২৭ শতাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয় জরাজীর্ণ, বৃষ্টিতে পানি পড়ে শ্রেণিকক্ষে

দৈনিকশিক্ষা প্রতিবেদক |

দেশের সব শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে জাতীয় পর্যায়ে শিক্ষা সম্প্রসারণের মূল কার্যক্রম হিসেবে ‘তৃতীয় প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি (পিইডিপি-৩)’ বাস্তবায়ন করেছে সরকার। এতে অর্থায়ন করে ১০টি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা। প্রকল্পটির মাধ্যমে বিদ্যালয়ের অবকাঠামো সম্প্রসারণ ও শিক্ষার মানোন্নয়নে ১৮ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। চতুর্থ পর্যায়ে ব্যয় করা হচ্ছে ৩৮ হাজার কোটি টাকা। তবে এখনো ২৬ দশমিক ৫৬ শতাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয় জরাজীর্ণ। দেয়ালে ফাটল, প্লাস্টার খসে গেছে, দরজা ভাঙা। ভবনের ছাদে ফাটল থাকায় ১৯ শতাংশ শ্রেণীকক্ষ ঝুঁকিপূর্ণ, বৃষ্টি হলেই পানি পড়ে। এমনকি ২৬ শতাংশ বিদ্যালয়ে নলকূপ নেই কিংবা থাকলেও নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। সরকারের প্রকল্প মনিটরিংয়ের একমাত্র প্রতিষ্ঠান বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সমীক্ষায় এ চিত্র উঠে এসেছে।

পিইডিপি-৩ প্রকল্পটি ২০১১ সালে শুরু হয়ে ২০১৬ সালের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও দু’দফায় সংশোধনী প্রস্তাবের মাধ্যমে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ে। এ প্রকল্পে আর্থিক ব্যয় ৯২ ও অবকাঠামো বাস্তবায়নের হার ছিল ৯৩ শতাংশ। এর মাধ্যমে নতুন করে ৩৯ হাজার শ্রেণীকক্ষ ও নলকূপ স্থাপন করা হয়। ৩১ হাজারের বেশি টয়লেট মেরামত এবং সাড়ে ২৮ হাজার ওয়াশব্লক নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা উপকরণ বিতরণসহ নানামুখী কাজ করা হয় প্রকল্পটির মাধ্যমে। 

প্রকল্পের প্রভাব মূল্যায়নে আইএমইডির সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, জরাজীর্ণ বিদ্যালয়গুলোর কোনোটায় মেঝেতে গর্ত, লাইট-ফ্যান থাকলেও নষ্ট, কোনোটায় আবার অল্প বৃষ্টি হলেই ছাদ দিয়ে পানি পড়ে। ১৩ শতাংশ বিদ্যালয়ে কোনো নলকূপ নেই। একই সংখ্যক বিদ্যালয়ে নলকূপ থাকলেও ব্যবহার অযোগ্য কিংবা নষ্ট। সমীক্ষায় ১৩ শতাংশ শিক্ষার্থী তাদের শ্রেণীকক্ষ নিয়ে নানা সমস্যার কথা জানিয়েছে। তাদের মধ্যে ৬৩ শতাংশের মতেই শিক্ষার্থীর তুলনায় শ্রেণীকক্ষ ছোট। তাই সবার বসার জায়গা হয় না। ফ্যান না থাকায় গরমে কষ্ট হয় বলে জানিয়েছে ১৪ শতাংশ খুদে শিক্ষার্থী। এমনকি প্রায় ১১ শতাংশ ক্ষেত্রে দেখা গেছে শ্রেণীকক্ষে বিদ্যুৎ নেই। ১৯ শতাংশ বিদ্যালয় ভবনের ছাদে ফাটল থাকায় বৃষ্টি হলেই পানি পড়ে বলে অভিযোগ। আর ১০ শতাংশ বিদ্যালয়ে কোনো কমন রুম নেই। ২৫ শতাংশ বিদ্যালয়ে ছেলে-মেয়েদের জন্য পৃথক টয়লেট নেই। টয়লেট ব্যবহারে সমস্যায় পড়তে হয় বলে জানিয়েছে ১১ শতাংশ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে ১৯ শতাংশই আবার বিদ্যালয়ের টয়লেট সবসময় খোলা না থাকার কথা জানিয়েছে। আর ব্যবহার উপযোগী নয় মনে করে ১১ শতাংশ খুদে শিক্ষার্থী। অপরিষ্কার থাকায় টয়লেটে যেতে খারাপ লাগার কথা জানিয়েছে ৩২ শতাংশ শিক্ষার্থী। বাকিরা আরো নানা সমস্যার কথা তুলে ধরেছে।

বিভিন্ন জেলার ৩২টি উপজেলার ৬০০ বিদ্যালয়ের ১ হাজার ২০০ শিক্ষার্থী, ১ হাজার ২০০ শিক্ষক ও সামনসংখ্যক অভিভাবকসহ ৩ হাজার ৭০০-রও বেশি লোকের তথ্য নিয়ে সমীক্ষা প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। তাতে প্রাথমিকের ৩৭ শতাংশ শিক্ষার্থী লেখাপড়ায় গাইড বইয়ের ওপর তাদের নির্ভরশীলতার কথা জানিয়েছে। আর বিদ্যালয়গুলোয় মাথা খাটানোর মাধ্যমে পাঠদানের কথা বলেছে ৪৩ শতাংশ শিক্ষার্থী। ৫৫ শতাংশ জানিয়েছে, তাদের প্রশ্ন-উত্তরের মাধ্যমে পাঠ দেয়া হয়। আলোচনার মাধ্যমে ৬১ শতাংশ এবং ৩৮ শতাংশ শিক্ষার্থী বলেছে কুশল বিনিময় পদ্ধতিতে তাদের পাঠদান চলে। শিক্ষকদের কাছে প্রাইভেট কিংবা কোচিং করা নিয়ে হয়রানির শিকার হতে হয় বলেও জানিয়েছে অনেক শিক্ষার্থী।  

আইএমইডি তাদের প্রতিবেদনে জরাজীর্ণ এসব বিদ্যালয় মেরামতের সুপারিশ করেছে। একই সঙ্গে টয়লেট ও পানি ব্যবহারের সুবিধা বাড়ানোর জন্য ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ জোরদার করতেও বলেছে সংস্থাটি।

প্রতিবেদনের বিষয়ে আইএমইডির সংশ্লিষ্ট সেক্টরের মহাপরিচালক (যুগ্মসচিব) মু. শুকুর আলী বলেন, ‘স্যাম্পল মডেলিং করে প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে, সুতরাং স্কুলের সংখ্যা কম-বেশি হতে পারে। অনেক আগে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হওয়ায় এখন মেরামতের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। আগের ঠিকাদার হোক কিংবা নতুন করে বরাদ্দ দিয়ে হলেও এসব বিদ্যালয় ঠিক করতে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরকে বলা হয়েছে।’ 

এদিকে বরাদ্দ দিলেও দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও জবাবদিহি না থাকায় যথাযথ কাজ হচ্ছে না বলে মনে করেন ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্টের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমেদ। তিনি বলেন, ‘অবকাঠামো উন্নতির জন্য বাজেট বেশি দেয়া হয়েছে। কিন্তু কাজগুলো ঠিকমতো হচ্ছে না। আমরা এসব বললে বলা হয়, অবকাঠামো ভালো হয়েছে সব জায়গায়। তবে এটা আসলে যথেষ্ট হয়নি।’ 

একটি প্রকৌশল বিভাগের মাধ্যমে সব কাজ কেন্দ্রীয়ভাবে হওয়ায় দুর্নীতি বেশি হয় বলে মনে করেন এ শিক্ষাবিদ। অধ্যাপক মনজুর আহমেদ বলেন, ‘স্থানীয়ভাবে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা দিয়ে কাজ করানো হলে দুর্নীতি কমানো যেত। কিন্তু সেটা করা হয় না। তাই একটি দুর্নীতির চক্র তৈরি হয়েছে। বাঁশ দিয়ে দেয়াল তৈরির মতো ঘটনাও এখানে ঘটেছে।’ 

জরাজীর্ণ বিদ্যালয় সংস্কারের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) ড. মু. নূরুল আমীন চৌধুরী বলেন, ‘স্কুলের মেরামত করা আমাদের রেগুলার কাজ। সারা দেশে হাজার হাজার স্কুল রয়েছে। প্রতি বছর এ খাতে আলাদা বরাদ্দ রাখা হয়। প্রয়োজনের আলোকে এসব কাজ করা হয়।’ নলকূপের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে এ কর্মকর্তা বলেন, ‘এটা হয়তো তারা মাঠে গিয়ে দেখে একটা শতকরা হিসাব বের করেছে। তবে এসব বিষয়ে তথ্য পেলে সঙ্গে সঙ্গে ঠিক করে দেয়ার সিস্টেম আছে। এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সঙ্গে আমাদের চুক্তি করা আছে। কোথাও কাজের ভুলত্রুটি থাকলে পরবর্তী সময়ে এসব ঠিক করে দেয়ার এক ধরনের সমঝোতা আছে। মেজর কোনো সমস্যা থাকলে তাদের তাৎক্ষণিক জানানো হয়।’

আইএমইডির সমীক্ষা প্রতিবেদনে করা সুপারিশ নিয়ে সরকারের পদক্ষেপ জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন বলেন, ‘এসব স্কুলের জন্য আমাদের ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বড় ধরনের মেরামতকাজ আছে। অবকাঠামো পরিবর্তন করে নতুন ভবন করা হচ্ছে, বাউন্ডারি ওয়াল করা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে এসব কাজ হচ্ছে। ভবনের সঙ্গে ওয়াশব্লক তৈরি করা হচ্ছে।’


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আবারো ভর্তি পরীক্ষা চালু হবে - dainik shiksha জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আবারো ভর্তি পরীক্ষা চালু হবে সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি: দুই দিনে আবেদন প্রায় দুই লাখ - dainik shiksha সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি: দুই দিনে আবেদন প্রায় দুই লাখ শিক্ষক নিয়োগেও নামকাওয়াস্তে মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা হয়: গণশিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha শিক্ষক নিয়োগেও নামকাওয়াস্তে মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা হয়: গণশিক্ষা উপদেষ্টা পাঠ্যপুস্তক থেকে শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার বিষয়বস্তু অপসারণের দাবি - dainik shiksha পাঠ্যপুস্তক থেকে শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার বিষয়বস্তু অপসারণের দাবি এসএসসির ফরম পূরণ শুরু ১ ডিসেম্বর - dainik shiksha এসএসসির ফরম পূরণ শুরু ১ ডিসেম্বর কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের গল্প - dainik shiksha পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের গল্প কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক পাঠ্যপুস্তকে একক অবদান তুলে ধরা থেকে সরে আসার আহ্বান হাসনাতের - dainik shiksha পাঠ্যপুস্তকে একক অবদান তুলে ধরা থেকে সরে আসার আহ্বান হাসনাতের ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ - dainik shiksha ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0045380592346191