ভাবনাকে সুসংগঠিত করতে সমন্বয়ের গুরুত্ব অনেক। হোক তা মানুষের গল্প অথবা বইয়ের পাতা। শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, রাজনীতি বা শিল্প নিয়ে বাঙালির গত ২০০ বছরের ভাবনাকে একত্র করার উদ্যোগ নিয়েছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। বিপুল এই উদ্যোগে উঠে আসবে বাঙালি মনীষীদের গুরুত্বপূর্ণ লেখা। ‘বাঙালির চিন্তামূলক রচনা সংগ্রহ’ নামে যা প্রকাশিত হতে যাচ্ছে অতিকায় আকরিক গ্রন্থমালা হিসেবে।
আগামীকাল ১৪ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে উন্মোচন হবে গ্রন্থমালার। মোট ১৬টি বিষয়ে ২০৫টি খণ্ডে গ্রন্থ প্রকাশিত হবে, যার মোট পৃষ্ঠা ৭৪ হাজারের বেশি। প্রথম পর্বে ৫টি বিষয়ে ৫৪ খণ্ডের বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হবে। ধারাবাহিকভাবে বাকি বইগুলো প্রকাশিত হবে এ বছরের মধ্যেই। বাঙালির চিন্তামূলক রচনা সংগ্রহ প্রকল্প সমন্বয়ক খাদিজা রহমান বলেন ‘এ নিয়ে একটি ওয়েবসাইট তৈরি হয়েছে, যেখান থেকে পাঠক, ক্রেতা বই সম্পর্কে সব তথ্য জানতে পারবেন, বই কিনতে পারবেন। কিউআর কোড স্ক্যান করলে পাওয়া যাবে সব তথ্য।’
বিপুল এই গ্রন্থমালা সম্পাদনা করেছেন শিক্ষাবিদ, সমাজসংস্কারক, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সভাপতি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। ১০ অক্টোবর তিনি বলেন, ‘বইয়ের সংখ্যা অনেক বেশি হলে মানুষের মনে বিতৃষ্ণার জন্ম হতে পারে। বাঙালির চিন্তাকে আরও গুছিয়ে প্রকাশের ভাবনাটা মাথায় এসেছিল হঠাৎ করেই। এরপর ২০০১ থেকে ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত চলেছে শুধু লেখা নির্বাচন, পাঠ, পরামর্শের প্রস্তুতি। চারবার করে বানান সংশোধন হয়েছে সব লেখার। ২০০ বছরের চিন্তাকে সংকলনের ইচ্ছা মূলত বাংলার রেনেসাঁ (নবজাগরণ) সময়কাল মাথায় রেখে।’
বাঙালির চিন্তামূলক রচনা সংগ্রহ নিয়ে প্রকাশিত পরিচিতিপত্রের ভূমিকায় একটি অংশে তিনি জানিয়েছেন ‘গত ২০০ বছরে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, সাময়িকী ও বইয়ে তাঁদের সেই সব ঋদ্ধিধর্মী চিন্তা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে, যা আমাদের জাতির জাগতিক ও আত্মিক দিকনির্দেশনার জন্য সুবিন্যস্তভাবে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। ভবিষ্যতে যেসব মানুষ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাঙালির চিন্তাশীল রচনার বিষয়ে আগ্রহী হবেন বা এ নিয়ে গবেষণা করতে চাইবেন, তাঁরা ওই সব লেখা এই গ্রন্থের (বাঙালির চিন্তামূলক রচনা সংগ্রহ) মধ্যে সহজেই পেয়ে যাবেন।’
শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, রাজনীতি, সাহিত্য, সমাজের মতো মোট ১৬টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে প্রকাশিতব্য বাঙালির চিন্তামূলক রচনা সংগ্রহের সম্পাদনা করেছেন ২১ জন সম্পাদক। এর মধ্যে রাজনীতি ও সাহিত্যের ৩২ খণ্ড করে মোট ৬৪টি বই, ধর্ম ও দর্শন চিন্তার প্রকাশ হবে ২০ খণ্ড করে ৪০টি বই। অন্যান্য ১২টি বিষয়ে আসবে ১০১টি গ্রন্থ। প্রতিটি বিষয় সম্পাদনা করেছেন সে বিষয়ে স্বনামখ্যাত বিশিষ্টজন। বাঙালির অর্থচিন্তা নিয়ে ৮ খণ্ডের সম্পাদক হারাধন গাঙ্গুলী জানিয়েছেন, ‘প্রাচীন বাংলা, বিশেষ করে পঞ্চম থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত এবং সেখান থেকে বর্তমান বিশ্বায়নের প্রেক্ষাপটে অর্থনীতির বহুমাত্রিকতা, গতিপ্রকৃতি, তার দেশীয় ও বহির্দেশীয় নানা ঘাত-প্রতিঘাতের ইঙ্গিত দেওয়াই আমাদের লক্ষ্য।’
অর্থচিন্তা নিয়ে গ্রন্থগুলোতে স্থান পেয়েছে নীহাররঞ্জন রায়, সুবোধ কুমার মুখোপাধ্যায়, গৌতম ভদ্র থেকে শুরু করে অমর্ত্য সেন, রেহমান সোবহান, আকবর আলি খানের অর্থনীতি চিন্তা। উঠে এসেছে প্রাচীন বাংলা থেকে আধুনিক কালের অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা। ড. মো. মোফাখ্খারুল ইসলামের সম্পাদনায় বাঙালির ইতিহাস চিন্তা প্রকাশিত হবে ১৮ খণ্ডে। ব্রিটিশ, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ আমলের ইতিহাসচর্চার সামগ্রিক চিত্র উঠে এসেছে অমূল্য এই গ্রন্থগুলোতে। ২০ খণ্ডের দর্শন চিন্তায় স্থান পেয়েছে রামমোহন রায়, রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়সহ বহু মনীষীর চিন্তা। সম্পাদনা করেছেন ড. প্রদীপ রায়।
স্বর্ণ কুমারী দেবী, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের রচনাসহ ‘নারী চিন্তা’য় স্থান পেয়েছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখা। বাঙালির নারী চিন্তার ৩ খণ্ডের সম্পাদনা করেছেন আকিমুন রহমান।
বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের প্রকাশনা বিভাগের প্রধান আলাউদ্দিন সরকার বলেন, ‘বিশ্বসাহিত্যের অনেক কাজের মধ্যে এটি সবচেয়ে বড় প্রকাশনা।’
আগামীকাল বিকেলে রাজধানীর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পর পাঠকের হাতে একসঙ্গে উঠে আসবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে বাঙালির ২০০ বছরের ভাবনার রূপরেখা।