‘তোকে আবরারের মতো মারলে কী হবে’

দৈনিক শিক্ষাডটকম, রাবি |

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের এক নবীন শিক্ষার্থীকে মধ্যরাতে মানসিক হয়রানি ও নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে মার্কেটিং বিভাগের দুই শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে। হয়রানির পাশাপাশি ওই শিক্ষার্থীকে শিবির ডেকে নিয়ে এসে মারার হুমকিও দেওয়া হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। 

এ বিষয়ে গতকাল সোমবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর নাম মোহাম্মদ রকি। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের নবীন শিক্ষার্থী।  

অভিযুক্ত শিক্ষার্থী অন্তর বিশ্বাস ও নাজমুল হোসেন নাবিল

অভিযুক্ত দুই শিক্ষার্থী হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী অন্তর বিশ্বাস এবং একই বিভাগের দ্বিতীয় শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী নাজমুল হাসান নাবিল। 

গত রোববার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন বিনোদপুরের লেবুবাগান এলাকার ‘বিশ্বাস ম্যানসন’ ছাত্রাবাসে মোহাম্মদ রকি মানসিক নির্যাতন, হয়রানি ও হুমকির শিকার হন। তিনি গতকাল রাত সাড়ে ৭টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর দপ্তরে নিজের নিরাপত্তা চেয়ে আবেদন করেছেন।

অভিযোগপত্রে মোহাম্মদ রকি উল্লেখ করেছেন, ‘আমি মোহাম্মদ রকি গতকাল রোববার রাত পৌনে ১২টা থেকে প্রায় দেড়টা পর্যন্ত মানসিক নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছি। ‘‘বিশ্বাস ম্যানসন’’ ছাত্রাবাসের ২০১ ও ২০৫ নম্বর রুমের দুজন শিক্ষার্থী গতকাল রাত ১১টা ৪৫ মিনিটের দিকে আমার কক্ষে আসেন। শুরুতেই তাঁরা আমাকে নানা রকম বিব্রতকর প্রশ্ন করেন। ফলে আমি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হই। কথাবার্তার একপর্যায়ে তাঁরা আমাকে বলেন, ‘‘তোকে হলের গেস্টরুমে নিয়ে যাব, গেস্টরুমে নিয়ে গিয়ে তোকে আদর-আপ্যায়ন করব।” এরপর তাঁরা বলেন, ‘‘শেষবারের মতো তোর মাকে কল দে, কল দিয়ে বলবি আর কোনো দিন দেখা না-ও হতে পারে, আমি কোনো ভুল করলে, আমাকে মাফ করে দিও।” একপর্যায়ে তারা বলেন, ‘‘আবরার ফাহাদকে কীভাবে মারা হয়েছিল জানিস?” আমি বলি, “জ্বি ভাই, পিটায়ে মারা হয়েছিল।” তারপর তাঁরা বলেন, ‘‘তোকে এভাবে মারলে তখন কী করবি?” তারপর আমি চুপ থাকি।’ 

অভিযোগপত্রে আরো উল্লেখ করেন, ‘তারা হুমকি দিয়ে বারবার আমাকে হলের গেস্টরুমে যেতে বলেন। আমি যেতে অস্বীকৃতি জানালে তাঁরা আমাকে বলেন, ‘‘তুই যদি হলের গেস্টরুমে যেতে না চাস, তাহলে মেসে শিবির ডেকে নিয়ে এসে তোকে মারব।” এরপর তাঁরা আমাকে বলেন, ‘‘তোর রুমমেটদের সেমিস্টার ফাইনাল ৭ তারিখে শেষ হবে। ৮ তারিখ রাতে তোর সঙ্গে আমরা পার্টি দেব।” এরপর তারা আনুমানিক রাত দেড়টার দিকে রুম থেকে বের হয়ে যায়। এমতাবস্থায় আমি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।’ 

এ বিষয়ে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী মোহাম্মদ রকি বলেন, গত শুক্রবার তিনি মেসে উঠেছেন। এর মধ্যে একবার মেসে অবস্থানরত সবার কক্ষে গিয়ে পরিচিত হয়ে এসেছিলেন। এরপর রোববার রাতে ওই দুজন তাঁর কক্ষে এসে নানাভাবে হুমকি দেন এবং হয়রানি করেন। তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়জীবন কেবল শুরু, এ ঘটনা তিনি ভুলতে পারছেন না। ওই দিন রাতেও ঘুমাতে পারেননি। এ রকম ঘটনা যেন আর কারও সঙ্গে না ঘটে, সে জন্য তিনি অভিযুক্তদের শাস্তির দাবি জানান। 

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দপ্তরে অভিযোগপত্র দেওয়ার সময় ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর সঙ্গে উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীবের দেখা হয়। এ সময় ক্যাম্পাসে কর্মরত বেশ কয়েকজন সাংবাদিকও উপস্থিত ছিলেন। ঘটনার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা শুনে তিনি ওই শিক্ষার্থীকে বলেন, ‘ঘাবড়ানোর কিছু নাই। আমরা আছি। এগুলো আমরা বরদাস্ত করব না।’ 

পরে অভিযোগপত্র দেওয়ার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর মো. রফিকুল ইসলাম ও মো. নাসির উদ্দিন উপস্থিত ছিলেন। এ সময় তাঁরা ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ঘটনার বর্ণনা শোনেন। একপর্যায়ে খোঁজ-খবর নিয়ে অভিযুক্ত দুজন শিক্ষার্থী ও মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মশিহুর রহমানকে প্রক্টর দপ্তরে ডেকে আনা হয়। 

পরে অভিযুক্ত দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। উপস্থিত বিভাগের শিক্ষককে এ ব্যাপারে তাদের একাডেমিক কমিটির সুপারিশ দ্রুত সময়ের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে জানাতে বলা হয় এবং অভিযুক্ত দুজনকে তাঁর হেফাজতে ছেড়ে দেওয়া হয়। 

অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে অভিযুক্ত মার্কেটিং বিভাগের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী নাজমুল হোসেন নাবিল বলেন, ‘আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিভাগের বড় ভাই ওই ছেলের কক্ষে নিয়ে যায়। একপর্যায়ে বড় ভাই রকির সঙ্গে মজা করেন। কিন্তু আমি সে রকম ইনফ্লুয়েন্স করি নাই। কোনো রকম শিবির কথাবার্তা, মারা বা অত্যাচার করা হয়নি। তবে আবরার ফাহাদের বিষয়টি উদাহরণ হিসেবে দেখিয়ে বলা হয়েছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে র‍্যাগিং, মারামারি এসব চলে না। এ ধরনের কোনো পরিস্থিতিতে পড়লে আমাদের জানাবি। এরপর আমরা কক্ষ থেকে বের হয়ে যাই। কিন্তু সে বিষয়টা অন্যভাবে নিয়েছে।’ 

অভিযুক্ত আরেক শিক্ষার্থী অন্তর বিশ্বাস বলেন, ‘তার সঙ্গে (রকি) খুবই সাধারণভাবে কথা হয়েছে। কিন্তু বিষয়টা সে যেভাবে উপস্থাপন করেছে, সেভাবে হয়নি। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল তাঁর সঙ্গে একটা সম্পর্ক তৈরি করা। কিন্তু ব্যাপারটা এত দূর চলে যাবে, বুঝতে পারিনি। শিবিরের বিষয়টি সম্পূর্ণ মিথ্যা। আবরার ফাহাদের বিষয়টি উদাহরণ হিসেবে দেখিয়ে বলেছি, তাঁর সঙ্গে যেটা ঘটেছে ওটা র‍্যাগিং কিন্তু তোমার সঙ্গে যা হচ্ছে, এটাকে তুমি র‍্যাগিং হিসেবে নিও না। তবে মাকে ফোন দেওয়ার বিষয়টা তাঁকে বলা হয়েছে। একটা ফরমাল সম্পর্ক করার জন্য বলেছিলাম।’ 

সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মাহবুবর রহমান বলেন, ‘এটা অত্যন্ত দুঃখজনক একটি ঘটনা। একজন নতুন শিক্ষার্থীকে যেভাবে র‍্যাগিং দেওয়া হয়েছে, সেটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমরা শিক্ষক হিসেবে এ বিষয়গুলো কখনোই প্রশ্রয় দিতে পারি না। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত গুরুতর অভিযোগই করা হয়েছে।’ 

তিনি আরো বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ শাস্তি যেভাবে নিশ্চিত করা যায়, আমরা সে চেষ্টাই করব। ভুক্তভোগীর অভিযোগ ও অভিযুক্তদের স্বীকারোক্তির তথ্যগুলো আমরা অভিযুক্ত শিক্ষার্থীর বিভাগে পাঠাব। বিভাগীয় একাডেমিক কমিটি একটা সুপারিশমালা তৈরি করে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা কমিটিকে পেশ করবে। সেই অনুযায়ী শৃঙ্খলা কমিটি সিদ্ধান্ত নেবে।’


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ইএফটিতে বেতন দিতে এমপিও আবেদনের সময় এগোলো - dainik shiksha ইএফটিতে বেতন দিতে এমপিও আবেদনের সময় এগোলো জবিতে ভর্তির প্রাথমিক আবেদন শুরু ১ ডিসেম্বর - dainik shiksha জবিতে ভর্তির প্রাথমিক আবেদন শুরু ১ ডিসেম্বর সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি: দশ দিনে আবেদন প্রায় ৬ লাখ - dainik shiksha সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি: দশ দিনে আবেদন প্রায় ৬ লাখ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৮ সদস্যের কমিটি ঘোষণা - dainik shiksha বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৮ সদস্যের কমিটি ঘোষণা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে ধারণা বাড়াতেই পাঠ্যক্রমে তথ্য অধিকার আইন বিষয় যুক্ত: এনসিটিবি চেয়ারম্যান - dainik shiksha ধারণা বাড়াতেই পাঠ্যক্রমে তথ্য অধিকার আইন বিষয় যুক্ত: এনসিটিবি চেয়ারম্যান কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক শিক্ষক নিবন্ধন ভাইভা: ২১তম দিনে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি - dainik shiksha শিক্ষক নিবন্ধন ভাইভা: ২১তম দিনে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি সরকারি কলেজ প্রদর্শকদের পদোন্নতির খসড়া প্রকাশ - dainik shiksha সরকারি কলেজ প্রদর্শকদের পদোন্নতির খসড়া প্রকাশ সুইডেনে স্কলারশিপে স্নাতকোত্তরের সুযোগ - dainik shiksha সুইডেনে স্কলারশিপে স্নাতকোত্তরের সুযোগ পঞ্চমে ফিরছে বৃত্তি পরীক্ষা, বার্ষিকে ৪ স্তরে মূল্যায়ন - dainik shiksha পঞ্চমে ফিরছে বৃত্তি পরীক্ষা, বার্ষিকে ৪ স্তরে মূল্যায়ন দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.00325608253479