হত্যার পলাতক আসামি ব্রির কর্মকর্তা, পাচ্ছেন পদোন্নতি!

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

মো. মিজানুর রহমান। তিনি নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার ভিটা কাজীপুর গ্রামের মো. আবদুর রাজ্জাকের ছেলে। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে গাজীপুরে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে (ব্রি) বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত। থাইল্যান্ডে মাস্টার্স শেষ করে ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে দেশে ফেরেন তিনি। এবার ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে পদোন্নতির জন্য সুপারিশ পেয়েছেন। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামীকাল সোমবার আরেকটি সভায় তাঁর পদোন্নতি চূড়ান্ত হওয়ার কথা। 

কিন্তু হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি এই মিজান। ৯ বছর আগের ধামাচাপা পড়ে যাওয়া একটি বিষয় নতুন করে সামনে এসেছে। ফাঁস হয়ে গেছে গোপন করে রাখা সেই ঘটনা। হত্যা মামলার আসামি হয়েও তথ্য গোপন করে সরকারি চাকরি ভাগিয়ে নিয়েছেন তিনি। আর সে ঘটনা জানাজানির পর ব্রির মহাপরিচালকের কাছে মিজানুরের পদোন্নতি স্থগিতসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন করেছেন বিজ্ঞানীরা। পুলিশের খাতায় পলাতক আসামি হয়েও এত বছর চাকরির ঘটনায় ব্রিতে তোলপাড় শুরু হয়েছে।

জানা গেছে, ৯ বছর আগে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) দেশব্যাপী আলোচিত ঘটনা ছিল মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের স্নাতক শেষ বর্ষের ছাত্র সাদ ইবনে মমতাজ হত্যাকাণ্ড। ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের বিরোধের জেরে ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ মার্চ রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের আশরাফুল হক হলের ২০৫ নম্বর কক্ষে সাদকে আটকে রেখে নির্যাতন করে ছাত্রলীগের আরেক গ্রুপের নেতাকর্মীরা। তিনি ওই হল শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। তাঁকে কার্পেট দিয়ে মুড়িয়ে লোহার রড, লাঠি, হকিস্টিক দিয়ে পেটানো হয়। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরদিন সকালে মারা যান। এ ঘটনায়  বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের ২ এপ্রিল অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে কোতোয়ালি থানায় মামলা করা হয়। এ মামলার বাদী ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা মহিউদ্দিন হাওলাদার।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের করা মামলায় পুলিশের তদন্তে ১৪ জনকে অভিযুক্ত করে ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ জুলাই আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। অভিযোগপত্রে মিজানুরকে ৯ নম্বর আসামি করা হয়েছে। বাকি আসামিরা হলেন– সুজয় কুমার কুণ্ডু, রোকনুজ্জামান, সাদেকুর রহমান, রোকন, রেজাউল করিম, নাজমুল সাদাত, দেওয়ান মো. মুনতাকা মুফরাত, অন্তর চৌধুরী, সুমন পারভেজ, ফয়সাল ইসলাম জয়, মনোয়ারুল ইসলাম, হাসান মাহমুদ ও প্রশান্ত দে। এর মধ্যে আটজন গ্রেপ্তার হলেও পরবর্তী সময়ে জামিন পেয়েছেন। বাকি পাঁচজনও জামিনে মুক্ত। কিন্তু মিজানুর রহমান এখন পর্যন্ত জামিন নেননি। মামলাটি ময়মনসিংহের চতুর্থ অতিরিক্ত জজ আদালতে বিচারাধীন। গত ১৭ জানুয়ারি আদালতের একটি আদেশে বলা হয়েছে, আসামি মিজানুর রহমান পলাতক। তাঁর নামে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর অনুপস্থিতিতেই চলবে বিচারকাজ।

হত্যা মামলার আসামি হয়েও ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে (ব্রি) বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান মিজানুর রহমান। শুধু তাই নয়, হত্যা মামলার তথ্য গোপন করে ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে থাইল্যান্ডের এআইটি থেকে মাস্টার্স কোর্স শেষ করেন। গত ২২ মার্চ ব্রির নিয়োগ ও পদোন্নতি কমিটি সভায় ফার্ম মেশিনারি অ্যান্ড পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি (এফএমপিএইচটি) বিভাগের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পদে পদোন্নতির জন্য সুপারিশ পেয়েছেন তিনি। সরকারি চাকরিপ্রার্থী অপরাধের তথ্য গোপন করলেও পুলিশের ভেরিফিকেশনে ধরা পড়ার কথা। কিন্তু তাঁর ক্ষেত্রে এ রকম তথ্য জানত না ব্রি কর্তৃপক্ষ।

অভিযুক্ত মিজানুর রহমান বলেন, বাকৃবি থেকে ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে আমি মাস্টার্স পাস করে বের হয়েছি। ওই বছরই আমি ব্রিতে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করি। ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে দুই বছর উচ্চশিক্ষার জন্য থাইল্যান্ডে ছিলাম। সাদ হত্যা মামলায় আমাকে আসামি করার কথা আজকেই প্রথম শুনলাম। পুলিশ কিংবা আদালত থেকে আমাকে জানানো হয়নি। তিনি আরও বলেন, আমি বাকৃবির আশরাফুল হক হলের ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। নিহত সাদ ইবনে মমতাজের সঙ্গে আমার খুবই ভালো সম্পর্ক ছিল। সাদ হত্যাকাণ্ডের দিন পহেলা বৈশাখের পাঞ্জাবি কিনতে আমি মার্কেটে গিয়েছিলাম। রাতে ফিরে এসে দেখি, আহত অবস্থায় সাদকে কয়েকজন হল থেকে ধরাধরি করে নিচে নামাচ্ছেন। তখন আমি এগিয়ে গিয়ে অ্যাম্বুলেন্স ডেকে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম। এরপর আর কিছুই আমি জানি না। মামলার অভিযোগপত্রে থাকা নাম, পিতা-মাতার নাম ও ঠিকানা মিজানুর রহমানকে পড়ে শোনানো হলে তিনি বলেন, এগুলো ঠিক আছে। কিন্তু মামলায় আমাকে আসামি করার খবর জানি না। ফলে চাকরির সময় বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়নি।

এ বিষয়ে ময়মনসিংহের কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি মো. শাহ কামাল আকন্দ বলেন, অনেক ধাপ অতিক্রম হয়েছে। তাঁর নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তারের জন্য একাধিকবার তাঁর বাড়িতে গেছে। ফলে বিষয়টি তো তাঁর জানারই কথা। এখন জানে না বললেই তো হবে না। সে পৃথিবীর যেখানেই থাকুক, তাঁর বাড়িতে তো আত্মীয়স্বজন আছে। তাঁরা তো জানানোর কথা।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর বলেন, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মিজানুর রহমানের হত্যা মামলার কাগজপত্র গতকাল (শনিবার) রাতে আমি হাতে পেয়েছি। এত দিন বিষয়টি আমার জানা ছিল না। পুলিশ ভেরফিকেশনসহ সব ধাপ অতিক্রম করে তাঁর চাকরি হয়েছে। কোনো রকম তথ্য আগে কেউ দেয়নি। এর মধ্যে তাঁর চাকরি স্থায়ী হয়ে গেছে। এখন তিনি পদোন্নতির জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত।

দেশব্যাপী আলোচিত এত বড় একটি হত্যার ঘটনায় মিজানুর রহমান পলাতক আসামি। কিন্তু তিনি এত বছর ধরে চাকরি করে যাচ্ছেন– বিষয়টি আমার কাছে অবাক লাগছে। এ বিষয়ে আমরা ব্যবস্থা নেব। কৃষিমন্ত্রী ও সচিকে বিষয়টি জানাব। পদোন্নতি-সংক্রান্ত বোর্ডেও বিষয়টি তুলে ধরব।

সূত্র : সমকাল


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ - dainik shiksha ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ ‘ভুয়া প্রতিষ্ঠাতা’ দেখিয়ে কলেজ সভাপতির প্রস্তাব দিলেন ইউএনও - dainik shiksha ‘ভুয়া প্রতিষ্ঠাতা’ দেখিয়ে কলেজ সভাপতির প্রস্তাব দিলেন ইউএনও বেরোবি শিক্ষক মনিরুলের নিয়োগ বাতিল - dainik shiksha বেরোবি শিক্ষক মনিরুলের নিয়োগ বাতিল এমপিও না পাওয়ার শঙ্কায় হাজারো শিক্ষক - dainik shiksha এমপিও না পাওয়ার শঙ্কায় হাজারো শিক্ষক কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক জাল সনদে শিক্ষকতা করা আরো ৩ জন চিহ্নিত - dainik shiksha জাল সনদে শিক্ষকতা করা আরো ৩ জন চিহ্নিত এসএসসি ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দের ফরম পূরণের পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞপ্তি দেখুন - dainik shiksha এসএসসি ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দের ফরম পূরণের পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞপ্তি দেখুন কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0028538703918457