কিংবদন্তি অভিনেতা ও নাট্য সংগঠক হুমায়ুন ফরীদির আজ মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ মে ঢাকার নারিন্দায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা এটিএম নূরুল ইসলাম ও মা বেগম ফরিদা ইসলাম। তিনি নিজ গ্রাম কালীগঞ্জে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। এরপর মাদারীপুর ইউনাইটেড উচ্চবিদ্যালয় হতে ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে এসএসসি এবং চাঁদপুর কলেজ থেকে ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে এইচএসসি পাস করেন। হুমায়ুন ফরীদি ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈব রসায়ন বিভাগে অনার্স কোর্সে ভর্তি হন, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে পিতার কর্মস্থল চাঁদপুরে অবস্থান করেন।
স্বাধীনতার পর তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে স্নাতক (সম্মান) কোর্সে ভর্তি হন। স্নাতক ফাইনাল পরীক্ষায় তিনি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান লাভ করেন। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নকালে তিনি ঢাকা থিয়েটারে যোগ দেন এবং নাট্যোৎসবের প্রধান আয়োজক হিসেবে কাজ করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
স্বাধীনতা উত্তরকালে বাঙালির নিজস্ব নাট্য আঙ্গিক গঠনে গ্রাম থিয়েটারের ভূমিকা অসামান্য। এর মূল সঞ্চালক ছিলেন কয়েকজন নাট্য ব্যক্তিত্ব যেমন সেলিম আল দীন, নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, আফজাল হোসেন, গোলাম মোস্তফা, পিযূস বন্দোপাধ্যায়, সুবর্ণা মোস্তফা এবং হুমায়ুন ফরীদি। ঢাকা থিয়েটারে ভূত নাটক নির্দেশনার মাধ্যমে মঞ্চ নাট্যধারায় অভিষেক ঘটে। বাংলাদেশে যখন নাট্য মঞ্চের সংকট তখন তিনি মহিলা সমিতি এবং গাইড হাউজ থেকে মঞ্চনাটকে অভিনয় চালিয়ে যান। বেশ কিছু মঞ্চ নাটকে অভিনয় করে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন। তার অভিনীত মঞ্চ নাটকগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে শকুন্তলা, কির্তনখোলা, কেরামত মঙ্গল, মুন্তাসীর ফ্যান্টাসি এবং ফণীমনসা, ধূর্ত উইঁ। মঞ্চনাটককে প্রসারিত করার লক্ষ্যে তিনি গড়ে তোলেন নাটক কেন্দ্রিক বিভিন্ন সংগঠন। গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন ও গ্রাম থিয়েটার এর অন্যতম।
টেলিভিশন নাটকে হুমায়ুন ফরীদির অভিষেক ঘটে নিখোঁজ সংবাদ নাটকের মধ্যদিয়ে। এরপর নীল নক্সার সন্ধানে, দূরবীন দিয়ে দেখুন, ভাঙ্গনের শব্দ শুনি, বকুলপুর কত দূর, দু’ভুবনের দুই বাসিন্দা, একটি লাল শাড়ি, মহূয়ার মন, সাত আসমানের সিঁড়ি, একদিন হঠাৎ, চান মিয়ার নেগিটিভ-পজেটিভ, ওযাত্রা, সংসপ্তক, পথের সময়, দুই ভাই, শীতের পাখি , কোথাও কেউ নেই, সমুদ্রের গাঙচিল, তিনি একজন, চন্দ্রগ্রস্ত, কাছের মানুষ, মোহনা, ভবের হাট, শৃঙ্খল, প্রিয়জন নিবাস, আরমান ভাই দি জেন্টলম্যান ইত্যাদি নাটকে সফল অভিনয় করেন। এর মধ্যে সংসপ্তক নাটকের কান কাটা রমজান চরিত্রটি ফরীদিকে বাঙলা নাট্যামোদী দর্শকের কাছে ব্যাপক পরিচিতি এনে দেয়। তিনি টেলিভিশন নাট্যাভিনয়ের প্রথাগত ধ্যান ধারণা ভেঙ্গে সৃষ্টি করেন এক নতুন অভিনয় ধারা।
হুমায়ুন ফরীদি কিছু বাংলা চলচ্চিত্রে খলনায়কের অভিনয় করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন। তিনি একাধারে আর্ট ফিল্ম এবং বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। আর্ট ফিল্মে তার অভিনীত চলচ্চিত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো হুলিয়া, ব্যাচেলর, আহা, মাতৃত্ব, বহুব্রীহী, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র জয়যাত্রা, শ্যামল ছায়া ও একাত্তরের যিশু। মাতৃত্ব চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য তিনি ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। তার অভিনীত বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্রের মধ্যে উল্লেলখযোগ্য হলো দহন, সন্ত্রাস, বিশ্বপ্রেমিক, ত্যাগ, মায়ের মর্যাদা, অধিকার চায়, মায়ের অধিকার, ভন্ড, রিটার্ন টিকেট, প্রাণের চেয়ে প্রিয়, কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি, দূরত্ব, পদ্মানদীর মাঝি ইত্যাদি।
হুমায়ুন ফরীদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগে অতিথি শিক্ষক হিসেবে অভিনয় বিষয়ে কিছুদিন পাঠ দান করেন। তিনি বাংলা চলচ্চিত্রে অশ্লীলতা রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের আজকের এই দিনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।