স্মার্ট কার্ড সেবা না থাকলেও রাবি শিক্ষার্থীদের থেকে টাকা আদায়

রাবি প্রতিনিধি |

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত ও আধুনিক সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার লক্ষ্যে স্মার্ট আইডি কার্ড দেওয়া হয়। তবে উপযুক্ত অবকাঠামো গড়ে না তোলায় আধুনিক এ কার্ড শিক্ষার্থীদের কোনো কাজেই আসছে না। তাই আধুনিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তারা। যদিও স্মার্ট কার্ড বাবদ গত ছয় বছরে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে দেড় কোটি টাকার ফি আদায় করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়কে ডিজিটালাইজেশনের আওতায় আনতে দেশের প্রথম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে স্মার্ট আইডি কার্ড চালু করেন তৎকালীন উপাচার্য প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ মিজানউদ্দিন। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল, ইন্টারনেট সার্ভিস, পেমেন্ট সিস্টেম, মেডিকেল কার্ড ও লাইব্রেরি কার্ড, বাস কার্ডসহ ২৮টি সেক্টরে এ কার্ডের ব্যবহার নিশ্চিত করার কথা ছিল। ফলে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ভর্তির সময় স্মার্ট কার্ড বাবদ অতিরিক্ত ৪০০ টাকা ফি নেওয়া হয়।

কার্ডে শিক্ষার্থীদের নাম, নিবন্ধন নম্বর, আইডি কোড, ছবি, বিভাগ, হল কোড, বর্ষ ব্যক্তিগত সব তথ্য সংরক্ষণ করা হয়। এ কার্ড ব্যবহার করে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার নম্বরপত্র ও সনদপত্র তোলা, গ্রন্থাগার, বিভাগ, ইনস্টিটিউট, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের অফিস, হল অফিস এবং নিরাপত্তাবিষয়ক বিভিন্ন কাজ করার সুযোগ পাবেন বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে জানানো হয়।

তবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, এসব সুযোগ-সুবিধার কোনোটিই নিশ্চিত করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রে ও ফরম-ফিলাপের সময় ছাড়া আর কোনো কাজে আসছে না স্মার্ট কার্ড। একাডেমিক ভবনগুলোতে স্মার্ট কার্ডের ব্যবহার থাকলে ক্লাসের উপস্থিতি নিয়ে বিপাকে পড়তে হতো না শিক্ষার্থীদের। কর্মকর্তারাও অফিসে নিয়মিত উপস্থিত থাকার বিষয়ে সচেতন থাকতেন। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সেবা দিতে না পারলে কার্ডের জন্য অতিরিক্ত ৪০০ টাকা ফি কেন নিচ্ছে প্রশাসন এমনটাই প্রশ্ন শিক্ষার্থীদের?

উপযুক্ত সেবা না দিয়ে স্মার্ট কার্ড বাবদ অতিরিক্ত ৪০০ টাকা নেওয়া নৈতিকতা বিরোধী জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সালেহ হাসান নকীব বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কাগজ-কলমে পরিকল্পনা নেওয়া হয় ঠিকই কিন্তু তা বাস্তবায়নে যে উদ্যোগ প্রয়োজন তা নেওয়া হয় না। একাডেমিক, আবাসিক হল, লাইব্রেরি, গবেষণা, ব্যাংক অ্যাকাউন্টসহ যাবতীয় কাজে শিক্ষার্থীরা স্মার্ট কার্ড ব্যবহার করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় এমন পরিকল্পনা হাতে নিলেও তা বাস্তবায়ন হয় না।

এ অধ্যাপক আরও বলেন, যেসব সুযোগ সুবিধার কথা বলে স্মার্ট কার্ড বাবদ অতিরিক্ত ফি নেওয়া হচ্ছে তা আসলে অনৈতিক ও নৈতিকতা বিরোধী কাজ। উপযুক্ত সেবা না দিয়ে ছয় বছর ধরে অতিরিক্ত ফি নেওয়ার কোনো অর্থই হয় না।

স্মার্ট কার্ড বাবদ অতিরিক্ত ফি দিয়েও কাঙ্ক্ষিত সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে না জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী সম্পদ সাহা বলেন, এ কার্ডের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৮টি সেক্টরে সেবা পাওয়ার কথা থাকলেও দৃশ্যমান দু-তিনটি (মেডিকেল ট্রিটমেন্ট, পরীক্ষার ফরম ফিল-আপ) সুবিধা ছাড়া আর কোনো সেক্টরেই আমরা সেবা পাচ্ছি না। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্মার্টকার্ডের ব্যবহার নিশ্চিত হলে ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের উৎপাত, ছিনতাইসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ জিরো টলারেন্সে নেমে আসতো।

সরেজমিন দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের প্রবেশ, প্রশাসন ভবন, বই ইস্যুসহ, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোয়, জিমনেশিয়াম, বাস কার্ড, ইন্টারনেট সার্ভিসসহ কোথাও কার্ডের ব্যবহার নেই। এখনো হলগুলোতে এনালগ কার্ডের মাধ্যমে সেবা দেওয়া হচ্ছে।

এদিকে টাকা দিয়েও সঠিক সময়ে স্মার্ট কার্ড পায়নি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২১-২২ সেশনের শিক্ষার্থীরা। আশিকুর রহমান নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, আমি ভর্তির সময় স্মার্ট কার্ডের জন্য ৪০০ টাকা দিয়েছি। কিন্তু এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে আমাকে কার্ড দেওয়া হয়নি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ভবন সূত্রে জানা যায়, স্মার্ট কার্ড বাবদ ২০১৬-১৭ সেশনের ৪ হাজার ১৪৫ শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ৪০০ টাকা করে প্রায় ১৬ লাখ ৫৮ হাজার টাকা আদায় করা হয়। ২০১৭-১৮ সেশনের ৪১ হাজার ১৯ শিক্ষার্থীর কাছ থেকে প্রায় ১৬ লাখ ৪৭হাজার ৬০০ টাকা, ২০১৮-১৯ সেশনের ৪ হাজার ১৭৩ শিক্ষার্থীর কাছ থেকে প্রায় ১৬ লাখ ৬৯ হাজার ২০০ টাকা, ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে ৪ হাজার ১৫১ শিক্ষার্থীর কাছ থেকে প্রায় ১৬ লাখ ৬০ হাজার ৪০০ টাকা, ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে ৪ হাজার ১৭৩ শিক্ষার্থীর কাছ থেকে প্রায় লাখ ১৬ হাজার ৬৯ হাজার ২০০ টাকা এবং সর্বশেষ ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে ৪ হাজার ২০ শিক্ষার্থীর কাছ থেকে প্রায় ১৬ লাখ ৮ হাজার টাকা আদায় করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

অন্যদিকে প্রায় ২ হাজার শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী কাছ থেকে ৮ লাখ টাকা আদায় করা হয়। এছাড়াও বিদেশি শিক্ষার্থী, এমফিল করা শিক্ষার্থীসহ সব মিলিয়ে ছয় বছরে স্মার্ট কার্ড বাবদ প্রায় দেড় কোটি টাকার মতো আদায় করা হয়।

সমাজকর্ম বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মেহেদী সজীব বলেন, স্মার্ট কার্ড ব্যবহার করে রাবি মেডিকেল থেকে ওষুধ আনা, ভর্তির ফি জমা নেওয়া ব্যতীত আর কোনো কাজেই লাগে না। স্মার্ট কার্ডের প্রদত্ত সেবা দিতে না পারলে ভর্তির সময় ৪০০ টাকা অতিরিক্ত নেওয়াটা ভিত্তিহীন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারকদের উচিত হবে, হয় স্মার্ট কার্ডের সবগুলো সেবা দেওয়া, না-হয় অতিরিক্ত টাকা নেওয়া বন্ধ করা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মার্ট কার্ডের সঙ্গে তুলনা করে সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ড. গোলাম কিবরিয়া ফেরদৌস  বলেন, শিক্ষক হিসেবে আমারও স্মার্ট কার্ড আছে। তবে মেডিকেল সেন্টার ও সিনেট ভবনে শিক্ষা পরিষদের মিটিংয়ে প্রবেশ করতে এ কার্ডের ব্যবহার চোখে পড়ে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদে লিফট থেকে শুরু করে টয়লেট ব্যবহারসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই স্মার্টকার্ডের ওপর নির্ভরশীল। কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, জিমনেশিয়াম ও গুরুত্বপূর্ণ ভবনগুলোসহ প্রবেশ গেটগুলোকে যদি স্মার্টকার্ডের আওতায় আনা যায় তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিরাগত উৎপাত কমে যাবে এবং ছাত্রছাত্রীরা নিরাপত্তার সঙ্গে ক্যাম্পাসে অবস্থান করতে পারবে।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. খাদেমুল ইসলাম মোল্লা  বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ক্ষেত্রে স্মার্টকার্ডের ব্যবহার বাস্তবায়নের জন্য আমরা উদ্যোগ নিয়েছিলাম। কিন্তু সবক্ষেত্রে বাস্তবায়ন এখনো সম্ভব হয়নি। মাঝে তিন বছর আমি দায়িত্বে ছিলাম না। তবে এখন থেকে আবারো স্মার্টকার্ডের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে আমরা কাজ শুরু করেছি। বঙ্গমাতা হল ও কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে স্মার্টকার্ড ব্যবহারের সরঞ্জামাদি থাকলেও তা কেন কাজে আসছে না এ বিষয়ে আমরা ব্যবস্থা নেবো। সব সেক্টরে স্মার্ট কার্ডের ব্যবহার নিশ্চিত করতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কাজ করে যাচ্ছে।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
পেছালো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স ১ম বর্ষের পরীক্ষা - dainik shiksha পেছালো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স ১ম বর্ষের পরীক্ষা প্রশ্নফাঁসের মামলায় ১০ জনের কারাদণ্ড, খালাস ১১৪ - dainik shiksha প্রশ্নফাঁসের মামলায় ১০ জনের কারাদণ্ড, খালাস ১১৪ শিক্ষা ভবনের সেই বিপুলকে বদলি, গ্রেফতার চান এমপিও শিক্ষকরা - dainik shiksha শিক্ষা ভবনের সেই বিপুলকে বদলি, গ্রেফতার চান এমপিও শিক্ষকরা পলাতক ফাহিমার ক্যাশিয়ার কামালকে গ্রেফতারের দাবি - dainik shiksha পলাতক ফাহিমার ক্যাশিয়ার কামালকে গ্রেফতারের দাবি দীপু মনির ক্যাশিয়ার পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সচিব নাজমাকে বদলি - dainik shiksha দীপু মনির ক্যাশিয়ার পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সচিব নাজমাকে বদলি ঢাকা কলেজের নতুন অধ্যক্ষ অধ্যাপক ইলিয়াস - dainik shiksha ঢাকা কলেজের নতুন অধ্যক্ষ অধ্যাপক ইলিয়াস রাষ্ট্র পুনর্গঠনে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চাইলেন প্রধান উপদেষ্টা - dainik shiksha রাষ্ট্র পুনর্গঠনে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চাইলেন প্রধান উপদেষ্টা শিক্ষা কমিশন কেনো হলো না - dainik shiksha শিক্ষা কমিশন কেনো হলো না ১৫ এলাকায় ৬০ কিলোমিটার বেগে ঝড় হতে পারে - dainik shiksha ১৫ এলাকায় ৬০ কিলোমিটার বেগে ঝড় হতে পারে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বন্যায় ক্ষতির পরিমাণ ও সবুজায়নের তথ্য আহ্বান - dainik shiksha শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বন্যায় ক্ষতির পরিমাণ ও সবুজায়নের তথ্য আহ্বান please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0065791606903076