একটি কলেজে শিক্ষকতা করছি ২০ বছর ধরে। শিক্ষার্থীদের নিয়েই যেহেতু আমার কাজ তাই শিক্ষার সমসাময়িক অবস্থা এবং শিক্ষার্থীদের চিন্তা-ভাবনার গভীরে প্রবেশ করার সুযোগ আমার হয়। সারাদেশ জরিপ করার সাধ্য আমার নেই। তাই আমার ভাবনা দর্শনে কিছু দুর্বলতা থেকে যেতে পারে। তবে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিশে যতটুকু বুঝতে পারি সেটাই হয়তো তুলে ধরার চেষ্টা করব। একটি দেশের মানসম্মত শিক্ষার ওপর নির্ভর করে সেই দেশের সামগ্রিক তথা প্রকৃত উন্নয়ন। শিক্ষা লাভ করে একজন শিক্ষার্থী নিজেকে দক্ষ করে তোলে। কিন্তু সম্প্রতি যে নতুন সংকট তৈরি হয়েছে সেটাকে কোনোভাবেই এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে বলে মনে করি না। কেন দিন দিন শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষাবিমুখতা তৈরি হচ্ছে সেটা নিয়ে তেমন কোনো গবেষণার সংবাদ আমার জানা নেই। কিন্তু নীরবে একটি স্থায়ী সংকট তৈরি হচ্ছে যেটা শুভকর বলে মনে করার কোনো যৌক্তিকতা নেই।
স্বাভাবিক দৃষ্টিতে সবকিছু ভালো মনে হলেও আসলে তা কতটুকু মঙ্গলজনক সেটা ভাবার বিষয়। স্মার্ট ফোন শিক্ষার্থীদের কতটা ক্ষতি করছে তা নতুন করে বলার প্রয়োজন মনে করি না। স্মার্টফোনের লাগামহীন ব্যবহার শিক্ষার্থীদের মাঝে তৈরি করছে শিক্ষাবিমুখতা। শিক্ষার্থীদের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তাদের শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করার কথা। কিন্তু কি বেহাল দশা আজ। শিক্ষার্থীরা ইদানীং পড়াশোনা করতে চায় না। লেখাপড়াকে তারা তাদের বোঝা মনে করে। যেনতেনভাবে একটি সনদ জোগার করতে পারলেই তারা বেঁচে যায়। শিক্ষা ব্যবস্থার ঢিলেঢালা অবস্থাটিকে তারা শতভাগ কাজে লাগাতে চায়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে শিক্ষার্থীদের শতভাগ পাস করানোর প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। এ প্রতিযোগিতাকে ভালোভাবেই দেখি। এই প্রতিযোগিতায় শিক্ষার্থীদের পাসের ব্যাপারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো উদগ্রীব থাকে। কিন্তু শিক্ষার মানের ব্যাপারে তাদের সেই ধরনের উদ্বেগ লক্ষ করা যায় না। শিক্ষার্থীরাও ফাঁকফোকর খুঁজে বেড়ায়।
শিক্ষায় মানের কতটুকু অগ্রগতি হচ্ছে সেটা নিয়ে তথ্য সমৃদ্ধ গবেষণা খুবই সীমিত। তবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষার চিত্র থেকে শিক্ষার মান সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যায়। সনদনির্ভর এবং পাসনির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা দিয়ে একটি মেধাবী জাতি গঠন করা কতটুকু সম্ভব তা শিক্ষা গবেষকরাই ভালো বলতে পারেন। করোনা মহামারি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ২০২০ সালে এইচএসসি পরীক্ষা নেয়া সম্ভব হয়নি। অটোপাস দেয়া হয়েছে। এ বছর শিক্ষার্থীরা তাদের ঐচ্ছিক বিষয়গুলোর পরীক্ষা দিচ্ছে। করোনার জন্য তাদের সিলেবাস সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে এবং পরীক্ষার সময় ও নম্বরে পরিবর্তন আনা হয়েছে। করোনায় শিক্ষার্থীদের ক্ষতি হয়েছে সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু যতটুকু সময় তারা পেয়েছে ততটুকু তারা কাজে লাগিয়েছে বলে দৃশ্যমান হয় না। করোনার পর তিন মাস শিক্ষার্থীদের কাছে পেয়েছি। তাদের লেখাপড়ার অবস্থা মোটেও কাক্সিক্ষত পর্যায়ে নেই। তাদের মধ্যে যেনতেনভাবে সনদ অর্জনের একটি মানসিকতা দেখেছি। যাহোক আমার দেখার মাঝেও হয়তো ঘাটতি থেকে যেতে পারে।
আমাদের এখানে উচ্চশিক্ষা খুব সহজলভ্য হয়ে গেছে। সবারই এম এ সনদ নিতে হবে এমন মানসিকতা তৈরি হয়েছে। কিন্তু সবার জন্য কি উচ্চ শিক্ষা প্রয়োজন আছে? মুখস্থনির্ভর বা সনদনির্ভর উচ্চ শিক্ষা দিয়ে বাস্তব জীবনে তার টিকে থাকা সত্যি কষ্ট হয়। উচ্চ শিক্ষা নিয়ে না পারে ছোট কাজ করতে না পায় বড় কাজ। এক দোদুল্যমান অবস্থায় তারা নিপতিত হয়। করোনায় বেকার সংখ্যা বহুগুণে বেড়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের শুধু পাস নিশ্চিত করেই মহাস্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। আর কোনো দায় তাদের নেই বা দেয়া চলে না। কিন্তু দেশের সামগ্রিক অবস্থা কি দাঁড়াচ্ছে। এত বিপুলসংখ্যক বেকারের কি পরিণতি? এ ভাবনা তো সরকার এবং রাষ্ট্রের। শিক্ষায় ব্যবস্থায় সরকার ব্যাপক পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে ২০২৩ সাল থেকে। এটি প্রশংসনীয়। কিন্তু শুধু পাসের হার বাড়ানোই যেন লক্ষ্য না হয়। শিক্ষার গুণগত মানের দিকে গভীর নজর থাকা প্রয়োজন। যে কোনো মূল্যেই হোক শিক্ষার মান ধরে রাখতে হবে, অন্যাথায় এর স্থায়ী মাশুল সমগ্র জাতিকে বহন করতে হবে। একটি পরিকল্পিত শিক্ষা কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকেও দায়িত্ব নিতে হবে।
লেখক : মাজহার মান্নান, সহকারী অধ্যাপক, বি এ এফ শাহীন কলেজ, কুর্মিটোলা, ঢাকা সেনানিবাস।