১৫ আগস্ট বাঙালির শোকের দিন

অধ্যাপক ড. মো. লোকমান হোসেন |

‘ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা। জয় বাংলা’। এই উক্তিটি ছিল সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীন সোনার বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা, বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। যিনি গোপালগঞ্জ জেলার নিভৃত পল্লীর ছায়াসুনিবিড় গ্রাম টুঙ্গিপাড়ায় ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন টুঙ্গিপাড়ার বিখ্যাত শেখ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা শেখ জহির উদ্দীনের সপ্তম উত্তর-পুরুষ শেখ লুৎফর রহমানের তৃতীয় সন্তান। সাত কোটি বাঙালির বিংবদন্তিতুল্য নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের শৈশব-কৈশোর এবং যৌবনের লালন ওই গোপালগঞ্জেই।

যখন ইতিহাসই নির্মাণ করে কোনো ব্যক্তিকে, তাঁরা সত্যিকারের ইতিহাসের সন্তান। বিশ্ব ইতিহাসে এমন অনন্য ত্রাতাপুরুষ যাঁরা, আপন নাম-পরিচিতির ঊর্ধ্বে এবং দেশের-সীমানা ছাড়িয়ে তাঁদের অবস্থান। আমাদের সৌভাগ্য, ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের ক্ষুদ্রায়তন একটি দেশে তাঁকে পেয়েছিলাম।

বঙ্গবন্ধু তাঁর ৫৫ বছরের জীবনকালের অধিকাংশ সময়ই বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে অতিবাহিত করেছেন। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য গ্রেপ্তার হয়েছেন, কারাগারে দিনের পর দিন অনশন করেছেন। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়লাভ করলে পাকিস্তানি জালেমরা বাঙালিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে মাত্র ৫ দিনের ব্যবধানে আবার ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়। তখন বঙ্গবন্ধু ষ্পষ্ট বুঝেছিলেন গণআন্দোলন ছাড়া বাংলার মানুষের অধিকার আদায় সম্ভব নয়। ধীরে ধীরে বাংলার বুকে বঙ্গবন্ধু গড়ে তোলেন পাকিস্তানি শাসক বিরোধী গণআন্দোলন। কিন্তু কুখ্যাত আইয়ুব খান সামরিক শক্তির ছত্রচ্ছায়ায় ক্ষমতায় আসীন হয়েই বাঙালিদের ওপর ব্যাপকভাবে নির্যাতন শুরু করেন এবং বঙ্গবন্ধুকে বার বার কারাগারে নিক্ষেপ করেন। বাধ্য হয়ে বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ মার্চ বাঙালির মুক্তির সনদ ‘ছয় দফা কর্মসূচি’ঘোষণা করেন । ছয় দফার প্রচারণায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমরা চাই তথাকথিত প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের রাজনীতির অবসান ঘটুক এবং রাজনীতি মানুষের অধিকারে আসুক। ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে ছয় দফা ঘোষণা এবং ১৯৭১-এর ৭ মার্চে রমনা রেসকোর্স ময়দানের জনসমুদ্রে তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ। সময় মাত্র পাঁচ বছর, এই স্বল্পসময় ব্যবধানেই মানুষটি নেতৃত্বের আর ভালোবাসার কর্মী, সংগঠক, নেতা জনমত নির্বিশেষে সারা দেশের সাত কোটি মানুষের হৃদয়ের আসনে অভিষিক্ত হয়ে গেছেন। 

বঙ্গবন্ধুর ছিল হিমালয়সম দৃঢ়তা আর বাঙালি জাতির প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা। তাই তো ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনী প্রচারণাকালে বাগেরহাটের এক জনসভায় বলেছিলেন - ‘শুধু প্রধানমন্ত্রী কেন, সারা দুনিয়ার ঐশ্বর্য আর ক্ষমতা আমার পায়ের কাছে ঢেলে দিলেও আমি দেশের, বিশেষ করে বাংলার বঞ্চিত মানুষের সাথে বেঈমানি করতে পারব না’। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩১০ আসনের মধ্যে ৩০৫টি আসন লাভ করে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু ইয়াহিয়া খান বাঙালিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে বঙ্গবন্ধু ৩ মার্চ অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের ঐতিহাসিক জনসভায় বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পরোক্ষ ঘোষণা দেন এবং বাঙালি জাতিকে বিশ্বের কাছে বীরের জাতি হিসেবে  তুলে ধরেন। একদা সহকর্মীদের মুজিব ভাই, ময়দানে লক্ষ মানুষের জমায়েতে আভিষিক্ত হয়ে গেলেন ‘বঙ্গবন্ধু’ অভিধায়। 

অবশেষে এসে যায় বাংলাদেশ তথা পৃথিবীর ইতিহাসের সেই কালরাত ২৫শে মার্চ। শুরু হয় গণহত্যা। রাত সাড়ে বারোটায় বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন ঐতিহাসিক ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’। তারপর পরই হানাদার বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধে বাঙালির শ্লোগান ছিল - ‘তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব, শেখ মুজিব’। ভুট্টোর মুখে লাথি মার বাংলাদেশ স্বাধীন কর‘। এই অনুপ্রেরণায় ৭ কোটি বাঙালি ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর ছিনিয়ে আনে মহান বিজয়। 

কিন্ত  ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগস্টের উষালগ্ন ৫টা ৪০ মিনিটে বাংলাদেশের ইতিহাসে ঘটে যায় এক নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড। বাঙালি জাতির বরপুত্র বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হন স্বাধীনতার শত্রুদের হাতে। শত বছর বাঙালিদের লালিত সপ্নকে পদদলিত করার জন্য, ৭৫ পরবর্তী ঘটনাবলী তাই প্রমাণ করে। সেদিন থেকে বঙ্গবন্ধুর শাসন আমলের সকল অর্জন ম্লান করে দিয়ে দেশকে ভিন্ন পথে পরিচালিত করে। শুরু হয় মিথ্যা প্রচারণা ও ষড়যন্ত্র। আমরা জানি আগস্ট মাসটি শোকের মাস এবং ১৫ আগস্ট পিতৃহত্যা দিবস। এ মাসের প্রতিটি দিনই অনেক কষ্টের, কারণ এই মাসে আমরা হারিয়েছি জাতির পিতা, সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। যিনি ৪০ এর দশক থেকে ৭০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়কাল পর্যন্ত বাংলার মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির জন্য বহু ত্যাগ স্বীকার করেছেন। যৌবনের বেশিরভাগ সময় বাংলার মানুষের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করার জন্য জেল খেটেছেন। আমার মতে তিনি বেঁচে থাকলে বাংলাদেশ অনেক পূর্বেই জাপান বা দক্ষিণ কোরিয়ার মত হতো। কারণ তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ও দুরদর্শিতা আমাদের এগিয়ে নিয়ে যেত অনেক অনেক দুর। 

এই প্রজন্মের প্রাসঙ্গিক কৌতুহল: বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা হলেন কী করে? তিনি ছিলেন রাজনৈতিক দলের একনিষ্ঠ আপোসহীন কর্মী, একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে সংগঠন-তৈরি ও কর্মকাণ্ডের দক্ষতায়, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যাভিসারী দুঃসাহসিক পরিচালনা-কৃতিত্বে অনন্য। তারপর কখন সেই মানুষটি নিজেকে ছাড়িয়ে, দলীয় সংগঠনকে ছাড়িয়ে সমগ্র জাতির কোটি মানুষের পিতা হয়ে গেলেন। সবাই তাঁকে আত্মার সম্পর্কে ঘনিষ্ঠতম করে হৃদয়ে ধারণ করে নিল। লক্ষ লক্ষ মানুষ অন্তরের গভীরে শ্রবণ করেছিল মরণজয়ী সেই ডাক--‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম ....’। হঠাৎ করেই ডাক এবং হঠাৎ করেই মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়া-- কদাপি এমন হয় না। তাহলে অবশ্যই পেছনে রয়েছে অনেক কিছু। পেছনে রয়েছে বাংলার আপামর মানুষের দীর্ঘ বঞ্চনা-শোষণ-দাসত্বের চরম দুঃখভরা জীবন। জোরটা সেইখানে, যেখানে আমাদের সবার জন্যে গর্বের উৎস--আমাদের হাজার বছরের আবহমান বাংলা, আমরাই করেছি ভাষা আন্দোলন, বিজয়ী হয়েছি মুক্তিযুদ্ধে এবং আমাদের বঙ্গবন্ধু জন্মেছিলেন এই বঙ্গে। বাঙালি জেগেছে আপন সত্তায়, বাঙালি লড়েছে, জয় করে নিয়েছে সকল প্রতিকুলতাকে।

‘বাংলাদেশ’ নামক মূল্যবোধ থেকে সন্তানেরা ক্রমে সরে যাচ্ছে এক বৈরী ভুবনে। ১৯৪৮-১৯৫২ তে ভাষা আন্দোলন এবং সেই কর্মকাণ্ড থেকে বাঙালিত্বের আত্মঅধিকার অভিযান, অত:পর ’৬৯-এ গণঅভ্যুত্থান থেকে ইতিহাস স্পষ্টই ধেয়ে গেল নিশ্চিত ‘বাংলাদেশ’অভিমুখে। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ, এই বিশাল কর্মকাণ্ড সেই আমাদের জন্যে। নিজ জন্মের সত্যটাকে যেন ভুলে না যাই। ত্রিশ লাখ মানুষের রক্তঝরা সংগ্রাম এবং তিন লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি এই বিজয় এবং বাংলার মানুষের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টায় গড়ে তুলতে হবে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা। এই হোক আমাদের প্রত্যয়।

লেখক: টিম লিডার, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কার্যক্রম, পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প ও সাবেক মহাপরিচালক, নায়েম, শিক্ষা মন্ত্রণালয়। 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার - dainik shiksha তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার - dainik shiksha স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন - dainik shiksha নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0026109218597412