গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষায় কোনো শিক্ষার্থী পাস করেনি। ঢাকা বোর্ডের অধীনে ওই প্রতিষ্ঠানটি থেকে এসএসসিতে বসা ১২ জন শিক্ষার্থীর সবাই ফেল করেছেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির নাম লখন্ডা জীরাতলি মাধ্যমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয়টি উপজেলার গোহালা ইউনিয়নের জিরাতলী গ্রামে অবস্থিত। স্কুলটি নিম্নমাধ্যমিক স্তরে এমপিওভুক্ত। প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত ১৪ জন শিক্ষক-কর্মচারী কর্মরত রয়েছেন। তাদের ৯ জন শিক্ষক ও ৫ জন কর্মচারী।
এদিকে সব শিক্ষার্থী ফেল করার কারণ জানতে চাইলে স্কুল কর্তৃপক্ষ বলেছ, শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় অমনোযোগী ও মোবাইল আসক্ত হওয়ায় এমনটি হতে পারে।
তবে স্থানীয়রা ও শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা বলছেন, নিয়মিত ক্লাস না নেয়া ও শিক্ষকদের গাফিলতির কারণে এমন ফল এসেছে।
এদিকে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বলছেন, এমন ফল করায় স্কুলটির বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে স্থাপিত স্কুলটিতে বর্তমানে শিক্ষার্থী রয়েছে প্রায় দেড়শ’। প্রতিষ্ঠান পর থেকে স্কুলটি নিন্ম মাধ্যমিক পর্যায়ে (ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত) শিক্ষা কার্যক্রম চলিয়ে আসছিলো। গত বছর অর্থাৎ ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠানটিকে প্রথমবারের মতো মাধ্যমিক পাঠদানের অনুমতি দেয় ঢাকা শিক্ষা বোর্ড। তবে সে বছর পার্শ্ববর্তী অন্য একটি স্কুল থেকে রেজিস্ট্রেশন করে প্রতিষ্ঠানটির ১৪ জন শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ৯ জন শিক্ষার্থী পাস করেছিলেন। এ বছর প্রথমবারের মতো নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে রেজিস্ট্রেশন করে ১২ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেয়। এবার ফল প্রকাশের পর দেখা যায় স্কুলটি থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়া ১২ জন শিক্ষার্থী ফেল করেছেন।
স্থানীয়দের অভিযোগ, স্কুলটিতে নিয়মিত পাঠদান হয় না। নির্ধারিত সময়ের আগেই স্কুল ছুটি দিয়ে শিক্ষকরা বাড়িতে চলে যান। এছাড়া শিক্ষার্থীরা মোবাইলে আসক্ত, পড়াশোনায় অমনোযোগী। এছাড়া অভিভাবকরা উদাসিন। তাই ফল খারাপ হয়েছে।
বৃহস্পতিবার সকালে সরেজমিনে ওই স্কুলে গেলে দেখা যায়, স্কুলটি বন্ধ। বিদ্যালয়টি টিনের বেড়া দিয়ে ঘেরা। বিদ্যালয়ে কোনো শিক্ষক-শিক্ষার্থী বা অফিস সহকারী উপস্থিত নেই। টিনের বেড়ার দুইটি দরজা রয়েছে। দরজা দুটি তালাবদ্ধ।
স্থানীয়দের সাহায্য নিয়ে অফিস সহায়ক তন্ময় মন্ডলকে স্কুলে ডেকে আনা হলেও তিনি সাংবাদিক দেখে কৌশলে পালিয়ে যান।
স্কুলের একাধিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিদিন সকাল দশটায় ক্লাস শুরু হওয়ার কথা থাকলেও শিক্ষকরা আসেন সাড়ে ১১টায়। আবার আড়াইটা বাজলেই ছুটি দিয়ে দেন। তিনটার মধ্যে তারা বিদ্যালয় বন্ধ করে চলে যান। কোনো শিক্ষকই ২০ থেকে ২৫ মিনিট এর বেশি ক্লাস নেন না।
এসময় কথা হয় ওই বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী অধরা মন্ডলের সঙ্গে। তিনি দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, ঢাকায় আন্দোলন হচ্ছিলো, এজন্য কোনো স্যার স্কুলে আসেননি। এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় ১২ জন অংশগ্রহণ করে সবাই অকৃতকার্য হয়েছে।
কিছুক্ষণ পর ওই বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য তারাপদ মন্ডলের সঙ্গে দেখা হলে তিনি দৈনিক শিক্ষাডটকমকে জানান, বিদ্যালয়ের মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল খারাপ হওয়ার কয়েকটি কারণ রয়েছে। এর মধ্যে একটি অন্যতম কারণ হলো আমাদের গ্রামের পাশের তিনটি গ্রামের তিনটি ভালো স্কুল রয়েছে। তাই মেধাবী শিক্ষার্থীরা ওই স্কুলগুলোতে চলে যান। অপেক্ষাকৃত কম মেধাবী শিক্ষার্থীরা এ স্কুলে ভর্তি হন। তাছাড়া আমাদের এখানকার শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অবহেলা রয়েছে। তারা জানেন না তার সন্তান কখন কোথায় যাচ্ছে, ঠিকমতো লেখাপড়া করছে কি-না। অভিভাবকরা কোনো খোঁজ খবর রাখেন না।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে ওই বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, এই বিদ্যালয়ের এ বছর ১৬ জন শিক্ষার্থী মাধ্যমিক পরীক্ষা দেয়ার কথা ছিল। এরমধ্যে ১২ জন শিক্ষার্থী নির্বাচনী পরীক্ষায় পাস করেছিলো। অন্য চারজন শিক্ষার্থী ফেল করায় তাদের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে দেয়া হয়নি। আমার কথা হলো যারা নির্বাচনী পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পাস করলো তারা কেনো এসএসসি পরীক্ষায় ফেল করলো? এখানে শিক্ষকরা টাকার বিনিময়ে ফেল করা শিক্ষার্থীদের নির্বাচনী পরীক্ষায় পাস করিয়েছেন। না হলে একটি স্কুল থেকে সব শিক্ষার্থী ফেল করে কীভাবে?
ফেল করা এক শিক্ষার্থীর অভিভাবকের সঙ্গে কথা হলে তিনি দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, সারা বছর শিক্ষকরা ঠিকমতো পড়াশোনা করাননি। শিক্ষার্থীদের ওপর ঠিকমতো নজরদারি নেই শিক্ষকদের। তাই এমন ফল এসেছে। আমার সন্তানের একটি বছর লস হয়ে গেলো। এ দায়ভার কি স্কুল কর্তৃপক্ষ নেবে?
বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হরিপদ রায় দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, বিদ্যালয় থেকে এ বছর ১২ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। একজনও পাস করতে পারলো না। এটা খুবই দুঃখজনক। তবে আমরা শিক্ষকদের থেকে শিক্ষার্থীদেরই দোষ বেশি দেবো। আর নির্বাচনী পরীক্ষায় কোনো অনিয়ম হয়েছে কিনা সেটা আমার জানা নেই। এটাই আমাদের বিদ্যালয় থেকে প্রথম এসএসসি পরীক্ষা। তাই হয়তো একটু সমস্যা হয়েছে। আগামীতে এই সমস্যাগুলো থাকবে না।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রমেন্দ্রনাথ টিকাদারের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, ১২ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে একজনও পাস করতে পারেনি, এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। আমি কারও সামনেই কথা বলতে পারছি না। আসলে আমাদের কোথায় দুর্বলতা এ বিষয়গুলো আমি খুঁজে পাচ্ছি না। এজন্য বিদ্যালয়ে সভা আহ্বান করা হয়েছিলো। কিন্তু সেখানে অনেকেই উপস্থিত হননি। শুধু দুই একজন উপস্থিত ছিলেন।
প্রধান শিক্ষক আরো জানান, প্রতিষ্ঠানটি নিম্নমাধ্যমিক পর্যায়ে এমপিওভুক্ত। প্রতিষ্ঠানের ৯ জন শিক্ষক ও ৫ কর্মচারী এমপিও পাচ্ছেন।
জানতে চাইলে মুকসুদপুরের উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শাহাদাত আলী মোল্লা দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, বিষয়টি আমরা জেনেছি। স্কুলটির সব পরীক্ষার্থী ফেল করেছেন। আমরা এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে তাদের শোকজ করা হবে।
জানতে চাইলে গোপালগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা) গোলাম কবীর দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, স্কুলটি থেকে ১২ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিয়েছিলেন। তারা সবাই ফেল করেছেন। এটি দুঃখজনক। বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখবো। সেই সঙ্গে বিধি-বিধান অনুযায়ী স্কুলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।