সংবিধানে রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে অন্যতম সংবিধান প্রণেতা ও বিশিষ্ট আইনজীবী ড. কামাল হোসেন বলেছিলেন, ‘দেখুন, ওটা দিয়ে মাপতে গেলে এগুলো তো কোনো রাজনৈতিক দল নয়। রাজনৈতিক পারিবারিক ভিত্তিতে একটা জমিদারি স্থাপন করা হয়েছে। লিডার তো নয়, এরা অনেকেই গোমস্তা।’
সংবিধান ও আইন-আদালত বিশেষজ্ঞ সাংবাদিক ও লেখক মিজানুর রহমান খানের সঙ্গে প্রায় দেড় যুগ আগের সেই আলাপচারিতায় ড. কামাল হোসেন আরো বলেছিলেন, ‘আমার দাদার আমলে আমি বরিশালে জমিদারি দেখেছি। সেখানে মুনশিজি থাকতেন। খাতা লিখতেন। গোমস্তারা প্রজাদের কাছ থেকে তুলতেন। এখনো সেই ধারাই দেখছি।’
ড. কামালের উদ্দেশ্যে মিজানুর রহমান খানের সম্পূরক প্রশ্নঃ সেই জমিদারি ব্যবস্থাটাই পার্টির নামে চালু আছে?
ড. কামালের উত্তরঃ ‘ হ্যাঁ, এমনকি পায়ের ধুলো নেওয়া পর্যন্ত শুরু হয়ে গেছে। অথচ এ অবস্থা থেকে আমাদের অনেক বেরিয়ে আসার কথা। কারণ জমিদারি প্রথা বিলোপের পর ৫০ বছরের বেশি পার হয়ে গেছে। ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে বেশির ভাগ মুসলিম প্রজা মুসলিম লীগকে ভোট দিয়েছিলেন কেন? জমিদারি থেকে আমরা মুক্ত হব। শেরেবাংলা, সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশেম, তরুণদের মধ্যে তাজউদ্দীন আহমদ, এমন এমনকি শেখ মুজিবুর রহমান-তাঁরাই তো এ ব্যাপারে কৃষকদের বুঝিয়েছেন। বলেছেন, মুসলিম লীগকে ভোট দিলে তোমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হবে। ভোটের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক সরকার হবে। তোমাদের অর্থনৈতিক মুক্তি আসবে। অর্থনৈতিক মুক্তি কথাটি তো সেখান থেকে এসেছে।’
২.
ঢাকায় আমি যে ভাড়া বাড়িতে থাকি সেখান থেকে ড. কামাল হোসেনের নিউ বেইলী রোডের বাড়ি আর পলাতক বর্ষীয়ান রাজনীতিক টাকার জাজিমে ঘুমানো আওয়ামী লীগ নেতা আমির হোসেন আমুর ইস্কাটনের বাড়ীটি এক কিলোমিটারের মধ্যে। আমুর নামটা স্মরণ করার কারণ বর্ণনা করছি।
নলছিটি ও ঝালকাঠি সদরের সংসদীয় আসনে দুইতিনটি বাদে উপ-অপ প্রায় সবগুলো নির্বাচনে এমপি পদটি ছলে-বলে কৌশলে নিয়েছিলেন আমু সাহেব। আমার জন্মস্থানও নলছিটি। মোটামুটি স্কুল জীবন থেকে শুনে আসছি, আমু সাহেবকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করেন নেতা-কর্মীরা। ভক্তিসহ সালাম করতে দোষ নেই। কিন্তু আমু সাহেবের সালম নেওয়াটা বাধ্যতামূলক। যেটা ড. কামাল হোসেন বর্ণিত ‘পায়ের ধুলা নেওয়া শুরু হয়ে গেছে’। আমু সাহেবরা ধুলা নিতে বাধ্য করানোর পথ প্রদর্শকদের অন্যতম হয়তো। পরে যেটা সংক্রামক হয়ে পচন ধরে ৫ আগস্টে গিয়ে কিছুটা সাময়িক বিরতি নিয়েছে। এই বিরতির ফাঁকে সংবিধান সংস্কার কমিশন কি একটা উদ্যোগ নিতে পারে? এমন ভাবনা থেকেই এমন লেখা। বতর্মানের সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. আলী রিয়াজ প্রায়শই প্রয়াত মিজানুর রহমান খানকে স্মরণ করেন। গত বছরের ১১ জানুয়ারি তিনি তার ফেসবুকে লেখেন, ‘…তার লেখা বই হাতে নিয়ে পাঠ করি, নাড়াচাড়া করি। সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদের আলোচনা পড়ি, ভাবি মিজান এই বিষয়ে কী বলতেন।’
মিজানুর রহমান খান সেদিন ড. কামাল হোসেনের কাছে প্রশ্ন করেছিলেন দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট নিয়ে কি ভাবার সময় এসেছে? কামাল হোসেনের জবাব এমন : ‘এক অর্থে অবশ্যই এসেছে। তবে অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী [প্রয়াত রাষ্ট্রপতি] সাহেবদের একটা প্রস্তাব আমরা সমর্থন করেছি। সেটা হলো ৪০০ আসনের একটা পার্লামেন্ট প্রতিষ্ঠা করা। ৩০০ আসনে প্রত্যক্ষ নির্বাচন। বাকি ১০০ আসনে হবে পরোক্ষ নির্বাচন। এটা এক ধরনের অনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব। সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলো এই নতুন ১০০ আসনের জন্য অভিজ্ঞ, বিশেষজ্ঞ, অর্থাৎ অন্য দেশে যারা আপার হাউস বা উচ্চ কক্ষে যান তেমন লোকের নাম প্রস্তাব করবে।’
এই পর্যায়ে মিজানুর রহমান খান মনে করিয়ে দেন, ব্রিটেনে যেমনটা আছে? উত্তরে কামাল হোসেন বলেন, ‘ভারতের রাজ্যসভাতেও আছে। বিভিন্ন মহলের, যেমন বিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ, কূটনীতিবিদ-সংসদের ৩০০ আসনে নির্বাচিত সদস্যরা পরোক্ষভাবে তাঁদের নির্বাচন করবেন। আমরা বলছি, ওভাবে পরোক্ষভাবে নির্বাচিত না করে তাঁদের আনুপাতিক হারে মনোনীত হতে দিন। প্রত্যেক দলের কাছে একটি তালিকা থাকবে। যেমন বিএনপি ও আওয়ামী লীগের তালিকায় তাদের পছন্দের বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ বা বিশেষজ্ঞদের নাম থাকবে।’
এ পর্যায়ে মিজানুর রহমান খান প্রশ্ন করেন, অনুপাত বণ্টনের ভিত্তি কী হবে? কামাল হোসেন বলেন, ‘কোনো দল যদি ৩০ শতাংশ ভোট পায়, তাহলে তারা ওই ১০০ আসন থেকে ৩০ ভাগ সদস্য নির্বাচন করতে পারবে।’
এই ১০০ আসনে কোনো ভোটাভুটি হবে না? এমন প্রশ্নের জবাবে কামাল হোসেন বলেন, ‘না। ব্যক্তিগতভাবে ভোটাভুটি হবে না। এই ১০০ আসনের নির্বাচনে কোনো প্রচারণা থাকবে না। কোটি টাকাও খরচ করতে হবে না। বর্তমান আসনব্যবস্থাকে ৩০০ আসনে ভাগ করা যায়, আবার না করলেও চলে।’
মিজানুর রহমান খানের প্রশ্ন ছিলো : ১০০ আসন কি কোনো নির্বাচনী এলাকার ভিত্তিতে হবে না? ভোটাভুটি ছাড়াও তো পুরো দেশকে ১০০ আসনে ভাগ করা যায়।
ড. কামাল হোসেনের মন্তব্য : ‘ঠিকই বলেছেন। শ্রীলঙ্কা কিন্তু করেছে আসনওয়ারি। তাতে লাভও হয়। সংশ্লিষ্ট আসনের লোকদের সঙ্গে মনোনীত সংসদ সদস্যদের একটা যোগাযোগও থাকে। আর তিনি তাঁর এলাকার মানুষের মতামতকে একদম উপেক্ষাও করতে পারেন না। ভাবতে খুব কষ্ট হয়, বাংলাদেশে পার্টি ও পার্টি লিডারশিপ তো জমিদারি ব্যবস্থায় পরিণত হয়ে গেছে। আমাদের তো ন্যূনতম 'পার্টি কনসেপ্ট' বা দলীয় ধারণা অনুপস্থিত।’
ড. কামাল হোসেনের আরো মন্তব্য : ‘বাহাত্তরে যখন সংবিধান তৈরি হয়েছিল, তখন আমরা ভাবতেই পারিনি যে পার্টিগুলোর মধ্যে কোনো গণতন্ত্র থাকবে না। পার্টি একটা জমিদারি বা স্বৈরশাসনের মতো পর্যায়ে পৌঁছুবে।’
বাহাত্তরের সংবিধান লেখার সময় উচ্চ কক্ষের কথা কি আদৌ আলোচনায় এসেছিল? এমন প্রশ্নের জবাবে ড. কামাল বলেন, ‘এ সব কথাই আজ আমাদের বলতে হবে। কেননা আমাদের এতো বিশ্বাস ছিল যে, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট লাগবে না।’