স্মার্ট বাংলাদেশে প্রয়োজন একটি স্মার্ট নির্বাচন

মাজহার মান্নান |

একটি অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহনমূলক নির্বাচন প্রশ্নে জল ঘোলা কম হয়নি। কিন্তু কোনোভাবেই যেন সমাধানের রাস্তা বের হতে চায় না। আমার প্রশ্ন সমাধানের পথ কি আটকে রাখা হয়? যদি তাই হয় তবে জনগণের স্বার্থে কি তারা রাজনীতি করেন? বিবেক কি তাদের দংশন করে না? নৈতিকতা কি তাদের রাজনৈতিক দর্শনে স্থান পায় না? বহু বছর ধরে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করা হচ্ছে। রক্তপাত আর হানাহানিও কম হয়নি। কিন্তু কেন কোনো সুফল পাওয়া যাচ্ছে না? সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দর্শন যেন আজ দাঙ্গায় পরিণত হতে চলেছে। কঠোর আন্দোলনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আনা হয়েছিলো সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য। 

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে কয়েকটি ভালো নির্বাচন জাতি উপহার পেয়েছে। কিন্তু এই ব্যবস্থাটিকেও রাজনৈতিক দলগুলো ধরে রাখতে পারলো না। কিন্তু এর দায় কোনো রাজনৈতিক দল নিতে নারাজ। একটি রাজনৈতিক দল রাজনীতি করে ক্ষমতায় যাওয়া এবং জনসেবা করার জন্য। এটি একটি স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু ক্ষমতার পালাবদলের কোনো শঙ্কা দেখা দিলে রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণ ভিন্ন রকম হয়ে যায়। তখন তারা আর জনগণের প্রতি আস্থা রাখতে চায় না। কিন্তু আমরা কেন ভুলে যাই যে দেশটিকে স্বাধীন করা হয়েছে একটি সুস্থ গণতান্ত্রিক ধারা বজায় রাখার জন্য। আর সঠিকভাবে গণতন্ত্রকে চালাতে হলে সঠিক নির্বাচন প্রয়োজন। নির্বাচন প্রশ্নে বৃহৎ দুটি রাজনৈতিক শিবির সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী অবস্থানে রয়েছে। কেউ কারও নাহি ছাড়ে। তাদের ভাবনা জনগণের সঙ্গে মিলে না। তারা ভাবে ছাড় দিতে গিয়ে যদি তাদের অস্তিত্ব নড়বড়ে হয়ে যায়! এজন্য তারা ছাড় দিতে নারাজ। তবে ২০১৮ খিষ্টাব্দের নির্বাচনে বিএনপি সংলাপে আস্থা রেখে নির্বাচনে গিয়েছিলো। কিন্তু সেই নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ। যার কারণে দ্বিতীয় বারের মতো বিএনপি আর আস্থা রাখতে চাইছে না। প্রতি পাঁচ বছর পর জাতীয় নির্বাচন আসে। ৫ বছরে একটি রাজনৈতিক দল বহু হিসেব নিকেষ করে। আর এই হিসাব যখন না মেলে তখনই তারা আন্দোলনের প্রস্তুতি নেয়। বিএনপি প্রায় ১৫ বছর ক্ষমতার বাইরে আছে। এমনকি বিরোধী দল হিসাবে সংসদে তাদের কোন শক্তিশালী অবস্থানও নেই। যে ৬ জন ছিল তারাও পদত্যাগ করেছে। বিরোধী শিবিরগুলো কঠোর আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে ফেলে দিতে চায়। পদত্যাগ করাতে বাধ্য করতে চায়। ক্ষমতাসীনেরাও আদের অবস্থান ধরে রাখতে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করবে। তাহলে ফলাফলটা কি? রক্তপাত, প্রাণহানি আর অর্থনৈতিক ক্ষতি! জনগণ কি এটা চায়। একবাক্যে উত্তর না। তাহলে জনগণ যেটা চায় না সেটা কেনো বারবার হয় আমাদের দেশে। ভোট দেয়া প্রতিটি নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। তাদের এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করার অধিকার কি কোনো দলের আছে। নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে বিশ্বের সব জায়গায় কম বেশি ঝামেলা আছে। তবে আমাদের এখানে ঝামেলা সীমাহীন। কেনোনা দুটি রাজনৈতিক দলের অবস্থান দুই মেরুতে। বলতে গেলে মারমুখী অবস্থানে। এমন একটি পরিস্থিতিতে দেশের সুশীল সমাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।  কিন্তু সেই সুশীল সমাজও রাজনৈতিকভাবে দ্বিধা-বিভক্ত। যার কারণে সুশীলেরা আজও কোনো শক্ত প্লাটফর্ম দাঁড় করাতে পারেনি। রাজনৈতিক দলের উপর সুশীল সমাজ যে একটি নৈতিক চাপ তৈরি করবে সেটাও সম্ভব হচ্ছে না। সংলাপ নিয়েও এক ধরনের ধোঁয়াশা লক্ষ্য করছি। সংলাপ বিষয়ে সকালে আশাব্যঞ্জক কিছু বার্তা পেলেও বিকেলে সেটা উল্টে যাচ্ছে। আসলে এটা কি কোনো সমাধানের পথ? সমাধানের জন্য প্রথম এবং প্রধান শর্ত সদিচ্ছা। প্রশ্ন হলো এই সদিচ্ছা তাদের কতোটুকু? আপাতত সেটা শূন্য শতাংশ মনে হচ্ছে। তবে রাজনৈতিক হিসেব যেকোনো সময় মোড় নিতে পারে। তবে একটি বিষয় অন্তত বোঝা যাচ্ছে যে ২০১৪ এবং ২০১৮-এর মতো প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন হয়তো ২০২৪-এ সম্ভব হবে না। তাহলে কি ধরনের নির্বাচন হবে? নিরপেক্ষ না অংশগ্রহনমূলক? নাকি নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক দুটোই। দেশের জনগণ নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহনমূলক নির্বাচন চায়। প্রশ্ন হলো নির্বাচনকালীন সরকার কী ধরনের হবে? যদি গতানুগতিক হয় তবে বিরোধী শিবির সেটা মেনে নেবে না। বর্তমান সরকারের আমলেই ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন অনেকটাই পূরণ হয়েছে। এখন স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে। আমরা অবশ্যই স্মার্ট বাংলাদেশ চাই। কিন্তু স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য যে একটি স্মার্ট নির্বাচন প্রয়োজন সেটা কি রাজনৈতিক দলগুলোর ভাবনায় আছে? বাংলাদেশে গণতন্ত্র চর্চার ক্ষেত্র অনেকটাই সীমিত হয়ে পড়েছে। কিন্তু স্বাধীনতার মূলমন্ত্র ছিলো একটি সুস্থ ধারার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হবে বাংলাদেশ যেখানে জনগণ তাদের ভোটাধিকার খুব স্বাচ্ছন্দ্যে প্রয়োগ করতে পারবে। জাতীয় নির্বাচন নিয়ে পরিস্থিতি দিনদিন জটিল হচ্ছে। ইতোমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সুষ্ঠু নির্বাচন প্রশ্নে ভিসা নীতি তৈরি করেছে। ভিসা নীতি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য একটি বড় চাপ এটা সহজেই অনুমেয়। শুধু ভিসা নীতি নয়, নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে আরো নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়তে পারে বাংলাদেশ। সেটা আরো শাপেবর হয়ে দাঁড়াবে। 

সরকার সুষ্ঠু নির্বাচনের আশ্বাস দিচ্ছে বারবার। কিন্তু তাদের দেয়া আশ্বাসের উপর কোনো আস্থাই রাখতে পারছে না বিরোধী শিবিরগুলো। সরকার এখন পর্যন্ত এমন কোনো নজীর স্থাপন করতে পারেনি যে বিরোধী শিবির আস্থা পাবে। অনেকে অবশ্য গাজীপুর সিটি নির্বাচনকে সুষ্ঠু ভোটের নজীর হিসেবে দেখাতে চাইছেন। কিন্তু একটি বিষয় মনে রাখা দরকার যে সিটি নির্বাচন আর জাতীয় নির্বাচন এক নয়। জাতীয় নির্বাচন ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে জড়িত। তাই এই নির্বাচনের হিসেবও ভিন্ন। জাতীয় নির্বাচন দুটি বিষয়ের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। তাদের একটি হলো নির্বাচনকালীন সরকার এবং অন্যটি হলো নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রশাসনিক পদগুলো। বিরোধী শিবিরগুলোর দাবি সরকার তার নিজের পছন্দমতো প্রশাসন সাজিয়ে নিয়েছে। আর এই সাজানো প্রশাসন দিয়ে কখনো সুষ্ঠ ভোট হতে পারে না। তাহলে একটি সুষ্ঠু ভোট কীভাবে করা যাবে? দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে বিরোধীরা সে নির্বাচনে যাবে না। আবার নিরপেক্ষ সরকার করতে হলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। সরকার সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক আনবে না। জটিলতা থেকেই যাচ্ছে। সরকার গত ১৫ বছরে দেশে বহুমাত্রিক উন্নয়ন করেছে। সেদিক থেকে তারা জনগণের প্রচুর ভোট পাবে বলে ধারণা করা যায়। জনগণ যদি উন্নয়ন বিপ্লবের সত্যি ফিডব্যাক দেয় তবে সরকারের চিন্তার কিছু নেই। জনগণের ভোটে যারা নির্বাচিত হবে তারাই সরকার গঠন করবে এটাই স্বাভাবিক। প্রশ্ন হলো জনগণের ভোটের নিরাপত্তা কে দেবে? সরকার ভোটের নিরাপত্তার কথা বললেও বিরোধী শিবির সেটা আমলে নিচ্ছে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে সবাই এখন পশ্চিমা বিশ্বের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু মনে রাখা দরকার একটি দেশের নির্বাচন অন্য একটি দেশ করে দিতে পারে না। তারা পর্যবেক্ষণ করতে পারে এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য চাপ দিতে পারে। দেশের জনগণকেই সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। 
 
স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণে স্মার্ট গণতন্ত্র, স্মার্ট নির্বাচন খুবই অপরিহার্য। জনগণ কোনো দাঙ্গা-হাঙ্গামা চায় না। তারা শান্তিতে থাকতে চায়, নিরাপদের তাদের ভোটটি প্রয়োগ করতে চায়। রাজনৈতিক দলগুলো যতোক্ষণ না জনগণের এই চাওয়াকে মূল্যায়ন না করবে ততোদিন অশান্তি চলতেই থাকবে। সংলাপ সংলাপ খেলা না খেলে প্রকৃত সংলাপ কীভাবে করা যায় সেই পথ দয়া করে খুঁজুন। রাজনীতির মাঠে দাবার চাল থাকবে চিরকাল। কিন্তু সেই চাল হতে হবে কৌশলী আর গণমুখী। যতো বেশি কুটচালে জড়াবে দলগুলো ততোবেশি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। একটি প্রকৃত সংলাপ করে রাজনৈতিক দলগুলো বিশ্বকে দেখাক যে বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থে স্মার্ট হচ্ছে। 

লেখক : মাজহার মান্নান, কবি ও কলামিস্ট

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আবারো ভর্তি পরীক্ষা চালু হবে - dainik shiksha জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আবারো ভর্তি পরীক্ষা চালু হবে সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি: দুই দিনে আবেদন প্রায় দুই লাখ - dainik shiksha সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি: দুই দিনে আবেদন প্রায় দুই লাখ শিক্ষক নিয়োগেও নামকাওয়াস্তে মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা হয়: গণশিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha শিক্ষক নিয়োগেও নামকাওয়াস্তে মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা হয়: গণশিক্ষা উপদেষ্টা পাঠ্যপুস্তক থেকে শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার বিষয়বস্তু অপসারণের দাবি - dainik shiksha পাঠ্যপুস্তক থেকে শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার বিষয়বস্তু অপসারণের দাবি এসএসসির ফরম পূরণ শুরু ১ ডিসেম্বর - dainik shiksha এসএসসির ফরম পূরণ শুরু ১ ডিসেম্বর কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের গল্প - dainik shiksha পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের গল্প কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক পাঠ্যপুস্তকে একক অবদান তুলে ধরা থেকে সরে আসার আহ্বান হাসনাতের - dainik shiksha পাঠ্যপুস্তকে একক অবদান তুলে ধরা থেকে সরে আসার আহ্বান হাসনাতের ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ - dainik shiksha ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0030491352081299