বিশ্বে ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে থাকা বাংলাদেশ অন্যতম। তুরস্ক-সিরিয়ার মতো বড় ধরনের ভূমিকম্প বাংলাদেশেও চোখ রাঙাচ্ছে। বাংলাদেশের মূল ভূ-ভাগসহ সীমান্তবর্তী এলাকায় ৫টি চু্যতি (ফল্ট) রয়েছে। ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান ও মিয়ানমার, এই তিনটি পেস্নটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। এর মধ্যে ইন্ডিয়ান ও বার্মা পেস্নটের সংযোগস্থলে অবস্থিত সিলেট, যার উত্তরে ডাউকি ফল্ট। ওই পেস্নটগুলো সক্রিয় থাকায় এবং পরস্পর পরস্পরের দিকে ধাবমান হওয়ায় প্রচুর শক্তি জমা হচ্ছে। আর জমে থাকা ওসব শক্তি যে কোনো সময় ভূমিকম্পের মাধ্যমে বেরিয়ে আসতে পারে।
এ কারণে বাংলাদেশ অতিমাত্রায় ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে। ভূতত্ত্ববিদরা বলছেন, দেশে প্রায়ই ছোট ও মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প হয়ে থাকে। এ অবস্থাকে বিশেষজ্ঞরা বড় ধরনের ভূমিকম্পের পূর্বাভাস বলে মনে করছেন। মূলত ডাউকি ফল্ট ও সিলেট থেকে চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলে গত এক হাজার বছরের মধ্যে বড় ধরনের কোনো ভূমিকম্পের উৎপত্তি না হওয়ায় সিলেটের সাম্প্রতিক ভূমিকম্পগুলোকে বড় ধরনের ভূমিকম্পের পূর্বাভাস বিবেচনা করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। আর ওই মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকা শহরে প্রায় দুই লাখ মানুষের প্রাণহানি হতে পারে। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে রাজধানী। ভূমিকম্পের সময় গ্যাস আর বিদু্যৎ লাইনের কারণে বেশি মানুষ হতাহত হবেন। রাজধানীতে সরু রাস্তার কারণে উদ্ধার অভিযানও চালানো সম্ভব হবে না। বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী জানান, এ অঞ্চলে ঐতিহাসিকভাবে ১৮৭০ থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত তুরস্কের চেয়ে বড় মাত্রার যেমন- ৭ দশমিক ৫ ও ৮ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। ভূমিকম্পের রিটার্ন পিরিয়ড ধরা হয় ১৫০ থেকে ২৫০ বছর। ১৭৬২ সালে আরাকান ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে ৮ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়েছিল, সাইকেল হিসেবে সেটি এখনো ফিরে আসেনি। এরপর ১৮৮৫ সালে একটি ভূমিকম্প হয়েছিল, সেটা হয়তো আরও ১০ থেকে ২০ বছর পর হতে পারে। ১৮৯৭ সালে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের একটি ফল্ট লাইনে ৮ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল। সীমান্ত এলাকায় এরকম আরও ২ থেকে ৩টি ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা রয়েছে।
বঙ্গবন্ধু সেতুর আশপাশে এবং নোয়াখালীতে এরকম ফল্ট লাইন আছে। এ রকম ১৫০ থেকে ২৫০ বছরের যে সাইকেল আছে, সেটি কখন আঘাত হানবে কেউ জানে না। তিনি বলেন, সাধারণত প্রতি ১০০ বছর পর বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়ে থাকে। এ ছাড়াও যে কোনো সময় হতে পারে। ভূমিকম্প মোকাবিলায় সচেতনতা বাড়াতে হবে। জাপানে স্কুলে শিক্ষার্থীরা ট্রেনিং ও মহড়ায় নিয়মিত অংশ নিচ্ছে এবং তারা সচেতনতা বাড়াতে ভূমিকা রাখছে। ১৮৭০-১৮৭৫ এবং ১৯৩০ সালে দেশে বড় ভূমিকম্প হয়েছিল। সে হিসাবে আরেকটি বড় ভূমিকম্পের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ। তাই দ্রম্নত বিল্ডিং কোড মেনে চলার জন্য কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। পুরনো বিল্ডিং পরীক্ষা করে ঝুঁকিপূর্ণ কিনা তা চিহ্নিত করতে হবে।যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের রজার বিল হাম তার এক গবেষণায় বলেছেন, হিমালয়ের পাদদেশে মেইন বাউন্ডারি ট্রাস্ট (এমবিটি) রয়েছে, যা বাংলাদেশ থেকে চারশ' কিলোমিটার উত্তরে। এখানে ইউরেশীয় পেস্নটের নিচে ভারতের যে পেস্নটটি তলিয়ে যাচ্ছে, সেটি লক হয়ে আছে। এটি খুলে গেলেই বাংলাদেশ, ভুটান ও নেপালে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে। ভৌগোলিকভাবে নাজুক অবস্থানের কারণে বড় ধরনের ভূমিকম্প ঝুঁকির মধ্যে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। যে কোনো সময় ঘটতে পারে ভয়াবহ বিপর্যয়।
কারণ, বাংলাদেশ অবস্থান করছে ভারতীয়, ইউরেশীয় এবং মিয়ানমারের টেকটোনিক পেস্নটের মধ্যে। বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন, ভারতীয় ও ইউরোপীয় পেস্নট দুটি হিমালয়ের পাদদেশে আটকা পড়ে আছে, অপেক্ষা করছে বড় ধরনের নড়াচড়া বা ভূমিকম্পের। ভূ-বিজ্ঞানীগণ মনে করেন, ভূ-গর্ভস্থ টেকটোনিক পেস্নটের সংঘর্ষ, আগ্নেয়গিরি ও মানবসৃষ্ট কারণে পৃথিবীতে ভূমিকম্প হয়ে থাকে।
বাংলাদেশের উত্তরে অবস্থান করছে যে ইন্দো-অস্ট্রেলীয় পেস্নট, সেটি প্রতি বছর ৪৫ মিলিমিটার করে ইউরেশীয় পেস্নটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আর তাই যতই দিন যাচ্ছে বাংলাদেশে ততই বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশ শুধু ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলেই অবস্থিত নয়; বরং ভূমিকম্পের সঙ্গে বড় ধরনের জলোচ্ছ্বাস হতে পারে। দুর্যোগ বিশেষজ্ঞ ডক্টর আব্দুল কাইয়ুম বলেন, রাজধানী ঢাকার ৬৫ শতাংশ এলাকা ভবন নির্মাণের উপযোগী নয়। তারপরও ঝুঁকি নিয়েই সেসব এলাকায় বহুতল ভবন গড়ে উঠছে। বিশেষ করে রাজধানীর নদী, খালবিল, পুকুর ভরাট করে বাড়ি-ঘর তৈরি করার কারণে রামপুরা, বেগুনবাড়ী খালের আশপাশ, পাগলা খালের দক্ষিণে বুড়িগঙ্গার দক্ষিণ এলাকা, আদাবর, বসুন্ধরা, বনশ্রী, শ্যামলী ও তুরাগ নদী সংলগ্ন এলাকায় ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হবে সবচেয়ে বেশি। এছাড়া অপরিকল্পিত নগরায়ণ, মানসম্মতভাবে মাটির গুণাগুণ যাচাই ও পাইলিং না করা, বিল্ডিংকোড অনুসরণ ও ভূমিকম্প সহনীয় করে বাড়ি তৈরি না করা এবং নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার করার কারণে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পেও নেমে আসতে পারে বড় ধরনের বিপর্যয়। ২০১২ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছিল পুরো দেশ। প্রায় দুই মিনিট ধরে এই কম্পনে প্রাণহানির ঘটনা না ঘটলেও বিভিন্ন স্থানে কাঁচা ঘরবাড়ি ধসে পড়ে। অনেক পাকা বহুতল ভবনে দেখা দেয় ফাটল।