মা-বাবা ও স্বজনদের মুখে হাসি ফুটিয়ে যেদিন এ পৃথিবীর বুকে এসেছিল ঠিক সেই দিনেই ‘দানব’ বাসে পিষ্ট হয়ে চিরবিদায় নিলেন মাঈনুদ্দীন ইসলাম দুর্জয় (১৯)। গত সোমবার ছোট ভাইয়ের জন্মদিন উদযাপনের জন্য বড় ভাই মনির একটি কেকও কিনে এনেছিলেন বাসায়। কিন্তু সেই কেক আর কাটা হয়নি। বাসায় কেক রেখে সেদিন সারা রাত ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ছোটাছুটি করেন তার স্বজনরা। মঙ্গলবার সকাল থেকেই তাদের দেখা যায় মর্গের সামনে মাঈনুদ্দীনের লাশের অপেক্ষায় বসে বিলাপ করতে।
গত সোমবার রাত ১০টার দিকে ডিআইটি রোডে পূর্ব রামপুরা লাজ ফার্মার সামনে একটি বাস চাপা দিলে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় রামপুরার একরামুন্নেছা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে সদ্য এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেওয়া মাঈনুদ্দীনের। দুর্ঘটনার পর বিক্ষুব্ধ জনতা ও মাঈনুদ্দীনের সহপাঠীরা ১২টি বাস পুড়িয়ে দেয়। ভাঙচুর করে বেশকিছু যানবাহন।
দুই ভাই এক বোনের মধ্যে সবার ছোট মাঈনুদ্দীন। পরিবারের সঙ্গে থাকত রামপুরা তিতাস রোড ১৮০/৫ নম্বর বাসায়। তাদের গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার হালুয়াপাড়া গ্রামে। তার বাবার নাম আ. রহমান ও মা রাশিদা বেগম।
গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ঢামেক মর্গের পাশে গাছের নিচে যখন বসে ছিলেন মাঈনুদ্দীনের বড় ভাই মনির, সেই মুহূর্তে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে কাটাছেঁড়া করা হচ্ছিল আদরের ছোট ভাই মাঈনুদ্দীনের মরদেহ। সেখানে মনির ভাইয়ের বিভিন্ন স্মৃতি স্মরণ করছিলেন আর থেমে থেমে কাঁদছিলেন। তাকে সান্ত¡না দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন সঙ্গে থাকা ভগ্নিপতি সাদ্দাম ও খালাত ভাই মুস্তাফিজ।
সে সময় এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় মাঈনুদ্দীনের খালাত ভাই মুস্তাফিজের। তিনি বলেন, সোমবার মাঈনুদ্দীনের জন্মদিন ছিল। রাত ১১টায় বাসায় কেক কাটার কথা ছিল। দোকানে থাকাকালে রাত ৯টার দিকে তার মোবাইলে একটি কল আসে। তখন সে বাবা-মাকে বলে, তার এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে রামপুরা আটার মিলের পাশে যাচ্ছে সে। তিনি বলেন, সেখানে বন্ধুর সঙ্গে দেখা করে বাসায় ফেরার জন্য রাস্তা পার হওয়ার সময়ই অনাবিল বাসের চাপায় প্রাণ হারায় সে।
ময়নাতদন্ত শেষে দুপুর ১২টার দিকে যখন লাশ বের করে অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হচ্ছিল তখন চিৎকার করে কাঁদছিলেন ভাই মনির হোসেন। বারবার বলছিলেন, ‘আস্তে তোলেন আমার ভাইকে, যেন ব্যথা না পায়।’
ময়নাতদন্তের আগে রামপুরা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আল আমিন মরদেহের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন। তিনি জানান, নিহতের মাথায় জখম রয়েছে। তা ছাড়া শরীরে বাহ্যিকভাবে কোনো জখম দেখা যায়নি।
ঢামেক থেকে লাশ নিয়ে রামপুরার তিতাস রোডের বাসায় গেল সেখানে এক হৃদয়বিদায়ক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। মা রাশিদা বেগমের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে পুরো বাড়ি। আশপাশের এলাকার লোক এসে ভিড় জমায় শেষ বারের মতো একবার মুখটা দেখতে।
সন্তানের মৃত্যুসংবাদ শোনার পর থেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন বাবা আব্দুর রহমান। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমার পুতে কইতআব্বা আমারে একটা ভালো কলেজে ভর্তি করাইয়া দিও। আমার পুতেরে ভালো কলেজে ভর্তি কইরা দিমু। আমার পুতের কত আশা আকাক্সক্ষাৃআমি কইছি আমার পুতেরে ভালো কলেজে ভর্তি কইরা দিমু।’
বাসচাপায় ছেলে হারানো বাবা বলতে থাকেন, ‘মাইনু তাড়াতাড়ি আসো, তোমারে ভালো কলেজে ভর্তি করামু। তুমি না কইছ ভালো কলেজে ভর্তি করাইতাম? আইয়ু, তাড়াতাড়ি আইয়ু, তোমারে ভালো কলেজে ভর্তি করামু।’
লাশ মর্গ থেকে আসার পর রামপুরা তিতাস রোডের বাসায় প্রথম জানাজা সম্পন্ন হয়। সেখান থেকে লাশ নেওয়া হয় গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। গতকাল মঙ্গলবার রাত ৮টার দিকে লাশের দাফন সম্পন্ন হয়।
বাবা আব্দুর রহমান ভাণ্ডারী তিতাস রোডে (মোল্লাবাড়ি) রাস্তার পাশে টং দোকানে চা-পান বিক্রি করেন। মাঈনুদ্দীনের বড় ভাই বনশ্রীর একজনের ব্যক্তিগত গাড়িচালক। সবাই একসঙ্গেই থাকতেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল সদরের আব্দুর রহমান জীবিকার তাগিদে পরিবার নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন বছর পনের আগে। নানা কাজ করে তিনি সন্তানদের বড় করার চেষ্টা করে গেছেন, কিন্তু সংসারে অভাব ঘোচেনি।
এদিকে রামপুরা থানার ইন্সপেক্টর অপারেশনস মো. ইউসুফ হাসান বলেন, ‘নিহত মাঈনুদ্দীনের মা বাদী হয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮-এর ৯৫, ৯৮ ও ১০৫ ধারায় মঙ্গলবার একটি মামলা করেছেন। মামলায় অজ্ঞাতনামাদের আসামি করা হয়েছে।’
রামপুরা থানার ওসি রফিকুল ইসলাম জানান, নিহত শিক্ষার্থীর মায়ের মামলায় অনাবিলের চালক সোহেলকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। গণপিটুনির শিকার সেই চালক এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পুলিশি পাহারায় চিকিৎসাধীন। মামলায় বাসের হেলপার চাঁদ মিয়াকেও গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
এদিকে একই ঘটনায় রামপুরা এলাকায় বাসে আগুন ও ভাঙচুর করায় পৃথক একটি মামলা হয়েছে। পুলিশ নিজেই বাদী হয়ে মামলাটি করেছে।
ওসি আরও জানান, শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনার পরপরই বাসে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর হয়েছে। সেই ঘটনায় অজ্ঞাত আনুমানিক ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে আসামি করে মামলা দেওয়া হয়েছে।
রামপুরা থানার এসআই আল আমিন বলেন, আহত সোহেল হাসপাতালের নিউরো সার্জারি বিভাগে চিকিৎসাধীন। এখনো তার জ্ঞান ফেরেনি।
এদিকে গতকাল মঙ্গলবার ভোরে রাজধানীর সায়েদাবাদ এলাকা থেকে গ্রিন অনাবিল পরিবহনের ওই বাসটির চালকের সহকারী চাঁদ মিয়াকে আটক করেছে র্যাব। র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার সহকারী পরিচালক ইমরান খান বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
তিনি জানান, চাঁদ মিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় অতিরিক্ত গতির কারণে ওই দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়। দুর্ঘটনার পর সে দুর্ঘটনাস্থল হতে পালায় এবং ঢাকার বাইরে আত্মগোপনের জন্য সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ডে যায়।