শিরোনামে যেমনটি উল্লেখ করা হয়েছে – ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ এ দেশের এমন একটি উপাখ্যান যা বিগত ১৬ বছর ধরে অপ্রকাশিত রাখা হয়েছে। কিন্তু ‘সত্য’ তো আগ্নেয়গিরির মতই, সুযোগ পেলেই বিস্ফোরণ ঘটিয়ে লাভা উদ্গীরণ করে নিজেকে প্রকাশ করবে। ’৭৫ এর ৭ নভেম্বর ছিলো এমন একটি দিন যেদিন দেশপ্রেমী সিপাহী-জনতা এক কাতারে আসতে কাল বিলম্ব ঘটলে ৪ বছর বয়সী বাংলাদেশ নামক শিশু রাষ্ট্রটি হয়ত প্রতিবেশি কোনো রাষ্ট্রের আগ্রাসনের কবলে পড়ে অকাল মৃত্যুবরণ করতো –এমনই অভিমত ব্যক্ত করেছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মুহম্মদ ইব্রাহিম বীর প্রতীক। তিনি আরো বলেন তদানিন্তন সেনাবাহিনীর অত্যন্ত জনপ্রিয় অফিসার জেনারেল জিয়াউর রহমানের সময়োচিত দক্ষতা দেখানোর কারণেই সেদিন সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত রাষ্ট্রটির সার্বভৌমত্ব রক্ষা পেয়েছিলো, ব্যাপক প্রাণহানি থেকে জনগণ রক্ষা পেয়েছিলো। যে বিপথগামী, অপরিণামদর্শী সেনাকর্মকর্তার ষড়যন্ত্রে দেশে এমন বিভীষিকা নেমে এসেছিল, সেই সেনাকর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার(স্বঘোষিত মেজর জেনারেল) খালেদ মোশাররফকেও সিপাহী-জনতা উৎখাত করে তার মৃত্যু ঘটিয়েছিলো। কোনো হত্যাই কাম্য হতে পারে না কিন্তু দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রশ্নে এমন হত্যাকাণ্ডের আর কোনো বিকল্প থাকে না। ব্রিগ্রেডিয়ার খালেদ মোশাররফ নিজে শুধু একজন চৌকস সেনা অফিসারই ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন দক্ষ ও মেধাবী সেক্টর কমান্ডার। অনুমান করা হয় প্রতিবেশি রাষ্ট্রের ইন্ধন এবং উস্কানিতে তিনি ঐ বছর ১৫ আগষ্ট সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বিপ্লব ঘটিয়ে মোশতাক সরকারেকে উৎখাত করে ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেছিলেন।
কী ঘটেছিলো সেদিন, আর কেনোই বা ঘটেছিলো? অল্প কথায় এ প্রশ্নের জবাব দেয়া প্রায় অসম্ভব। ১৫ আগস্ট ’৭৫ এর অভ্যুত্থানে শেখ মুজিব সপরিবারে নিহত হলে অভ্যুত্থানকারীরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করে মুজিবের সহকর্মী এবং মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদকে। সেনাপ্রধান শফিউল্লাহকে সরিয়ে দিয়ে জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনী প্রধান নিয়োগ করা হয়। দেশে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের বিচার করা যাবে না মর্মে ইনডেমনিটি আদেশ জারি করা হয় এবং মুজিব প্রবর্তিত বাকশাল প্রথা বাতিল করা হয় এবং সরকারের চরিত্রে ইসলামী বিশ্বাস ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা হয়।
১৫ আগষ্টের হত্যাকাণ্ডে ক্ষুব্ধ খালেদ মোশাররফ দেশের এ পরিবর্তন মেনে নিতে পারেননি। তিনি ভেতরে ভেতরে ফুঁসে উঠছিলেন, প্রতিশোধের সুযোগ খুঁজছিলেন এবং তখন থেকেই গোপন তৎপরতা অব্যাহত রাখেন। সুযোগ বুঝে তিনি ৩ নভেম্বর ’৭৫ সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানকে পদচ্যুত এবং বন্দি করেন এবং নিজেকে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত করে সেনাবাহিনী প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ জিল্লুর রহমান খান তার ‘লিডারশিপ ক্রাইসিস ইন বাংলাদেশ’ গ্রন্থে বলেছেন, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ছিলেন আপাদমস্তক একজন মুজিববাদী এবং তিনি চেয়েছিলেন মোশতাককে ক্ষমতাচ্যুত করে কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি চার নেতাকে মুক্ত করে তাদের নেতৃত্বে একটি সরকার গঠন করতে, আর এ জন্যই তিনি সেনাবাহিনীর পদ দখল করলেও সরকারপ্রধান হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করেননি। কিন্তু খালেদ মোশাররফের সে পরিকল্পনা ভেস্তে যায় কারণ, প্রথমত তিনি ট্যাঙ্ক বাহিনীর সমর্থনে আগস্ট অভ্যুত্থানকারীদের প্রতিরোধের প্রেক্ষিতে ৬ নভেম্বরের পূর্বে বঙ্গভবনের দখল নিতে পারেননি এবং দ্বিতীয়ত ৪ নভেম্বরের ভোরের আলো ফোটার আগেই কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক জাতীয় চার নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
প্রখ্যাত ফরাসি সাংবাদিক অ্যান্থনী ম্যাস্কারেনহাস যিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরু থেকে দীর্ঘদিন বাংলাদেশে অবস্থান করছিলেন তিনিও জিল্লুর রহমান খানের বর্ণনাকে সমর্থন করেন। ম্যাসকারেনহাস তার ‘’বাংলাদেশ আ লিগ্যাসি অব ব্লাড’’ গ্রন্থে আরো বলেন, ’৭৫ এর ৩, ৪ ও ৫ নভেম্বর - এই তিন দিন বাংলাদেশে আদৌ কোনো সরকার ছিলো না যতক্ষণ পর্যন্ত না ৬ নভেম্বর প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম শপথ গ্রহণ করেন। ঐ তিন দিন মোশতাক আহমেদের নামে সরকার পরিচালিত হলেও কার্যত তিনি ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ও কর্ণেল শাফায়াত জামিল কর্তৃক বঙ্গভবনে আটক ছিলেন। ম্যাসকারেনহাস আরো বলেন, খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থান পরিকল্পনা সুসংহত ছিলনা বরং সে পরিকল্পনায় যথেষ্ট ফাঁক ছিলো। তিনি চাইলে ৪৬ পদাতিক ডিভিশনকে ব্যবহার করে সেনাপ্রধানের আসনে নিজেকে পোক্ত করতে পারতেন অথবা নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে তার অবস্থান সুদৃঢ় করতে পারতেন কিন্তু সে কাজটি করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে তিনি একটি রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি করেছিলেন যার মাশুল দিতে হয়েছিলো তার নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে।
এ প্রসঙ্গে হায়দার আকবর রনো তার ‘মার্কসবাদ এবং সশস্ত্র সংগ্রাম’ গ্রন্থে বলেন, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ক্ষমতা দখল করায় সাধারণ মানুষ তীব্র বিরোধিতা করতে থাকে। তারা ধরে নেয়, খালেদ মোশাররফের মাধ্যমে মুজিববাদীরা আবারো ক্ষমতায় ফিরে আসছে। তারা আরো বিশ্বাস করতে থাকে যে, খালেদ মোশাররফের পেছনে ভারতের আশীর্বাদ রয়েছে। এখানেও খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বের ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। বহুমাত্রিক লেখক মহিউদ্দিন আহমদ তার ‘জাসদের উত্থান পতনঃ অস্থির সময়ের রাজনীতি’ গ্রন্থে বলেন, ঐ সময় সব জায়গায় রটে যায়, ভারতের মদদে খালেদ মোশাররফ অভ্যুত্থান ঘটিয়েছেন। এ সংবাদে জিয়াউর রহমানের প্রতি অনুগত সৈন্যরা বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্ট থেকে ঢাকার দিকে রওনা হন।
মোশতাক এবং ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের সমর্থক গোষ্ঠীও সক্রিয় হয়। কর্ণেল তাহের এ সময় বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নামে সৈনিকদের বিদ্রোহ করবার আহ্বান জানান। ৫ নভেম্বর রাতে গুলশানে আনোয়ার সিদ্দিকের বাসায় সৈনিক সংস্থার কয়েকজন নেতাকে একটি ছাপানো প্রচারপত্র দেয়া হয়। জাসদ, গণবাহিনী ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নামে সেনানিবাসগুলোতেও এই প্রচারপত্র বিলি করা হয় এবং ভারতের দালাল ও বিশ্বাসঘাতক খালেদ মোশাররফ চক্রকে উৎখাত করার আহ্বান জানানো হয়।
বঙ্গভবন দখলে অত্যধিক বিলম্ব ঘটায় খালেদ মোশাররফ সকল দিক থেকে পিছিয়ে পড়েন এবং এই সুযোগে তার প্রতিপক্ষ অর্থাৎ দেশপ্রেমিক সিপাহি জনতা এগিয়ে আসেন কর্ণেল তাহেরের নেতৃত্বে। তারা মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দিদশা থেকে মুক্ত করেন, ঝড়ের গতিতে বিপ্লবী কম্যান্ড কাউন্সিল গঠিত হয়। ৭ নভেম্বর সকালে সৈনিকরা ব্যারাক থেকে বেরিয়ে আসে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে অস্ত্রগুদাম ভেঙে অফিসারদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে মিছিলে হাজির হয়। তারা শ্লোগান দিতে থাকে ‘সিপাহি জনতা এক হও, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ, জিয়াউর রহমান জিন্দাবাদ ইত্যাদি। তারা জিয়াউর রহমানকে ফুলের মালা পরিয়ে জড়িয়ে ধরে এবং আনন্দে আপ্লুত হয়ে কাঁধে নিয়ে নাচতে থাকে।
তবে এ সময় একটি অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে- জিয়ার সঙ্গে হঠাৎ করেই কর্ণেল তাহেরের সম্পর্কে ফাটল ধরে। জিয়ার সঙ্গে তাহেরের কী কথা হয়েছিলো ? কেনো হঠাৎ তাদের সম্পর্কে ফাটল ধরলো- এ নিয়ে নানা বিতর্ক প্রচলিত আছে। মহিউদ্দিন আহমদ তার উল্লিখিত গ্রন্থে তাহেরের অনুজ এবং ঢাকা নগর গণবাহিনীর কমাণ্ডার আনোয়ার হোসেনের দেয়া একটি ভাষ্য উদ্ধৃত করেন। ভাষ্যটি এরকমঃ ‘দেশের ভবিষ্যত প্রশ্নে জিয়ার সঙ্গে তাহেরের বোঝাপড়ার অনেকখানিই আমাদের অজানা এবং তা আর কোনোদিন জানাও সম্ভব হবে না। তবে জিয়ার প্রতি তাহেরের অনুকূল মনোভাবের কিছু কারণ শনাক্ত করা সম্ভব। প্রথমত, জিয়াকে সেনাবাহিনীতে একজন জাতীয়তাবাদী হিসেবে মনে করা হতো। দ্বিতীয়ত, বেতারে আপতিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠের সুবাদে মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে পরিচিত সেনানায়কে পরিণত হন তিনি। তৃতীয়ত, সে সময়কার অধিকাংশ সেনা অফিসারের বিপরীতে জিয়া ছিলেন তুলনামূলকভাবে সৎ এবং সর্বোপরি তাহের ও জাসদের উদ্যোগ-আয়োজন সম্পর্কে জিয়ার মনোভাব ছিলো ইতিবাচক।
দেশপ্রেম এবং স্বদেশচেতনার ঐক্য মানুষকে কীভাবে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী করে ৭ নভেম্বরের প্রতিবিপ্লব তারই জ্বলন্ত উদাহরণ। ৭ নভেম্বর জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবসকে ঘিরে একরাশ সমালোচনা আছে সত্যি কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এর তাৎপর্য ও গুরুত্ব অস্বীকার করবার উপায় নেই। এ ইতিহাস সৃষ্টির নায়ক ছিলো সিপাহী ও সাধারণ জনতা। এ ঘটনা জাতিকে শিক্ষা দেয়- যেকোনো সংকটময় পরিস্থিতিতে জনগণ এবং সেনাবাহিনী ঐক্যবদ্ধ থাকলে যেকোনো অপশক্তিকে প্রতিরোধ করা সম্ভব।
লেখক: যুগ্মপরিচালক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়