শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ বহু দেশে আছে কম ভাড়ার সুবিধা। ভারতের কর্ণাটকে শিক্ষার্থীদের জন্য সম্পূর্ণ বিনা ভাড়ায় বাসে যাতায়াতের ব্যবস্থা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া এবং ভারতের দিল্লিতে দূরত্ব অনুযায়ী ভাড়ার পরিবর্তে শিক্ষার্থীদের দেওয়া হয় মাসিক কার্ড। এটা দিয়ে শিক্ষার্থীরা পুরো মাস যাতায়াত করতে পারে। তবে বাংলাদেশে সরকার নিয়ন্ত্রিত বিআরটিসিও এখন পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের জন্য এ ধরনের ব্যবস্থা চালু করেনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গণপরিবহন খাত দেশের সবচেয়ে নৈরাজ্যকর খাতে পরিণত হয়ে আছে দীর্ঘদিন ধরে। এই খাতের নিয়ন্ত্রক কিছু ব্যক্তি রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছেন। এ কারণে পরিবহন খাত পুরোপুরি সরকারি নিয়মতান্ত্রিক কাঠামোর বাইরে চলে গেছে।
দেশে দেশে অর্ধেক ভাড়া: তথ্যানুসন্ধানে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে সাবওয়ে এবং পাবলিক বাস সার্ভিসে শিক্ষার্থীদের জন্য দিনে অর্ধেক ভাড়ার বিধান রয়েছে। শিকাগোর স্থানীয় কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি শিক্ষার্থীদের জন্য অর্ধেক ভাড়ার ডিজিটাল পেমেন্ট কার্ড চালু করেছে। এ পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের মূল্য পরিশোধ করে কার্ড কিনে তা দিয়ে পুরো মাস বাসে যাতায়াত করতে পারে। শিক্ষার্থীদের এই কার্ডের মূল্য এমনভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে, যা মূল ভাড়ার অর্ধেক। কার্ড পদ্ধতির ফলে বাসে দূরত্ব অনুযায়ী ভাড়া পরিশোধে ক্যাশ লেনদেনের ঝামেল দূর হয়েছে। একই ধরনে ব্যবস্থা অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স এবং স্পেনেও আছে।
দিল্লিতেও শিক্ষার্থীদের জন্য ১০০ রুপিতে (প্রায় ১২০ টাকা) পুরো মাস যাতায়াতের ব্যবস্থা করা হয়েছে পেমেন্ট কার্ডের মাধ্যমে। ভারতের কর্ণাটক রাজ্য সরকার নিম্ন ও মধ্য আয়ের পরিবারের শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য শিক্ষা বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ রেখে পুরোপুরি বিনা ভাড়ায় যাতায়াতের ব্যবস্থা করেছে। প্রতিবেশী নেপাল, শ্রীলঙ্কা এবং ভুটানেও রয়েছে শিক্ষার্থীদের যাতায়াতে ভাড়ায় ছাড় দেওয়ার সরকারি নীতি, যেটা পরিবহন ব্যবসায়ীরাও মেনে চলছেন।
জানা গেছে, ১৯৬৯ সালে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা দাবির একটি ছিল শিক্ষার্থীদের জন্য গণপরিবহনে অর্ধেক ভাড়া রাখা। সে সময় সরকারি করপোরেশনের বাস সার্ভিসের পাশাপাশি ট্রেনেও হাফ ভাড়া এবং সরকারি বিমান পরিবহন সংস্থায় শিক্ষার্থীর পরিচয়পত্র দেখালে ২৫ শতাংশ ভাড়া কম রাখা হতো। এ ছাড়া ১৯৯০ সাল পর্যন্ত পাবলিক বাস ও ট্রেনে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে হাফ ভাড়া নেওয়া সাধারণ রেওয়াজ ছিল। কিন্তু ১৯৯১ সালের পর থেকে পরিবহন খাতে গডফাদার-ক্যাডার সংস্কৃতি চালু হলে হাফ ভাড়ার রেওয়াজ ধীরে ধীরে উঠে যায়।
বিশিষ্টজনের ভাষ্য: শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, শিক্ষার্থীরা আগামী প্রজন্ম। তাদের প্রতি বিশ্বের সব দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষেরই সহানুভূতি থাকে। এটাই রেওয়াজ। শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়ার প্রচলন বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই আছে। এখন শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়ার সিদ্ধান্ত নিতে সরকার কেন এত সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে সেটাই বড় প্রশ্ন।
তিনি বলেন, প্রকৃতপক্ষে কিছু পরিবহন নেতার হাতে গণপরিবহন খাত পুরোপুরি জিম্মি হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে, সরকারি করপোরেশনের বাস সার্ভিসও অনেকটাই অস্তিত্বহীন। ফলে সার্বিকভাবে গণপরিবহন খাতে দীর্ঘদিন ধরে নৈরাজ্য চলছে। কিছু পরিবহন নেতা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় এ খাতে ইচ্ছামতো লুটপাট চালাচ্ছে। সরকার ভাড়া বাড়িয়ে ১০ টাকা করলে তারা ১৫ টাকা নেয়। এটা রীতিমতো অপরাধ। এই অপরাধের বিরুদ্ধে সরকার কার্যত কোনো ব্যবস্থাই নিতে পারছে না। এই নেতারা কখনও সরকারের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত হচ্ছেন, কেউ কেউ আবার ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলে গুরুত্বপূর্ণ পদ পাচ্ছেন। তারা সরকারকেই জিম্মি করে ফেলেছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের প্রধান রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, বাসে করে যে শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যায় তারা নিম্ন আয়ের বাবা-মায়ের সন্তান। তারা ধনীদের সন্তান নন, ইংলিশ মিডিয়ামের শিক্ষার্থীও নন। তাদের জন্য বাসে হাফ ভাড়া নির্ধারণের দাবিটি অত্যন্ত যৌক্তিক। সরকারের অবশ্যই এ যৌক্তিক দাবি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা উচিত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, বারবার শিক্ষার্থীদের দাবি উপেক্ষিত হতে দেখা যাচ্ছে। এর আগে নিরাপদ সড়ক প্রতিষ্ঠার যে দাবি শিক্ষার্থীরা জানিয়েছিলেন, সেই দাবিও কিন্তু পূরণ হয়নি।