রন্থাগারের তথ্যসামগ্রী সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিতরণ।
৩। গ্রন্থাগারের পাঠক সেবা নিশ্চিতকরণ।
(খ) শিক্ষা কার্যক্রমঃ
শিক্ষার্থীদের মানবিক বিকাশ, সুচিন্তক ও সুনাগরিক হিসেবে স্বীয় মেধা ও মননকে মানব কল্যাণে নিয়োজিত করার প্রায়োগিক শিক্ষা ও জ্ঞান -সন্ধানী মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে জ্ঞানচর্চা নির্ভর সহশিক্ষার কোন বিকল্প নেই। এসব সহশিক্ষা শিক্ষার্থীদেরকে ধারাবাহিক ভাবে দিতে হবে কারণ খণ্ডিতভাবে দেয়া হলে এ শিক্ষা তেমন ফলপ্রসূ হয় না। তবে গ্রন্থাগারে শিক্ষার্থীদের গ্রন্থপাঠের অভ্যাস ছাড়াও জ্ঞানচর্চা নির্ভর অন্যান্য সহশিক্ষা কার্যক্রম শেণি রুটিনে অন্তর্ভূক্ত করে দৈনন্দিন ধারাবাহিকভাবে শিক্ষাদান করলে কার্যকর ফল পাওয়া যেতে পারে। এ লক্ষ্যে সহকারী শিক্ষক (গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান)-গণ শিক্ষার্থীদের জ্ঞানচর্চা নির্ভর নিম্নোক্ত সহশিক্ষা কার্যক্রম শেণী রুটিন অনুযায়ী সম্পাদন করবেন।
১। শিক্ষার্থীদের গ্রন্থপাঠে আগ্রহী করতে পাঠচক্র ও গ্রন্থপাঠের আয়োজন ও পরিচালনা।
২। শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতর্ক, উপস্থিত বক্তৃতা, স্বরচিত গল্প বলা, রচনা ও কুইজের আয়োজন ও পরিচালনা।
৩। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের তথ্য স্বাক্ষরতা বিষয়ক ক্লাসের আয়োজন ও পরিচালনা।
৪। অন্যান্য সাংস্কৃতিক কার্যক্রম আয়োজন ও পরিচালনা।
শ্রেণী রুটিনে গ্রন্থাগার ক্লাসঃ
গ্রন্থাগারে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও জ্ঞানচর্চার উৎকর্ষ সাধনে সর্বদা প্রয়োজন একাগ্রতা ও সুশৃঙ্খল ধারাবাহিক প্রচেষ্টা। একাগ্রতাহীন খণ্ডিত প্রচেষ্টা জ্ঞানের বিকাশে মোটেও সহায়ক নয়। যেহেতু শ্রেণিরুটিন বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে ধারাবাহিকভাবে দৈনন্দিন শিক্ষার সুশৃঙ্খল নকশা তাই গ্রন্থাগারকেন্দ্রিক শিক্ষা, সংস্কৃতি ও জ্ঞানচর্চার কার্যক্রমও শেণিরুটিনে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে ধারাবাহিক ও সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা করা উচিৎ। শেণিরুটিনে গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান ক্লাস নিম্নোক্তভাবে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
সপ্তাহের ১ম দিনঃ মণীষীদের জীবনী, নৈতিক শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি বিষয়ের একটি গ্রন্থ বা এর অংশ বিশেষ পাঠান্তে শিক্ষণীয় দিক নিয়ে আলোচনা ও মূল্যায়ন।
সপ্তাহের ২য় দিনঃ শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতর্কের আয়োজন।
সপ্তাহের ৩য় দিনঃ শিক্ষার্থীদের মাঝে উপস্থিত বক্তৃতার আয়োজন।
সপ্তাহের ৪র্থ দিনঃ শিক্ষার্থীদের মাঝে স্বরচিত রচনা ও গল্প বলার আয়োজন।
সপ্তাহের ৫ম দিনঃ শিক্ষার্থীদের গ্রন্থাগারে বসে ক্লাসের পাঠ্য বই ব্যতীত অন্য শিক্ষামূলক বই পড়া।
সপ্তাহের ৬ষ্ঠ দিনঃ শিক্ষার্থীদের মাঝে সাধারণ জ্ঞানের কুইজের আয়োজন। এছাড়াও গ্রন্থাগারে আগত পাঠকদের তথ্যসামগ্রী সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের জন্য তথ্য স্বাক্ষরতার নিয়মিত ক্লাস পরিচালনা করা যেতে পারে।
প্রতিটি বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শ্রেণিরুটিনে গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান ক্লাসের জন্য সপ্তাহে একদিন অর্ধবেলা বরাদ্দ রাখবেন। সহকারী শিক্ষক (গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান)-গণ উপরোক্ত ক্লাসগুলো চক্রাকারে সবশ্রেণির শিক্ষার্থীদেরকে বন্টন করবেন। এসব ক্লাসের প্রাপ্ত নম্বর শিক্ষার্থীর পরীক্ষার নম্বরপত্রে গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান বিষয় হিসেবে উল্লেখ থাকবে।
গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান বিষয়ে মান বন্টনঃ
শিক্ষার মান নির্ধারণে মূল্যায়ন প্রয়োজন। তাই শিক্ষার্থীদের সহশিক্ষার কার্যক্রম যথাযথ মূল্যায়ন পূর্বক মান নির্ধারিত হলে তারা বিষয়ের গভীরতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করবে এবং নিজেরদেরকে এবিষয়ে অধিক মনোনিবেশ করবে। এক্ষেত্রে অন্যান্য বিষয়ের সাথে সামঞ্জস্যতা রেখে গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান বিষয়ে ৫০ নম্বরের সার্বিক মান নির্ধারণ এবং নিম্নোক্তভাবে কার্যক্রম ভিত্তিক মানবন্টন করা যেতে পারে।
১০ নম্বরঃ শ্রেণিকক্ষে গ্রন্থ বা এর অংশ বিশেষ পাঠান্তে শিক্ষার্থীদের শিক্ষণীয় দিক নিয়ে আলোচনা ও মূল্যায়ন।
১৫ নম্বরঃ গ্রন্থাগারে বসে অথবা নিজ গৃহে ক্লাসের পাঠ্য বই ব্যতীত অন্য শিক্ষামূলক বই পাঠ।
২৫ নম্বরঃ বিতর্ক, উপস্থিত বক্তৃতা, স্বরচিত রচনা, গল্প বলা এবং সাধারণ জ্ঞান কুইজ।
উপরোক্ত সহশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় প্রচলিত একক পাঠ্য বইয়ের প্রয়োজন নাই তবে একটি গাইড লাইন থাকা বাঞ্ছনীয়। সেই গাইডলাইন অনুসারে গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান বিষয়ের ক্লাস হিসেবে সহশিক্ষা কার্যক্রম গুলো একত্রে শেণিরুটিনে অন্তর্ভূক্ত ও মূল্যায়নপূর্বক পরীক্ষার নম্বরপত্রে উল্লেখ করা হলে শিক্ষার্থীরা জ্ঞানচর্চা নির্ভর সহশিক্ষার প্রতি মনযোগী হবে এবং তাদের মেধার বিকাশ ও মানবিক গুণসম্পন্ন সুনাগরিক হিসেবে বেড়ে উঠতে সহায়ক হবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ গ্রন্থাগারে জ্ঞানচর্চা ভিত্তিক গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান ক্লাসের উপরোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনা করলে বিদ্যালয়ে গ্রন্থাগার সৃষ্টির সুফল পাওয়া যেতে পারে। দেশের সব প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম হোক গ্রন্থাগারকেন্দ্রিক ও মানসম্পন্ন। শিক্ষার্থীদের কমল মনে বিকশিত হোক মানব কল্যাণ, জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত হোক সমগ্র মানব জাতি।
লেখক : ডঃ মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান, আহ্বায়ক, বাংলাদেশ সম্মিলিত গ্রন্থাগার পেশাজীবী জোট এবং সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা ও তথ্যবিজ্ঞান বিভাগ, রয়্যাল ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা।