চলতি শিক্ষাবর্ষে সরকার ৩৫ কোটি ৯৩ লাখ পাঠ্যবই ছেপে বিতরণ করেছে। আগামী শিক্ষাবর্ষের জন্য ৩৫ কোটি ১৬ লাখ ১৯ হাজার ৩১৩ কপি বই ছাপার লক্ষ্য নির্র্ধারণ করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।
এ হিসেবে আগামী অর্থাৎ ২০২২ শিক্ষাবর্ষে পাঠ্যবই কমছে ৭৭ লাখের বেশি। তবে এবার প্রাক-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা এখনও নির্ণয় করতে পারেনি এনসিটিবি।
এনসিটিবি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সাধারণত প্রতিবছরই শিক্ষার্থী বাড়ে। শিক্ষার্থী বৃদ্ধির কারণে বছরে গড়ে প্রায় আড়াই শতাংশ পাঠ্যবই বৃদ্ধি পায়। কিন্তু করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতিতে এবার শিক্ষার্র্থী বেড়েছেÑএমন তথ্য নেই মাউশি ও ডিপিইর কাছে। মাউশি গত বছরের শিক্ষার্র্থী অনুপাতে বই ছাপার চাহিদাপত্র দিয়েছে, আর ডিপিই এখনও শিক্ষার্র্থীর প্রকৃত সংখ্যা নির্ণয় করতে পারেনি। এ কারণে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের লক্ষ্যমাত্রা কিছুটা কমিয়ে আনা হয়েছে। রোববার (২৯ আগস্ট) দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন রাকিব উদ্দিন।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, পাঠ্যবই কম ছাপার লক্ষ্য নির্ধারণের বিষয়ে জানতে চাইলে এনসিটিবির সদস্য (টেক্সট) প্রফেসর ফরহাদুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতিবারই প্রাথমিক স্তরের মোট বইয়ের ২ থেকে পাঁচ শতাংশ বেশি ছাপা হতো বাফার স্টকের (আপদকালীন মজুদ) জন্য। এবার প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই) বাফার স্টকের বই অর্ধেক কম ছাপাতে বলেছে। এ কারণে কিছু বই কমছে।’
মাধ্যমিক স্তরে বই কমার বিষয়ে এনসিটিবির বিতরণ নিয়ন্ত্রক প্রফেসর জিয়াউল হক বলেন, ‘বিগত সময়ে মাধ্যমিক স্তরে বাফার স্টকের বই ছাপা হতো। গত বছর বাফার স্টকের বই ছিল না। কিন্তু এবার সেটি না করে বাংলা, ইংরেজি ও গণিতÑএসব বিষয়ের প্রতিটির পাঁচ হাজার কপি বই বেশি ছাপার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এতে কোনো এলাকায় বইয়ের চাহিদা কিছুটা এদিকÑসেদিক হলে বাফার স্টক থেকে তা সামাল দেয়া যাবে।’
শিক্ষার্র্থী ভর্তি কম হওয়ায় বই ছাপা কমছে কি না জানতে চাইলে এনসিটিবির কোন কর্মকর্তাই মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। ডিপিই এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) বরাত দিয়ে এনসিটিবি কর্মকর্তারা জানান, করোনা সংক্রমণের কারণে টানা ১৭ মাসের বেশি সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এতে অনেক শিক্ষার্র্থীই নতুন শ্রেণীতে ভর্তি হয়নি। কিছু শিক্ষার্র্থী ঝরে পরতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ কারণে বই ছাপার লক্ষ্যমাত্রা কিছুটা কাটছাঁট করা হয়েছে।
এ ছাড়া এনসিটিবির পক্ষ থেকে প্রাথমিক স্তরের বই মুদ্রণের যথাযথ তথ্য সরবরাহের জন্য ডিপিইকে দুতিন দফা চিঠি দিলেও তারা ২০২২ শিক্ষাবর্ষের বই ছাপার যে তথ্য দিয়েছেন, সেখানে নানা গোঁজামিল রয়েছে। শিক্ষার্র্থীর সংখ্যা নিয়েও তারা এনসিটিবিকে দুইবার দুই রকম তথ্য দিয়েছেন বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এ কারণে বইয়ের সঠিক তথ্য নির্ণয়েও বিলম্ব হচ্ছে।
জানা গেছে, ২০২২ শিক্ষাবর্ষের জন্য প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা স্তরের মোট পাঠ্যপুস্তক ছাপা হচ্ছে ১০ কোটি ৪৪ লাখ ৬৪ হাজার ৯৩ কপি। তবে এই সংখ্যা কিছুটা কম-বেশি হতে পারে।
আগামী শিক্ষাবর্ষের জন্য মাধ্যমিক স্তরের মোট ২৪ কোটি ৭১ লাখ ৫৬ হাজার ২২০ কপি পাঠ্যবই ছাপার দরপত্র আহ্বান করেছে এনসিটিবি। এ হিসেবে ২০২২ শিক্ষাবর্ষে মোট পাঠ্যপুস্তকের সংখ্যা দঁাঁড়ায় ৩৫ কোটি ১৬ লাখ ২০ হাজার ৩১৩ কপি।
আর চলতি শিক্ষাবর্ষের জন্য গত বছর মোট বই ছাপা হয়েছিল ৩৫ কোটি ৯৩ লাখ ৪২ হাজার ১৭১ কপি। এর মধ্যে প্রাথমিক স্তরের জন্য ছাপা হয় ১১ কোটি ৫২ লাখ ১৯ হাজার ৮২২ কপি এবং মাধ্যমিক স্তরের জন্য ছাপা হয় ২৪ কোটি ৪১ লাখ ২২ হাজার ৩৪৯ কপি পাঠ্যপুস্তক। এ তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এবার প্রাথমিক স্তরের বই কমেছে। বেড়েছে মাধ্যমিক স্তরে বই।
এক বছরের ব্যবধানে প্রায় ৮০ লাখ কোটি কপি বই কম ছাপার কারণ জানতে চাইলে এনসিটিবি চেয়ারম্যান প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্র সাহা গতকাল বলেন, ‘এবার প্রায় ৩৫ কোটি বই ছাপার টেন্ডার আহ্বান করেছি। এই সংখ্যা কিছুটা বাড়তে বা কমতে পারে। কারণ, আমরা এখনও বইয়ের অ্যাকুরেট (পূর্ণাঙ্গ) সংখ্যা পায়নি। কার্যাদেশ দেয়ার সময় ঠিকাদারদের সঠিক সংখ্যা নির্ধারণ করে দেয়া হবে। আমরা সেভাবেই টেন্ডার আহ্বান করেছি।’
শিক্ষার্র্থী কম হওয়ায় বইয়ের সংখ্যা কমেছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটি আমরা বলতে পারব না।’ মাউশি ও ডিপিইর দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ করে এনসিটিবি। সাধারণ মার্চ ও এপ্রিলের মধ্যে মাউশি ও ডিপিই-এই দুই সংস্থার পক্ষ থেকেই পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের চাহিদাপত্র এনসিটিবিকে দেয়া হয়। তবে এবার ডিপিই যথাসময়ে সেটি দিতে পারেনি।
আর মাউশি পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের যে চাহিদাপত্র দিয়েছে সেখানে শিক্ষার্র্থীর সংখ্যা ধরা হয়েছে এক কোটি ৮৫ লাখ ৭৪ হাজার ২৬৬ জন (মাদ্রাসাসহ)। গত বছরও প্রায় একই সংখ্যা ধরে মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবই ছাপা হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিপিইর দুই কর্মকর্তা বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে সারা দেশেই স্কুল বন্ধ ছিল। এ কারণে সব শিশুর ভর্তি নিশ্চিত হয়নি। ভর্তি কার্যক্রম এখন চলমান রয়েছে। এ কারণে অনেক বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকেই আগের শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্র্থীর সংখ্যা অনুপাতে বইয়ের চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছে। এসব যোগ-বিয়োগ করতে গিয়ে বইয়ের চাহিদা তৈরিতে দেরি হয়েছে বলে ওই দুই কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
প্রাথমিকের বই কমলেও মাধ্যমিক তা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ জানতে চাইলে প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, ‘মাধ্যমিকের জন্য এবার বাফার স্টকের বই ছাপা হচ্ছে। গত বছর বাফার স্টকের জন্য বই ছাপা হয়নি।’
মোট শিক্ষার্র্থী
দেশে ৬৫ হাজার ৫৬৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। ২০২০ শিক্ষাবর্ষের তথ্য অনুযায়ী, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীর ছিল এক কোটি ৭৬ লাখ তিন হাজার ৮৩৯ জন।
আর ২০২১ শিক্ষাবর্ষে এনসিটিবি প্রাথমিক, প্রাক-প্রাথমিক ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মোট দুই কোটি ৩০ লাখ ৭৯ হাজার ৭৭৩ শিক্ষার্র্থীর জন্য বই ছেপেছিল। চলতি শিক্ষাবর্ষে মাধ্যমিক স্তরের মোট শিক্ষার্র্থী ছিল ১ কোটি ৮৫ লাখ ৭৫ হাজার ৪৫৩ জন। সবমিলিয়ে প্রাক-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত মোট শিক্ষার্র্থী ছিল ৪ কোটি ১৬ লাখ ৫৫ হাজার ২২৬ জন।
এর আগে ২০২০ শিক্ষাবর্ষে প্রাক-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত মোট ৪ কোটি ২৭ লাখ ৫২ হাজার ১৫৮ জন শিক্ষার্র্থীর জন্য পাঠ্যপুস্তক ছেপেছিল জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড।