ব্যতিক্রমী নানান আয়োজন আর ২৫১টি প্রতিমা নিয়ে গোটা বরিশাল বিভাগের সবচেয়ে বড় দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয়েছে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার কবুতরখালীর রাজ মন্দিরে। ইতোমধ্যে প্রতিমা তৈরিসহ পূজোর আয়োজনের সব প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। শুধু শেষ মুহুর্তে আলোকসজ্জাসহ খুঁটিনাটি কাজ চলছে। এ মণ্ডপসহ আশপাশে প্রায় আধা কিলোমিটার ধরে সাজানো হয়েছে অপরূপ সাজে। আগামীকাল শনিবার (১ অক্টোবর) দেশ-বিদেশের হাজার-হাজার দর্শনার্থী, বিশিষ্ট গুণীজন ও ভক্তদের পদচারনায় মুখরিত হয়ে উঠবে এই পূজা মণ্ডপ।
এদিকে এই আয়োজনকে ঘিরে নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশের পাশাপাশি নিজস্ব উদ্যোগেও সেচ্ছাসেবক নিয়োগ করা হয়েছে।
আয়োজকরা জানান, মন্দিরের অতীত ঐতিহ্য ধরে রাখতে এবার দুর্গোৎসবে পাঁচশ’ প্রতিমা তৈরির ইচ্ছে থাকলেও সামাজিক ও অর্থনৈতিকসহ নানান বিষয় চিন্তা করে ২৫১টি প্রতিমা দিয়ে দুর্গাপূজোর আয়োজন করা হয়েছে। তবে ধারাবাহিকভাবে আগামীতে প্রতিমার সংখ্যা পাঁচশ’ এবং এক হাজার একটি প্রতিমা করার ইচ্ছা রয়েছে। এবারের আয়োজনে গত বছরের সাথে নতুন অনেক কিছুই যুক্ত হচ্ছে। যেমন বিগত বছরগুলোর মতো এবারেও দুর্গাপূজা যে কয়দিন চলবে প্রতিদিন ২-৩ হাজার লোকের জন্য প্রসাদের ব্যবস্থা রাখা হবে। দুরদূরান্ত থেকে আসা মানুষের জন্য খাবারের পাশাপাশি থাকার ব্যবস্থাও নিশ্চিত করা হবে। অসহায়, দুঃস্থ নারীদের মাঝে বস্ত্র বিতরণ এবং দরিদ্র-মেধাবী ও কন্যাদায়গ্রস্থ বাবা-মাকে মন্দিরের পক্ষ থেকে আর্থিক সহায়তা দেয়া হবে।
জানা গেছে, এবারের পূজোয় নতুন প্রজন্মের জন্য কবুতরখালীর ডাক্তার বাড়ি ও রাজ মন্দির প্রাঙ্গনে অনেককিছু সংযোজন করা হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরালের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা বিভিন্ন বই, তথ্য ও চিত্র নিয়ে বঙ্গবন্ধু কর্নার, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে লেখা বইয়ের সংযোজন ঘটিয়ে শেখ হাসিনা কর্নার, মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন তথ্য-চিত্র নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ কর্নার এবং শেখ রাসেল কর্নার করা হয়েছে। যেখান থেকে মানুষ জাতির পিতা, মুক্তিযুদ্ধ, প্রধানমন্ত্রী ও শেখ রাসেল সম্পর্কে বিভিন্ন কিছু জানতে পারবেন।
এছাড়া পুরো ডাক্তার বাড়ি ও মন্দির এলাকাকে ঘিরে বিভিন্ন লেখক, মনিষী, বিখ্যাত ব্যক্তিদের বাণী সংবলিত প্লাকার্ড, ছবি, ব্যানার সাটানো হয়েছে। একইসাথে প্রতিদিন প্রজেক্টরের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধসহ পূর্বের পূজা নিয়ে তৈরি প্রদর্শন করা হবে।
রাজ মন্দির কমিটির সভাপতি ডা. সুদীপ কুমার হালদার দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, প্রতিবছর রাজ মন্দিরের দুর্গাপূজার আয়োজনে কয়েক লাখ লোকের সমাগম ঘটে। আর আগতদের সেবায় ডাক্তার বাড়ির সব লোকজন নিজেদের নিয়োজিত করেন। গত একমাস ধরে আমাদের ৪০জন আত্মীয়-স্বজন পূজার আয়োজনকে ঘিরে শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। সাতক্ষীরার শংকর পালের নেতৃত্বে ছয়জন পাল ২৫১টি প্রতিমা তৈরির কাজ করেছেন।
তিনি আরও বলেন, এবারেও সার্বিক নিরাপত্তায় সিসি ক্যামেরা স্থাপনসহ নিজস্ব ভলান্টিয়ার ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কাজ করছেন। পূজা শুরুর দিন থেকে শেষপর্যন্ত প্রতিদিন আগতদের জন্য অন্ন প্রসাদের ব্যবস্থা করা হবে। রাজ মন্দিরের পাশেই নারী ও শিশুদের জন্য ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার, নারীদের স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে কাউন্সিলিং পয়েন্ট ও ফ্রি স্যানিটারি ন্যাপকিন বিতরণ, পূজা চলাকালে টানা চারদিন বিকেল তিনটা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্পের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাঁচটি তোরণের পাশাপাশি মন্দির এলাকায় পদ্মা সেতুর আদলে একটি স্প্যান বানানো হয়েছে। যারমধ্যে লাইব্রেরিসহ তিনটি কর্নার স্থাপন করা হয়েছে। রয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আলাদা বসার স্থান।
রাজ মন্দিরের পুজার আয়োজক অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক শৈলেশ্বর হালদার দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, এখানে দুর্গাপূজার আয়োজনের পাশেই রয়েছে, মা কালির মন্দির, মা মনসার মন্দির, শিব ঠাকুর মন্দির, বাবা লোকনাথের মন্দির, মা স্বরস্বতীর মন্দির। তিনি আরও বলেন, আমরা চাই উৎসবমুখর পরিবেশে শান্তিপূর্ণভাবে পুজোর আয়োজন শেষ করতে। তাই স্থানীয় প্রশাসন আমাদের সার্বিক সহযোগিতা করছেন।
অপর আয়োজক নমিতা হালদার বলেন, তার চার সন্তানসহ স্বজনদের অংশগ্রহণে কয়েকবছর ধরে বৃহৎ আকারে রাজ মন্দিরে দুর্গাপূজার আয়োজন চলছে। বিশেষ করে ডা. সুদীপ কুমার হালদার, তার স্ত্রী ডা. স্নিগ্ধা চক্রবর্তী পুরো আয়োজনের সব কাজের দেখভাল করে থাকেন। যাতে পুজোতে আসা কোন মানুষ কষ্ট না পান। আমাদের এখানে হিন্দুধর্মালম্বীদের পাশাপাশি বিভিন্ন ধর্মের মানুষ আসেন পূজা দেখতে।
স্থানীয় বাসিন্দা হরিদাস নন্দি বলেন, পূজোকে ঘিরে আশপাশের মানুষদের মাঝে বেশ উৎসাহ দেখা দিয়েছে। এ মন্দিরকে ঘিরে আয়োজন করা হয়েছে গ্রামীণ মেলার।
উল্লেখ্য, নিজের ইচ্ছে ও বাবার মানত পূরণ করার লক্ষ্যে দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর ডা. সুদীপ কুমার হালদার কবুতরখালীর ডাক্তার বাড়ির রাজ মন্দিরে গত ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে ৪১টি প্রতিমা দিয়ে প্রথম বৃহৎ আকারে দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। এরপরের বছর একশ’ এবং তার পরের বছর আড়াইশ’ প্রতিমা নিয়ে দুর্গাপূজার আকার বড় হতে থাকে। তবে করোনার কারণে দুই বছর বৃহৎ আকারের আয়োজন বন্ধ থাকার পর এবার ২৫১টি প্রতিমা নিয়ে পূজোর আয়োজন করা হয়েছে। পূজা মণ্ডপ এলাকায় বাহারী রঙের আলোকসজ্জার মাঝেই সাজানো হয়েছে কৃত্তা রাক্ষসী, কুম্ভকর্ন, জগদ্ধাত্রী, কালী, মনসা, স্বরস্বতী, শিব, রাধা কৃষ্ণ, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু, লক্ষী নারায়ন, রাম সীতা, দুর্গা, হনুমানসহ নানা প্রতিমা।