৫৯ বছরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

ইমরান ইমন, দৈনিক শিক্ষাডটকম |

৫৮ পেরিয়ে ৫৯ বছরে পদার্পণ করলো অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ক্যাম্পাস চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের তৃতীয় এবং চারটি পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করা এই বিশ্ববিদ্যালয় এখন পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয়, যা ২৩০০ একরের বৃহৎ পাহাড়ি ও সমতল ভূমি নিয়ে বেষ্টিত।

প্রতিষ্ঠাকালীন বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস ও অর্থনীতি-এ চারটি বিভাগ, ৭ জন শিক্ষক ও ২০০ শিক্ষার্থী নিয়ে শুরু হওয়া এ বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ১০টি অনুষদ, ৪৮টি বিভাগ, ৬টি ইনস্টিটিউট রয়েছে। অধ্যয়ন করছেন প্রায় ২৮ হাজার শিক্ষার্থী, রয়েছে ৯২০ জন শিক্ষক। শিক্ষার্থীদের থাকার জন্য রয়েছে মোট ১৩টি আবাসিক হল (ছেলেদের ৮টি, মেয়েদের ৫টি) ও একটি ছাত্রাবাস।

বিশ শতাব্দীর শুরুর দিকে চট্টগ্রাম বিভাগে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় না থাকায় চট্টগ্রামের অধিবাসীরা স্থানীয়ভাবে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন অনুভব করে। ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ ডিসেম্বর, কলকাতায় অনুষ্ঠিত জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সর্বভারতীয় সম্মেলনে মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী সভাপতির ভাষণে চট্টগ্রাম অঞ্চলে একটি ‘ইসলামিক ইউনিভার্সিটি’ নির্মাণের কথা উপস্থাপন করেন এবং একই লক্ষ্যে তিনি চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার দেয়াঙ পাহাড়ে বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের জন্য ভূমি ক্রয় করেন। দুই বছর পর, ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ ফেব্রুয়ারি নূর আহমদ চেয়ারম্যান বঙ্গীয় আইন পরিষদে চট্টগ্রামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক দাবি উত্থাপন করেন।

ষাটের দশকে তৎকালীন পাকিস্তানের দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৬০-১৯৬৫) প্রণয়নকালে চট্টগ্রামে একটি ‘বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়’ স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণের স্থান হিসেবে শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত চট্টগ্রাম সরকারি কলেজকে সম্ভাব্য ক্যাম্পাস হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের জনশিক্ষা উপ-পরিচালক মোহাম্মদ ফেরদাউস খান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার একটি প্রাথমিক খসড়া পরিকল্পনা তৈরি করেন। একই বছর, ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনী প্রচারণায় খান বাহাদুর ফজলুল কাদের চৌধুরী এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সাধারণ প্রতিশ্রুতি দেন এবং নির্বাচন পরবর্তীকালে তিনি কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী নির্বাচিত হলে চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় আনুষ্ঠানিক উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের স্থানে এই বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত পরিবর্তিত হওয়ার পর, ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দের ৭ মে চট্টগ্রামবাসীর উদ্যোগে স্থানীয় মুসলিম হলে এক প্রতিবাদসভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রধান অতিথির ভাষণে চট্টগ্রামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পক্ষে মতপ্রকাশ করেন এবং তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। পরবর্তীকালে ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে ৩০ ডিসেম্বর, ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদ’ নামে আরেকটি পরিষদ গঠিত হয়। এই সকল সংগঠনের উদ্যোগে বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ ও স্মারকলিপি প্রদান, পত্রপত্রিকায় বিবৃতি, সেমিনার অনুষ্ঠিত হতে থাকে। ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দের ৮ জানুয়ারি, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে চট্টগ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়।

১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ নভেম্বর, খান বাহাদুর ফজলুল কাদের চৌধুরী পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পিকার মনোনীত হন। প্রথমদিকে এ বিশ্ববিদ্যালয় সিলেট, কুমিল্লা ও নোয়াখালিতে স্থাপনের পরিকল্পনা করা হলেও ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দের ১২ ডিসেম্বর, রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানের অনুপস্থিতিতে মন্ত্রীসভার এক বৈঠকে সভাপতিত্বকালে খান বাহাদুর ফজলুল কাদের চৌধুরী কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী এটিএম মোস্তফাকে বিশ্ববিদ্যালয়টি কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রামে স্থাপনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন।

১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দের ৯ মার্চ তার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত একটি জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিলের বৈঠকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ মঞ্জুর করা হয়। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডক্টর এম ওসমান গণিকে চেয়ারম্যান এবং ডক্টর কুদরাত-এ-খুদা, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, এম ফেরদৌস খান ও ড. মফিজউদ্দীন আহমদকে সদস্য নির্বাচন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্থান নির্বাচন কমিশন’ গঠিত হয়। এই কমিশন সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করে হাটহাজারী উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নের জঙ্গল পশ্চিম-পট্টি মৌজার নির্জন পাহাড়ি ভূমিকে প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান হিসেবে সুপারিশ করে। ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৭-১৯ জুলাই পাকিস্তানের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি খান বাহাদুর ফজলুল কাদের চৌধুরীর সভাপতিত্বে ইসলামাবাদে জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিলের সভায় ‘স্থান নির্বাচন কমিশন’-এর সুপারিশের ভিত্তিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং এর চূড়ান্ত অনুমোদন প্রদান করা হয়। ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ আগস্ট পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।

১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দের ৩ ডিসেম্বর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ও বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের প্রাক্তন কিউরেটর ড. আজিজুর রহমান মল্লিককে (এআর মল্লিক) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্প-পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। এরপর ড. আজিজুর রহমান মল্লিক চট্টগ্রাম শহরের নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটির ৩ নং সড়কের ‘কাকাসান’ নামের একটি ভবনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্পের অফিস স্থাপন করেন। ড. আজিজুর রহমান মল্লিক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ছিলেন। ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ ডিসেম্বর, এক সরকারি প্রজ্ঞাপন বলে তৎকালীন পাকিস্তান শিক্ষা পরিদপ্তরের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সমস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্প অফিসে বদলি করা হয়। স্থপতি মাজহারুল ইসলামের ‘বাস্তকলা’ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করা হয়। প্রাথমিকভাবে ১টি দ্বিতল প্রশাসনিক ভবন, বিভাগীয় অফিস, শ্রেণিকক্ষ ও গ্রন্থাগারের জন্য একতলা ভবন তৈরি করার পাশাপাশি শিক্ষক ও ছাত্রদের আবাসনের ব্যবস্থাও করা হয়। অবশেষে ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ নভেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। ১৮ নভেম্বর তাই ‘বিশ্ববিদ্যালয় দিবস’ পালিত হয়ে থাকে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে হাটহাজারী উপজেলায় অবস্থিত হওয়াতে শিক্ষার্থীদের যাতায়াতে ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে চালু হয় শাটল ট্রেন। আর এ শাটল ট্রেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান আকর্ষণ। বর্তমানে বিশ্বের একমাত্র শাটল ট্রেনের বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন রয়েছে ২১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। চবিতে রয়েছে চট্টগ্রামের সর্ববৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার, যাতে রয়েছে সাড়ে তিন লক্ষের বেশি বই, দুর্লভ সংগ্রহশালা। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক উল্লেখযোগ্য প্রাক্তন শিক্ষক-শিক্ষার্থী শিক্ষা গ্রহণ ও অধ্যাপনা করেছেন, যার মধ্যে ১ জন নোবেলবিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও একাধিক একুশে পদক বিজয়ী রয়েছেন।
সমাবর্তন অনুষ্ঠান একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষ্ঠান। শিক্ষার্থীদের কাছে এ অনুষ্ঠান অত্যন্ত আবেগের ও মর্যাদার। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, দেশের এই শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়টির ৫৮ বছরে সমাবর্তন অনুষ্ঠান হয়েছে মাত্র ৪টি! 

এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক অর্জনের সঙ্গে এর অনেক ব্যর্থতাও আছে। সমস্যাও আছে অনেক। চলমান এ সমস্যা, সংকটগুলোর সমাধানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন উদ্যোগী হবে-এটাই প্রত্যাশা। বর্তমান উপাচার্য প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইয়াহইয়া আখতার বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নতি, চলমান সমস্যা ও সংকটসমূহ নিরসনে কার্যকর ভূমিকা রাখবেন--এটাই প্রত্যাশা। ৫৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমৃদ্ধি কামনা করছি।

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
‘২৬ লাখ টাকা’র প্রধান শিক্ষক নাজমার শাস্তি দাবি আনন্দময়ী স্কুল ছাত্রীদের - dainik shiksha ‘২৬ লাখ টাকা’র প্রধান শিক্ষক নাজমার শাস্তি দাবি আনন্দময়ী স্কুল ছাত্রীদের জানুয়ারিতেই শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়া হবে: গণশিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha জানুয়ারিতেই শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়া হবে: গণশিক্ষা উপদেষ্টা ইএফটিতে বেতন: ব্যাংক হিসাব নিয়ে এমপিও শিক্ষকদের অসন্তোষ - dainik shiksha ইএফটিতে বেতন: ব্যাংক হিসাব নিয়ে এমপিও শিক্ষকদের অসন্তোষ পবিপ্রবিতে গাঁজাসহ ৫ মাদকসেবী আটক - dainik shiksha পবিপ্রবিতে গাঁজাসহ ৫ মাদকসেবী আটক ভর্তিতে লটারি বাতিলের দাবিতে সড়ক আটকে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ - dainik shiksha ভর্তিতে লটারি বাতিলের দাবিতে সড়ক আটকে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ প্রাথমিকের ১০ম গ্রেডের দাবি সর্বজনীন - dainik shiksha প্রাথমিকের ১০ম গ্রেডের দাবি সর্বজনীন কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ - dainik shiksha ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0049400329589844