একসময় মামা চাচার-পরিচয় ও ঘুষের টাকার দাপটে শিক্ষক পদে নিয়োগ হতো অহরহ। মুখে মুখে প্রচলিত হয়ে গিয়েছিলো, কোনো চাকরি করতে না পারলে শিক্ষক হ। ভাতিজা-ভাগিনাদের চাকরি দিতে ধনী মামা-চাচাদের স্কুল-কলেজ স্থাপনের নজিরও আছে। ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দের আগে প্রাক-যোগ্যতা যাচাইয়েরও কোনো নিয়ম ছিলো না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শুধুই নিয়মরক্ষার অথবা সাজানো নিয়োগ পরীক্ষা ছিলো। নূন্যতম প্রাক যোগ্যতা যাচাইয়ে ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা চালু করে সরকার। গঠন করা হয় বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ)। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা এ যুগান্তকারী পরিপত্রে এনটিআরসিএকে দায়িত্ব দেয়া হয় শিক্ষক পদে নিয়োগের জন্য প্রার্থী বাছাইয়েরও। সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলছেন, সেই থেকে স্বচ্ছ পদ্ধতিতে শিক্ষক নিয়োগের সূচনা। এখন পর্যন্ত ১ লাখ ১২ হাজার ৪৭৫ জন শিক্ষককে স্বচ্ছ পদ্ধতিতে নিয়োগ সুপারিশ করেছে এনটিআরসিএ।
কর্মকর্তারা দৈনিক আমাদের বার্তাকে জানান, ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম নিয়োগ চক্রে বিভিন্ন বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ সুপারিশের প্রক্রিয়া শুরু হয় প্রথমবারের মতো। সেবার ১৩ হাজার ৬৬৭ জন শিক্ষককে ডিজিটাল পদ্ধতিতে নিয়োগ সুপারিশ করে এনটিআরসিএ। ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয় নিয়োগ চক্রে ৩১ হাজার ৬৬৫ জনকে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ সুপারিশ করা হয়। ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে তৃতীয় নিয়োগ চক্রে আরো ৩৫ হাজার ১০০ জনকে নিয়োগ সুপারিশ করা হয়। ওই বছরই তৃতীয় চক্রের পূরণ না হওয়া পদে বিশেষ গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে ৩ হাজার ৮১৯ জনকে শিক্ষক পদে নিয়োগ সুপারিশ করা হয়।
আর বিভিন্ন সাধারণ ধারার স্কুল ও মাদরাসায় ভোকেশনাল কোর্স চালু করতে সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রামের (সেসিপ) চাহিদার প্রেক্ষিতে ১ হাজার ১৫০ জন ট্রেড ইনসট্রাক্টরকে নিয়োগ সুপারিশ করা হয়। চতুর্থ নিয়োগ চক্রে ২৭ হাজার ৭৪ জন শিক্ষককে নিয়োগ সুপারিশ করা হয়। এ অবধি মোট ১ লাখ ১২ হাজার ৪৭৫ জন নিবন্ধিত প্রার্থীকে শিক্ষক পদে নিয়োগ সুপারিশ করা হয়েছে।
এনটিআরসিএর শীর্ষ কর্তারা বলছেন, সম্পূর্ণ অটোমেশন পদ্ধতিতে প্রার্থী বাছাই করা হয় তাই এ নিয়োগ সুপারিশ হয় স্বচ্ছ পদ্ধতিতে। যখন কম্পিউটার প্রার্থী নির্বাচন করে তখন প্রথমে প্রার্থী এসএমএস পান তিনি নিয়োগ সুপারিশের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন, এনটিআরসিএ জানতে পারে তার পরে। অটোমেশন পদ্ধতি এমনভাবে সাজানো যাতে বাইরে থেকে কোনো প্রার্থীকে নির্বাচন বা বাদ দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। স্বচ্ছ পদ্ধতিতে শিক্ষক নিয়োগের মাধ্যমে শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে, বেকারত্বও দূর হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনটিআরসিএর এক সাবেক শীর্ষ কর্তা দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, স্বচ্ছ পদ্ধতিতে শিক্ষক নিয়োগ নিশ্চিত হয়েছে এনটিআরসিএর মাধ্যমে। আমার কর্মকালে শিক্ষক নিয়োগ সুপারিশ নিয়ে বহু তদবির এসেছে। এতো উচ্চপর্যায় থেকে তদবির এসেছে যা এড়ানো সম্ভব ছিলো না। কিন্তু এনটিআরসিএ যে প্রক্রিয়ায় নিয়োগ সুপারিশ করে তাতে হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই। সৃষ্টিকর্তা ও এনটিআরসিএর প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়াকে ধন্যবাদ কারণ এর দোহাই দিয়ে যতো উচ্চ পর্যায়ের তদবিরই আসুক না কেনো তা এড়াতে পেরেছি।
শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির মতে, মাধ্যমিক ও তদুর্ধ্ব পর্যায়ে শতকরা ৭০ ভাগ শিক্ষার্থী বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করেন। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষকদের শতকরা নব্বই ভাগই বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগ নিশ্চিত না করা গেলে দেশে শিক্ষার প্রসার ঘটলেও সার্বিক শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে এনটিআরসিএ নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে। সম্পূর্ণ মেধার ভিত্তিতে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে প্রবেশ পর্যায়ে মানসম্মত যোগ্য এবং চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সক্ষম শিক্ষক নিয়োগ সুপারিশের মাধ্যমে এনটিআরসিএ বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকের অভাব পূরণ করছে।
দৈনিক শিক্ষা ডটকমের ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।