রোববার (২৯ অক্টোবর) সারা দেশে সকাল–সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছিল বিএনপি। সেই কর্মসূচি শেষ হওয়ার পর সন্ধ্যায় সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে তিন দিনের অবরোধ কর্মসূচি দিয়েছে সরকারবিরোধী দলটি। মঙ্গলবার (৩১ অক্টোবর) থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত এই কর্মসূচি পালিত হবে।
হরতাল এবং অবরোধের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য আছে। এই দুটি কর্মসূচির মধ্যে কোনটা বড় আর কোনটা বড়টার চেয়ে ছোট তাও নির্ধারণ করা আছে। কিন্তু আমাদের দেশে হরতাল ও অবরোধের মধ্যে পার্থক্য সেভাবে করা যায় না। দুটি কর্মসূচির ধরণ অনেকটা একই রকম মনে হয়।
বাংলাদেশে কোনো দল (সাধারণত বিরোধীদল) যখন হরতাল ডাকে তখন তারা সব সময় দাবি করে, হরতাল সফল হয়েছে। মানুষ ‘স্বতঃস্ফূর্ত’ ভাবে তাদের হরতালে সমর্থন দিয়েছে। অন্যদিকে যাদের বিরুদ্ধে এই হরতাল আহ্বান (সাধারণত সরকারি দল) করা হয়, তারা বলতে থাকেন মানুষ হরতাল প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা হরতালকে সমর্থন দেয়নি। যে কেউ লক্ষ্য করলে দেখবেন রাজনীতিবিদরা এই হরতাল ইস্যুতে ‘মানুষ’কে খুব গুরুত্ব দেন। হরতাল হওয়া না হওয়া মানুষের ওপর নির্ভর করে। তাদের মনোভাবের ওপর নির্ভর করে।
এখানের হরতাল আর অবরোধের মধ্যে মূল পার্থক্য। হরতাল কেউ পালন করবে কি করবে না, সেটা ব্যক্তি সিদ্ধান্তের ব্যাপার। এখানে চাপিয়ে দেওয়ার কোনো নিয়ম নেই। ব্যক্তি চাইলে দলের ডাকা হরতাল পালন করতে পারে, না চাইলে পালন করবে না। এখানে ব্যক্তিকে হরতাল পালনে বাধ্য করা যাবে না। এজন্য রাজনীতিবিদরা বলেন, মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে হরতাল কর্মসূচি সমর্থন করেছে। অর্থাৎ ওই রাজনৈতিক দল তাদের দাবিকে বেশিরভাগ জনমানুষের দাবিতে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষ তার দৈনন্দিন কাজ বন্ধ রেখে এই দাবিকে সমর্থন করেছে। তাদের হরতাল বা কর্মসূচি পালনে জোর করা হয়নি। অর্থাৎ হরতালে যিনি সমর্থন করছেন তিনি স্বেচ্ছায় অফিস যাবেন না, গাড়ি চালাবেন না, বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাবেন না। আর যিনি মানবেন না তিনি এগুলো করতে পারবেন। চাইলে দোকানদার দোকান খোলা রাখবেন, স্কুল কর্তৃপক্ষ চাইলে স্কুল খোলা রাখবেন।
অন্যদিকে ‘অবরোধ’ হচ্ছে কর্মসূচি পালনে জনগণকে বাধ্য করা। অর্থাৎ কোনো দল যদি এই কর্মসূচি দেয় তাহলে সেই দল বলে, আমরা এই এই স্থান অবরোধ করে রাখছি। এখানে ঢোকা বা প্রবেশ করা যাবে না। কেউ যদি চায় সে এই অবরোধ মানবে না তাহলেও সেই ইচ্ছা সে পূরণ করতে পারবে না। তাকে অবরোধ মানতে বাধ্য করা হবে।
এখন আসি বিএনপির কর্মসূচি নিয়ে। বিএনপি এবার অবরোধ ডেকেছে। বলছে তারা সড়ক, নৌ, রেলপথ অবরোধ করবে। এর মানে হচ্ছে তারা সড়ক পথে গাড়ি ও অন্যান্য যান, রেলপথে ট্রেন ও নৌ পথের নৌযান চলতে দেবে না। চলার পথ অবরোধ করে রাখবে। অর্থাৎ কেউ চাইলে এসব চলাচল করতে পারবে না। তার ইচ্ছা থাক বা না থাক কর্মসূচিতে তাকে পালন করতেই হবে। বা তাকে বাধ্য করা হবে।
২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে বিএনপি একবার অবরোধ কর্মসূচি দিয়েছিল। সে সময় তখন এ নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছিল, হরতাল আর অবরোধের মধ্যে পার্থক্য কী। বিশেষ করে যাদের বাচ্চারা স্কুলে পড়েন তাদের এ নিয়ে উৎসাহ ছিল বেশি। আলোচনা হচ্ছিল যেহেতু সড়ক, নৌ রেলপথ অবরোধ হবে তার মানে তো স্কুল–কলেজ, অফিস–আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, দোকান সবই খোলা থাকার কথা। কিন্তু কথা হচ্ছে এসব বন্ধ রাখার কোনো কথা নেই কিন্তু যাবেন কীভাবে? সব পথই তো অবরোধ থাকবে। সড়কের ক্ষেত্রে কোনো সংজ্ঞা তো করা হয়নি। সড়ক, মহাসড়ক, আঞ্চলিক সড়ক, অলি–গলির সড়কসহ নানা ধরনের সড়ক রয়েছে। এর মধ্যে কোনগুলো অবরোধ হবে আর কোনগুলো অবরোধ হবে না, সেটা তো বলা যাচ্ছে না।
২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে যখন এ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে তখন লেখক–গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদকে জাতীয় প্রেস ক্লাবে কয়েকজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, হরতাল আর অবরোধের মধ্যে পার্থক্য কী? তিনি বলেছিলেন, এগুলো এখন আর বোঝা যায় না। এখন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে নতুনত্ব থাকে না। স্বাধীনতার আগে বা স্বাধীনতা পরবর্তীকালে নানা নামে কর্মসূচি দিয়ে নতুনত্ব জানান দেওয়া হতো। এখন আর সেটা নেই। তবে তিনি বলেছিলেন, হরতালে সব বন্ধ থাকে। মানুষ দাবিকে সমর্থন জানিয়ে তার কাজকর্ম বন্ধ করে দাবির প্রতি সমর্থন জানায়। আর অবরোধ একটি নির্দিষ্ট স্থানকে অবরোধ করে রাখা বোঝায়। এখানে যে কর্মসূচি দিচ্ছে সেই অবরোধ করে। মানুষ বাধ্য হয় তা পালন করতে।
কোনটা বড় কর্মসূচি:
রাজনীতিবিদরা মনে করেন হরতাল, অবরোধের চেয় বড় কর্মসূচি। এটা চূড়ান্ত ধাপের কর্মসূচি। কেননা দলের দাবির প্রতি যখন বেশির ভাগ মানুষ একমত পোষণ করে তখন এ ধরনের কর্মসূচি দেওয়া যায়। এটা না হলে হরতালে সফলতা পাওয়া যায় না। কেননা এখানে বেশিরভাগ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ থাকতে হয়। না হলে কর্মসূচি সফল হয় না।
তারা মনে করে, এটা হচ্ছে ভোটের বা জরিপের মতো। হরতাল যত সফল ততই বোঝা যাবে দলের দাবির প্রতি মানুষের সমর্থন আছে।
অন্যদিকে অবরোধে যেহেতু বাধ্য করার বিষয় থাকে, তাই মানুষের সমর্থন সম্পর্কে বোঝা যায় না। হরতাল হয় শান্তিপূর্ণ অন্যদিকে অবরোধ জোর করার থাকলে অনেক ক্ষেত্রে তা সহিংস হয়ে উঠতে পাবে।
তবে আমাদের দেশের এ ধরনের কর্মসূচির ধরণ অনেকটা একই। দুই ধরনের কর্মসূচিতে বাধ্য করার একটা ব্যাপার থাকে। কর্মসূচি ঘিরে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতে দেখা যায়।