আমার মতো অহেতুক কেউ যেন হয়রানীর শিকার না হয় দুদকের মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পর এমন মন্তব্য করলেন নিরাপরাধ কামরুল ইসলাম।
বৃহস্পতিবার (২৯ জানুয়ারি) রায় ঘোষণার পর দৈনিক শিক্ষাডটকমের কাছে এমন মন্তব্য করেন নোয়াখালির কামরুল।
তিনি বলেন, আমি অনেক হয়রানীর শিকার। আমার মতো আর কেউ যেন হয়রানীর শিকার না হয়। আমি বিচারপতি আইনজীবী ও সাংবাদিকদের প্রতি অনেক কৃতজ্ঞ।
বিশেষ করে আমার মামলায় আইনজীবীরা অনেক পরিশ্রম করেছেন তাদের প্রতি। আমার সঙ্গে এ মামলার (তদন্ত কর্মকর্তা) আইও বা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে পূর্ব কোনো শত্রুতা ছিল না। তারপরেও কেন আমাকে এই হয়রানী করা হলো তা জানি না। আমি অনেক ক্ষতিগ্রস্থ।
আরও পড়ুন : দুদকের ভুলে আরেক ‘জাহালমে’র ১৫ বছরের সাজা!
ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করবেন কী না? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি মামলায় রায়ের কপি হাতে পেয়ে চিন্তা করব।
ক্ষতিপুরণের বিষটি আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেব। এ রায়ে সন্তুষ্ট বলে তিনি সবার প্রতি।
বৃহস্পতিবার সকালে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদকের) তদন্তে নোয়াখালীর সদর থানার পূর্ব রাজারামপুর গ্রামের মো: কামরুল ইসলামকে দেওয়া সাজা বাতিল করেছেন হাইকোর্ট। পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে জারি করা গ্রেফতারি পরোয়ানা প্রত্যহার করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন।আদালতে দুদকের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খান এবং রিটকারী কামরুল ইসলামের পক্ষে ছিলেন মিনহাজুল হক চৌধুরী। এর আগে গত মঙ্গলবার এ রিটের ওপর শুনানি শেষ হয়।
এছাড়া মামলাটির তদন্তকারি দুদকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। ভুল তদন্তে সাজা হওয়া নির্দোষ কামরুলের করা রিট আবেদনের ওপর চূড়ান্ত শুনানি করে রায়ে সার্টিফিকেট জালিয়াতির যে মামলায় নির্দোষ কামরুলের সাজা হয়েছিল, সেই মামলাটির পুনরায় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।
নথি থেকে জানা যায়, এসএসসি পাসের ভুয়া নম্বর ও প্রশংসাপত্র তৈরি করে নোয়াখালীর মাইজদী পাবলিক কলেজে একাদশ শ্রেণিতে (১৯৯৮-৯৯ শিক্ষাবর্ষ) ভর্তির অভিযোগে কামরুল ইসলামের (ঠিকানা: পূর্ব রাজারামপুর) নামে তৎকালীন দুর্নীতি দমন ব্যুরো ২০০৩ সালের জানুয়ারিতে সুধারাম থানায় মামলা করে।মামলার বাদী ছিলেন দুর্নীতি দমন ব্যুরোর কুমিল্লা অঞ্চলের প্রসিকিউটিং পরিদর্শক মো. শহীদুল আলম। মামলায় বলা হয়, নোয়াখালী সদর থানার পূর্ব রাজারামপুর গ্রামের আবুল খায়েরের ছেলে কামরুল ইসলাম নোয়াখালী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ৫৭৬ নম্বর পেয়ে দ্বিতীয় বিভাগে এসএসসি পাশের জাল/ভুয়া মার্কসীট ও প্রশংসাপত্র সৃজন/সংগ্রহ করে ১৯৮৯-৯৯ সেশনে মাইজদী পাবলিক কলেজে ভর্তি হন। জব্দ করা ভর্তির আবেদনপত্রে কামরুলের জন্মতারিখ ১৯৭৯ সালের ১ জানুয়ারি ও গ্রাম পশ্চিম রাজারামপুর উল্লেখ রয়েছে।
তদন্ত শেষে প্রায় ১০ বছর পর দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা ২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর ওই মামলায় অভিযোগপত্র দেন, যেখানে কামরুল ইসলামের গ্রামের ঠিকানা পূর্ব রাজারামপুর উল্লেখ করা হয়। মামলাটির তদন্ত করেন দুর্নীতি দমন কমিশন নোয়াখালীর সমন্বিত জেলা কার্যাদলয়ের উপ-পরিচালক মাহফুজ ইকবাল।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, এ মামলায় ২০১৪ সালের ৭ এপ্রিল আদালতে পুলিশের (পিঅ্যান্ডএ) এক প্রতিবেদনে এক সাক্ষীর বরাত দিয়ে বলা হয়, আসামি মো. কামরুল ইসলাম, বাবা আবুল খায়ের, গ্রাম পূর্ব রাজারামপুর ঠিকানা সঠিক নয়। প্রকৃত আসামি কামরুল ইসলাম, বাবা আবুল খায়ের, গ্রাম পশ্চিম রাজারামপুর, যিনি দেশের বাইরে আছেন। এই মামলায় নোয়াখালীর বিশেষ জজ আদালত ২০১৪ সালের ২৬ নভেম্বর রায় দেন। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় কামরুল ইসলামকে (পিতা: আবুল খায়ের, গ্রাম: পূর্ব রাজারামপুর) দোষী সাব্যস্ত করে তিনটি ধারায় ৫ বছর করে সশ্রম কারাদ- এবং ১০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড- দেওয়া হয় রায়ে। সব কারাদণ্ড- একসঙ্গে চলবে বলা হয়।
এরপর ওই মামলায় সাজা পরোয়ানার ভিত্তিতে হয়রানি ও গ্রেপ্তার না করতে গত বছরের অক্টোবরে মোহাম্মদ কামরুল (পূর্ব রাজারামপুর) রিট করেন। এতে যুক্ত এক প্রত্যয়নপত্রে দেখা যায়, তিনি বর্তমানে নোয়াখালী চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের অফিস সহায়ক হিসেবে কর্মরত। তাঁর সার্ভিস বুক ও এসএসসি পাসের সনদ অনুসারে তিনি ১৯৯০ সালের ১৫ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। অর্থাৎ মামলায় উল্লিখিত শিক্ষাবর্ষ (১৯৯৮-৯৯) সময়ে তাঁর বয়স ছিল ৮ বছর। নোয়াখালীর হরিনাথপুর উচ্চবিদ্যালয় থেকে ২০০৬ সালে মোহাম্মদ কামরুল এসএসসি পাস করেন বলে ওই প্রত্যয়নপত্রে উল্লেখ রয়েছে।
রিটের প্রাথমিক শুনানি করে গত বছরের ৫ নভেম্বর হাইকোর্টের একই বেঞ্চ রুলসহ আদেশ দেন। ওই সাজা পরোয়ানার ভিত্তিতে ছয় মাসের জন্য মোহাম্মদ কামরুলকে কোনো ধরনের হয়রানি ও গ্রেপ্তার না করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। মোহাম্মদ কামরুলকে শনাক্তকরণ বিষয়ে দুদককে চার সপ্তাহের মধ্যে আদালতে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়।
শুনানিতে অংশ নিয়ে গত মঙ্গলবার (২৬ জানুয়ারি) দুদকের আইনজীবী মো.খুরশীদ আলম খান বলেন, এটা ছিল সরল বিশ্বাসে ভুল (বোনাফাইড মিসটেক)। গ্রামের নামে ভুলের যে বিষয়টা এসেছে এটা আমাদের বোনাফাইড মিসটেক। আমরা তার রিটের সাথে একমত। এখানে একটা বিষয় যে, কামরুল কিন্তু একদিনও জেল খাটেনি। আমরা চাইনা কোনো নিরাপরাদ ব্যক্তি জেল খাটুক। আদালত শুনানি শেষে বৃহস্পতিবার রায় দেন। এদিকে এভাবে নির্দোষ ব্যক্তির সাজা হওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে টিআইবি (ট্রাইনসডপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশ)। বুধবার বিবৃতিতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।