৪৪ বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে ৬ গুণ

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে ১ ডলারের জন্য ১৫ টাকা ২২ পয়সা লাগত। এখন লাগে ১০৭ টাকা। শতাংশ হিসাবে এই ৪৪ বছর বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর মুদ্রা আমেরিকান ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি মুদ্রা টাকার মান কমেছে ৬০৩ শতাংশ বা ৬ গুণ। এক বছরেই ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে প্রায় ২৫ শতাংশ। শনিবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) দৈনিক বাংলা পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন আবদুর রহিম হারমাছি। 

প্রতিবেদনে আরও জানা যায় শুধু বাংলাদেশ নয়, ছোট-বড় সব দেশের মুদ্রাই ডলারের বিপরীতে দর হারিয়েছে; এই ৪৪ বছরে ভারতীয় মুদ্রা রুপির মান কমেছে ৯৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ। ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে ১ ডলারের জন্য মাত্র ৮ রুপি খরচ করতে হতো; এখন লাগছে ৮৩ টাকা। চীনা মুদ্রা ইউয়ান ও ডলারের বিনিময় হার এখন ৬ দশমিক ৮৩ ইউয়ান। অর্থাৎ ১ আমেরিকান ডলারের জন্য ৬ দশমিক ৮৩ ইউয়ান খরচ করতে হয়। ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে লাগত ১ দশমিক ৬২ ইউয়ান। এ হিসাবে ৪৪ বছরে ডলারের বিপরীতে ইউয়ানের মান কমেছে ৩২১ দশমিক ৬০ শতাংশ।

চরম অর্থনৈতিক সংকটে ডুবতে থাকা পাকিস্তানের মুদ্রার অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। প্রতিদিনই কমছে দেশটির মুদ্রার মান; প্রতি ডলারের জন্য এখন হাতে গুনে ২৭৫ পাকিস্তানি রুপি দিতে হচ্ছে। ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে লাগত মাত্র ৫ রুপি। শতাংশ হিসাবে ৪৪ বছরে ডলারের বিপরীতে পাকিস্তানি রুপির মান কমেছে ৫৪০০ শতাংশ।

উন্নয়নে পাকিস্তানকে বাংলাদেশের ছাড়িয়ে যাওয়ার বিষয়টি এখন আর নতুন কোনো তথ্য নয়। বছর বছর ‍দুই দেশের মধ্যে নানা সূচকে বাড়ছে ব্যবধান। আর এর প্রভাব পড়েছে দুই দেশের মুদ্রার মানেও। এখন বাংলাদেশের টাকার মান পাকিস্তানের মুদ্রা রুপির প্রায় তিন গুণ। বাংলাদেশের ১০৭ টাকায় পাকিস্তানে পাওয়া যায় এখন ২৭৫ রুপি। অথচ স্বাধীনতার পর পরই চিত্রটা ছিল পুরো উল্টো। তখন পাকিস্তানের ১০০ রুপির মান ছিল বাংলাদেশের ১৬৫ টাকা।

ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতনের ইতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পড়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর। তবে গত এক বছরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় এক লাফে ২৫ শতাংশের মতো যে দরপতন হয়েছে, তাতে বড় বিপদ বয়ে এনেছে বলে মনে করেন তিনি।

দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর বলেন, ‘এই যে আমাদের রপ্তানি আয় গত অর্থবছরে ৫২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে, প্রতিবছর ২৩-২৪ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আসছে, তাতে কিন্তু টাকার দরপতনের একটা বড় অবদান আছে। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে টাকার মান সমন্বয় করতেই হবে।’ 

তিনি বলেন, ‘আমরা বড় যে ভুলটি করেছি, সেটা হলো আমরা দীর্ঘদিন টাকার মানটা ধরে রেখেছিলাম। দুই বছরের বেশি সময় টাকা-ডলারের বিনিময় হার ৮৪ টাকায় স্থির রেখেছিলাম আমরা। করোনা মহামারি স্বাভাবিক হওয়ার পর আমদানি বাড়তে থাকে। ডলারের চাহিদা বাড়তে থাকে। দামও বাড়তে শুরু করে। এরপর শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। ডলারসংকট চরম আকার ধারণ করে। এখনো সে সংকট চলছে। কত দিনে স্বাভাবিক হবে, কিছুই বলা যাচ্ছে না। আমরা যদি একসঙ্গে না করে ধীরে ধীরে টাকার মানটা কমাতাম, তাহলে এই নাজুক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতাম না।’

২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা বিভাগ ও মুদ্রানীতি বিভাগের যৌথ এক গবেষণাপত্রে বলা আছে, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ৩ জানুয়ারি প্রথম মুদ্রা বিনিময় হার নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সে সময় যুক্তরাজ্যের ১ পাউন্ড স্টার্লিংয়ে পাওয়া যেত বাংলাদেশি ১৮ দশমিক ৯৬ টাকা। তখন পাউন্ডের বিপরীতে পাকিস্তানের মুদ্রার মান ছিল ১১ দশমিক ৪৩ রুপি। সেই হিসাবে পাকিস্তানে তখন ১ রুপির বিপরীতে বাংলাদেশকে খরচ করতে হতো ১ দশমিক ৬৫ রুপি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ আশরাফ আলী মুদ্রা বিনিময় হার নিয়ে কাজ করতেন। ‘ফরেন এক্সচেঞ্জ’ শিরোনামে একটি বইও লিখেছেন তিনি। সেই বইতে বলা হয়েছে, ডলারের সঙ্গে টাকার বিনিময় হার নির্ধারণ হয় আশির দশকের শুরুর দিকে। তবে স্বাধীনতার পর ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে ডলারের সঙ্গে টাকার বিনিময় হারের একটি হিসাব করা হয়েছিল। তখন ১ ডলারের বিপরীতে ৭ দশমিক ৮৬ টাকা এবং পাকিস্তানে ৪ দশমিক ৭৬ রুপি ছিল।

ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির দীর্ঘকাল পরও পাকিস্তানের মুদ্রা বেশ শক্তিশালী ছিল। তবে সেই অবস্থানে এখন আর নেই দেশটি। বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ঘাটতি, বৈদেশিক ঋণ ও মূল্যস্ফীতির চাপে রুপির অবস্থান এখন বেশ নাজুক। বরং বাংলাদেশের টাকা এখন দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী মুদ্রায় পরিণত হয়েছে।

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে দেশ স্বাধীন হলেও বাংলাদেশে নিজস্ব মুদ্রার প্রচলন শুরু ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে ৪ মার্চ। এর আগে পাকিস্তানের রুপি দিয়েই হতো লেনদেন। তবে বৈদেশিক লেনদেনের জন্য বিনিময় হার নির্ধারণ করতে হয়েছিল টাকা প্রচলনের আগেই। তখন আইএমএফ থেকে শর্ত দেয়া হতো যে একবার একটি বিনিময় হার ঠিক করা হলে আইএমএফকে না জানিয়ে সেই হার পরিবর্তন করা যাবে না। এ ধরনের বিনিময় হার নির্ধারণকে ফিক্সড রেট পদ্ধতি বলা হয়। বর্তমানে ফ্লোটিং রেট পদ্ধতিতে প্রতিনিয়ত মুদ্রার বিনিময় হার পরিবর্তিত হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, ১৯৭৮-৭৯ অর্থবছর শেষে টাকা-ডলারের বিনিময় হার ছিল ১৫ টাকা ২২ পয়সা। অর্থাৎ ১ ডলারের জন্য তখন ১৫ টাকা ২২ পয়সা খরচ করতে হতো। পাঁচ বছর পর ১৯৮৪-৮৫ অর্থবছরে প্রতি ডলারের জন্য লাগত ২৫ টাকা ৯৬ পয়সা। ১৯৮৫-৮৬ অর্থবছর শেষে লেগেছে ২৯ টাকা ৮৯ পয়সা। ১৯৯২-৯৩ অর্থবছরে খরচ করতে হয়েছে ৩৯ টাকা ১৪ পয়সা। ১৯৯৩-৯৪ অর্থবছর শেষে তা বেড়ে হয় ৪০ টাকা।

২০০০-০১ অর্থবছরে টাকা-ডলারের বিনিময় হার বেড়ে হয় ৫৩ টাকা ৯৬ পয়সা। ২০০১-০২ অর্থবছর শেষে তা আরও বেড়ে ৫৭ টাকা ৪৫ পয়সা হয়। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ১ ডলারের জন্য খরচ করতে হয় ৬৮ টাকা ৮৩ পয়সা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা বেড়ে হয় ৭৯ টাকা ১২ পয়সা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে টাকা-ডলারের বিনিময় হার ৮০ টাকা ছাড়িয়ে ৮২ টাকা ১০ পয়সায় ওঠে। ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে তা আরও বেড়ে ৮৬ টাকা ৩০ পয়সা হয়।

এর পর থেকে পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটতে থাকে ডলার। অস্থির হয়ে ওঠে মুদ্রাবাজার। নানা পদক্ষেপ নিয়েও বাজারে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে পারে না বাংলাদেশ ব্যাংক। ডলারের দাম নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত বছরের এপ্রিল থেকে ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক এ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছে। তার পরও ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে পরে সেই দায়িত্ব তুলে দেয়া হয় ব্যাংকগুলোর হাতে।

ব্যাংকগুলোর নির্বাহীদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়, ডলারের দাম তাদেরই নির্ধারণ করে দিতে হবে, বাজারের ওপর ছাড়া যাবে না। এর পর থেকে ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এবিবি ও বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাফেদার নেতারা মিলে প্রবাসী আয় ও রপ্তানিতে ডলারে দাম নির্ধারণ করছেন। ইতিমধ্যে একাধিক দফায় ডলারের দাম পরিবর্তনও করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও বাজার স্বাভাবিক হচ্ছে না।

গত বৃহস্পতিবার আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার ১০৭ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এক বছর আগে এই দর ছিল ৮৬ টাকা। তবে খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটে প্রতি ডলার ১১২ থেকে ১১৩ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষকদের বদলির বিষয়ে সর্বশেষ - dainik shiksha শিক্ষকদের বদলির বিষয়ে সর্বশেষ শিক্ষা ক্যাডারে অধ্যাপক হচ্ছেন যারা - dainik shiksha শিক্ষা ক্যাডারে অধ্যাপক হচ্ছেন যারা ভিসি নিয়োগের দাবিতে এবার উত্তরবঙ্গ ব্লকেড বেরোবি শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ভিসি নিয়োগের দাবিতে এবার উত্তরবঙ্গ ব্লকেড বেরোবি শিক্ষার্থীদের মসজিদ ইবাদাতের পাশাপাশি জ্ঞানচর্চারও একটি কেন্দ্র হতে পারে: ঢাবি উপাচার্য - dainik shiksha মসজিদ ইবাদাতের পাশাপাশি জ্ঞানচর্চারও একটি কেন্দ্র হতে পারে: ঢাবি উপাচার্য ঢাকা বোর্ডের পরিদর্শক আবুল মনছুর ভূঁঞার ঘুষ বাণিজ্য - dainik shiksha ঢাকা বোর্ডের পরিদর্শক আবুল মনছুর ভূঁঞার ঘুষ বাণিজ্য দীপু মনি-রতন সিন্ডিকেটের ফিরোজই শিক্ষা অধিদপ্তরের এ ডি! - dainik shiksha দীপু মনি-রতন সিন্ডিকেটের ফিরোজই শিক্ষা অধিদপ্তরের এ ডি! ছাত্র আন্দোলনে নিহতদের ‘জাতীয় বীর’ ঘোষণার দাবি জামায়াতের - dainik shiksha ছাত্র আন্দোলনে নিহতদের ‘জাতীয় বীর’ ঘোষণার দাবি জামায়াতের ভারতে পাঠ্যবই ছাপানোর বিপক্ষে ৯২ শতাংশ বাংলাদেশি - dainik shiksha ভারতে পাঠ্যবই ছাপানোর বিপক্ষে ৯২ শতাংশ বাংলাদেশি ভয়ংকর বিপদের মধ্যে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী - dainik shiksha ভয়ংকর বিপদের মধ্যে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0062570571899414