লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দর সংলগ্ন কোর্টইয়ার্ড বাই মেরিয়ট হোটেলে দশ দিনের আনুষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন শেষে গত পরশুদিন বিকেলে আল্লাহর রহমতে সহি সালামতে বার্মিংহাম এসে পৌঁছেছি। আমাদের পেয়ে স্বজনদের আনন্দ কে দেখে ? দু'জনকে একসঙ্গে পেয়ে আনন্দের সীমা নেই। আমরাও নিমেষে সব ক্লান্তি ভুলে যাই। গত ২২ জুন বাড়ি থেকে বের হয়ে ৭ জুলাই গন্তব্যস্থলে এসে পৌঁছুতে ১৫ দিনের মতো সময় লেগেছে। যেখানে পৌঁছুতে ১৫ ঘন্টার বেশি সময় লাগার কথা নয়, সেখানে করোনার কারণে ১৫ দিনের মতো লেগেছে। করোনা মহামারির কারণে অন্য এক পৃথিবীতে এখন আমাদের বসবাস। সবকিছু স্থবির হয়ে আছে। মানুষের শান্তির দুনিয়াটি আজ করোনার কারণে উদ্বেগ ও উৎকন্ঠায় ভরা অন্য আরেক দুনিয়া। এই ১৫ দিনে মোট তিন বার করোনা টেস্ট করাতে হয়েছে। যদিও মহান মা'বুদের কৃপায় তিন বারই নেগেটিভ রেজাল্ট পেয়েছি, তথাপি প্রতিবারই রেজাল্ট হাতে না আসা পর্যন্ত চরম এক উৎকন্ঠায় সময় কাটাতে হয়েছে।
২৩ জুন সকাল আটটায় সিলেটে সীমান্তিক ল্যাবে সস্ত্রীক করোনার নমুনা দেই। জনপ্রতি ২ হাজার ৫ শত টাকা করে মোট ৫ হাজার টাকা ফি পরিশোধ করতে হয়েছে। বেসরকারি বলে ফি গুণতে হয়েছে বেশি। সরকারিতে ১ হাজার ৫ শত টাকা। সময়মতো রেজাল্ট পেতে সমস্যা হতে পারে, তাই বেসরকারিতে টেস্ট করিয়ে নেই। পরদিন সকাল ১০ টায় ঢাকা থেকে ফ্লাইট। সকল বিদেশ যাত্রীর জন্য করোনা টেস্ট এখন বাধ্যতামুলক। বিমানে ওঠার আগে ৭২ ঘন্টা সময়ের মধ্যে করোনা টেস্ট করে নেগেটিভ রেজাল্ট না হলে বিদেশ ভ্রমণ অনিশ্চিত। এ কারণে ইদানিং কত মানুষের বিদেশ ভ্রমণের আয়োজন ব্যর্থ হয়েছে। কতজনের ভিসা নষ্ট হয়েছে। টিকেট বাতিল হয়েছে। কত মানুষের স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটেছে। করোনার কারণে বিদেশ যাত্রীদের দূর্ভোগ ও খরচ বেড়েছে। করোনা টেস্টের রেজাল্ট হাতে না পেয়েই রাত ৮ টা ২০ মিনিটে একটি ফ্লাইটে সিলেট থেকে ঢাকায় চলে আসি। রাত দশটার আগে কোনমতে রেজাল্ট পাওয়া যাবে না। ঢাকায় এসে করোনার রেজাল্ট অনলাইন থেকে সংগ্রহ করি। মাশাআল্লাহ, দু'জনেরই রেজাল্ট নেগেটিভ আসে। ঢাকা বিমানবন্দর এলাকার অনতিদূরে সিলেট ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে রাত্রি যাপন করি। ঢাকায় অনলাইন থেকে করোনার রেজাল্ট সংগ্রহ করে বৃটেনে জেরিনের কাছে পাঠিয়ে দেই। করোনা টেস্টের রেজাল্ট পেয়ে ভাতিজি কাতার এয়ারওয়েজে আগে থেকে বুকিং করা পরের দিনের ফ্লাইটের অনলাইন টিকেট কনফার্ম করে এবং বৃটেনে কোয়ারেন্টিনের জন্য হোটেল বুকিং দেয়। সময় স্বল্পতার কারণে এসব করতে গিয়ে তাকে বহু বেগ পেতে হয়েছে। নিজে কম্পিউটার ও অনলাইনের কাজে পারদর্শি বলে সব কাজ সমাধা করে ভোররাতে আমার ই-মেইলে বিমানের কনফার্ম টিকিট ও অন্য সব কাগজপত্র পাঠিয়ে দেয়। ফজরের নামাজ পড়ে মেইল থেকে প্রিন্ট বের করতে গিয়ে ঝামেলায় পড়ে যাই। আশেপাশে কোথাও কম্পিউটারের দোকান খোলা না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়ি। সকাল ১০ টা ৩০ মিনিটে ফ্লাইট। সকাল ৭ টার মধ্যে বিমানবন্দরের কাউন্টারে যেতে হবে। এখন কী করা ? হোটেল বয় এই বলে আশ্বস্ত করে যে, কাগজপত্র কম হলে তাদের রিসিপসনের প্রিন্টার থেকে প্রিন্ট দিতে পারবে। কিছুটা আশ্বস্ত হই। ম্যানেজারকে ঘুম থেকে উঠিয়ে নিয়ে আসে। ততক্ষণে সকাল ৭ টা প্রায় বেজে গেছে। ভাতিজি লন্ডন থেকে ইমো, হোয়াটসঅ্যাপ ও ই-মেইলে সব ডকুমেন্ট পাঠিয়েছে। তাড়াহুড়োর যে কোন কাজে সমস্যা দেখা দেয়। আমরা কেবল ইমো ও হোয়াটসঅ্যাপ থেকে ডকুমেন্ট ট্রান্সফার করার চেষ্টা করছি। কোনমতে ইমো ও হোয়াটসঅ্যাপ থেকে ডকুমেন্ট ট্রান্সফার হচ্ছে না। বার বার চেষ্টা করেও কাজ হচ্ছিল না। সময় দ্রুত পার হয়ে যাচ্ছে। এখন কী করা ? লন্ডনে তারা হয়ত ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। তাদেরকে বলে মেইলে আবার আনা যেত। কি করতে হবে ভেবে পাই না। হঠাৎ মেইল চেক করে দেখি, মেইলে সব দেয়া আছে। দ্রুত হোটেলের মেইলে ফরওয়ার্ড করি। কাজ হয়ে যায়। হাফ ছেড়ে বাঁচি। মনে মনে আল্লাহকে স্মরণ করি। তিন সেট করে কাগজ বের করে পৌনে আটটার দিকে এয়ারপোর্টে চলে যাই। নয়টার মধ্যে বিমানবন্দরের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে অতঃপর স্বস্তির নিঃশ্বাস। বিমানবন্দরের ভেতরেই সকালের নাস্তা সেরে নেই। নির্ধারিত সময়ে আল্লাহর রহমতে লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হয়।
কাতারে প্রায় এগার ঘন্টার ট্রানজিট থাকায় ২৫ জুন লন্ডনের স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে হিথরো বিমানবন্দরে এসে পৌঁছুই। এখানে আনুষ্ঠানিকতা শেষে সরাসরি দশ দিনের কোয়ারেন্টিন পালনের জন্য হোটেলে নিয়ে যায়। ২৫ জুন হোটেলে উঠলেও ২৬ তারিখ থেকে দিন গণনা শুরু হয়। সেই হিসেবে ৫ জুলাই ১০ দিন পূর্ণ হলেও ৭ জুলাই হোটেল থেকে রিলিজ পাই। হোটেলে আসার দুইদিন পর আমাদের করোনা টেস্ট করা হয়। কোয়ারেন্টিনে হোটেলে অবস্থানকালীন প্রত্যেকের দুইবার করোনা টেস্ট করা হয়। উভয়বার রেজাল্ট নিগেটিভ হলে নির্ধারিত সময়ের পর হোটেল থেকে ছাড় মেলে। তা না হলে কোয়ারেন্টিনের সময় বেড়ে যায়। কষ্টের সাথে খরচও বৃদ্ধি পায়। করোনার কারণে মানুষের কষ্ট ও খরচ কত যে বেড়েছে, সে কেবল ভুক্তভোগীরাই বলতে পারবে। গত ৩ জুলাই কোয়ারেন্টিনকালীন দ্বিতীয় দফা করোনার নমুনা নেয়া হয়। দু'দিন পর আমার নিগেটিভ রেজাল্ট আসে। কিন্তু, বিপত্তি বাঁধে আমার স্ত্রির রেজাল্ট নিয়ে। সারা রাত অপেক্ষায় থাকি। রেজাল্ট আসেনা। বিষয় কী ? কী হলো ? কিছু ভেবে পাইনা। সবাই উদ্বিগ্ন। হোটেলের রিসিপশনে যোগাযোগ করি। তারাও কিছু বলতে পারেনা। অপেক্ষা করতে বলে। অপেক্ষার সময় কাটতে চায়না। NHS'র সাথে যোগাযোগ করা হয়। এ দেশে এরাই করোনার নমুনা সংগ্রহ করে রেজাল্ট দেয়। খবর পেয়ে তারা জরুরি ভিত্তিতে হোটেলে এসে পুনরায় নমুনা নিয় যায়। বার বার sorry বলে। রাতের মধ্যে বা পরদিন সকালে রেজাল্ট পাঠিয়ে দেবার কথা বলে যায়। আমাদের সময় কাটতে চায়না। রেজাল্ট কী আসে, কে জানে ? সারাদিন উদ্বেগ আর উৎকন্ঠায় কেটে যায়। সন্ধ্যায় রেজাল্ট আসেনা। সারা রাত ঘুম নেই। গতদিন কোয়ারেন্টিন শেষ হবার কথা ছিল। আজও শেষ হয় কীনা, কে জানে। চিন্তা করতে করতে মাথা খারাপ হয়ে যাবার উপক্রম। বার বার হোটেলের রিসিপশন থেকে ফোন আসে। রেজাল্ট এসেছে কীনা, জানতে চায়। বার বার 'না' সূচক জবাব দিতে দিতে মন খারাপ হতে থাকে। রেজাল্ট নিগেটিভ না পজিটিভ আসে, সে আরেক চিন্তা। দেশে থাকতে আমরা করোনার দুই ডোজ টিকা নিয়েছি। ফ্লাইটের আগের দিন সিলেটে টেস্ট করে নিগেটিভ পেয়েছি। এখানে এসে কোয়ারেন্টিনের প্রথম দফা করোনা টেস্টের রেজাল্টও নিগেটিভ পেয়েছি। তাই মনে একটা ভরসা এই যে, এবারও ইনশাআল্লাহ নিগেটিভই আসবে। কিন্তু শেষ বার একজনের রেজাল্ট এলো আর একজনের এলো না, সেই চিন্তায় মন কেন জানি বার বার খারাপ হতে থাকলো।
এভাবে কোনমতে ঘুমিয়ে, না ঘুমিয়ে পুরোটা রাত কাটিয়েছি। সকাল হতে না হতেই ভাতিজি জেরিনের ফোন। রেজাল্ট নিগেটিভ এসেছে। এইমাত্র ম্যাসেজ পেয়েছে। তার মোবাইল নম্বর এবং ই-মেইল দেয়া ছিলো। আমরা দু'জনে প্রাণহীন দেহ নিয়ে যেন ঠায় বসেছিলাম। হঠাৎ করে দেহে প্রাণ ফিরে আসে। কোয়ারেন্টিনের বন্দিশালা থেকে মুক্তি পাবার মুহূর্তের আনন্দটুকু লিখে বুঝানো যাবেনা। তাড়াতাড়ি হোটেলের রিসিপশন ও সিকিউরিটিতে ফোন করে জানাই। তারা আমাদের বিদায় দেবার আনুষ্ঠানিকতা শুরু করে দেয়। কোয়ারেন্টিন থেকে বেরোনার নির্দিষ্ট সময় জানাতে না পারায় আমাদের রিসিভ করতে গাড়ি নিয়ে অন্য স্বজনরা আসতে পারেন নাই। কেবল গাড়ি নিয়ে স্ত্রির বড় ভাই ফখর এসে আমাদের হোটেল থেকে রিসিভ করে বার্মিংহামে নিয়ে যায়।
বার্মিংহাম বাঙালি অধ্যুষিত বৃটেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। এখানকার আবহাওয়াও লন্ডনের মতই। সারাদিন রোদ আর মেঘের খেলা চলে। এই বৃষ্টি তো এই রোদ। এই শীত তো এই গরম। বৃটেনের সর্বত্র দিন এখন অনেক লম্বা। রাত খুব ছোট। ১৬ ঘন্টা দিন আর ৮ ঘন্টা রাত। এখানে অনেক বাঙালির বসবাস। সিলেটের লোকজন বেশি। এখানে বেশকিছু মসজিদ দেখতে পেয়েছি। বাইরে থেকে আজান শোনা যায়না। বাসার ভেতরে থেকে দূরের মসজিদের আজান ও জামাতে নামাজ পড়া শোনা যায়। আজান শোনার জন্য অনেকে বাসায় এরকম সিস্টেম করে রেখে দিয়েছে। মসজিদগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে নামাজ আদায় করা হয়। গত দুই শুক্রবার কোয়ারেন্টিনে থাকায় জুমার নামাজ আদায় করতে পারিনি। গতকাল বার্মিংহামের সেন্ট্রাল জামিয়া মসজিদে জুমার নামাজ পড়েছি। মসজিদটি পাকিস্তানের লোকজন পরিচালনা করে থাকে। এদেশে মানুষজন সরকারি বিধি বিধান ও স্বাস্থ্যবিধি যথারীতি মেনে চলে। ইদানিং অবশ্য এখানে অনেক কড়াকড়ি উঠিয়ে নেয়া হচ্ছে।এদিকে এদেশে আবার করোনা সংক্রমণ পুনরায় কিছুটা বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। আমাদের দেশে করোনা মহামারির ঊর্ধগতির যে দুঃসংবাদ পাচ্ছি, তাতে মন একদম ভালো নেই। মহান মা'বুদ যেন দুনিয়াবাসীকে করোনা মহামারি থেকে অতি সত্ত্বর নিস্কৃতি দেন-এই মোনাজাত করে আজ এখানেই শেষ করছি।
লেখক : অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী, অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট এবং দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক, বর্তমানে যুক্তরাজ্যে সফররত।