শীত আর বর্ষা নেই, সব মৌসুমেই বই-খাতার সঙ্গে রান্নার হাঁড়ি নিয়ে রওনা করত শিক্ষার্থীরা। পাতিলের মধ্যে বই-পুস্তক আর স্কুলের পোশাক নিয়ে পার হতো খাল। ভেজা জামা-কাপড় রোদে শুকাতে দিয়ে স্কুল পোশাক পরে ছুটত ক্লাসে। এভাবেই প্রতিদিন দু’বার খাল সাঁতরে পাঠগ্রহণ করত পটুয়াখালীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ রাঙ্গাবালী উপজেলার চরমোন্তাজ ইউনিয়নের দিয়ারচর ও উত্তর চরমোন্তাজ গ্রামের অর্ধশতাধিক কোমলমতি শিক্ষার্থী।
শিক্ষার্থীদের পারাপারের দুর্ভোগের চিত্র নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। প্রতিবেদনটি নজরে আসে বেসরকারি সংস্থা জাগোনারী ও শুভসংঘ নামের একটি সংগঠনের। এরপরই ওই শিশু শিক্ষার্থীদের দুটি নৌকা উপহার দেয় তারা। এতে এখন থেকে তারা আড়াইশ ফুট প্রশস্তের বাইলাবুনিয়ার খালটি নির্বিঘে্ন পারাপার হয়ে স্কুলে যেতে পারবে।
নৌকা উপহার পেয়ে চতুর্থ শ্রেণি পড়ুয়া শিক্ষার্থী কেয়ামণি বলে, ‘পাতিল নিয়ে আমাদের আসতে যেতে অনেক ভয় হতো। কখনো হাত থেকে পাতিল (হাঁড়ি) ছুইট্টা (ছুটে) যেত। আমরা অনেক কষ্ট করি। তয় এখন থেইকা আর আমাদের পাতিলে ভেসে স্কুলে যেতে হবে না। আর পাল্টাইতে হইবে না স্কুল ড্রেসও।
এই স্কুলের আরেক শিক্ষার্থী নাজমুল বলে, এ্যাহন আর স্কুলে আইতে খাল হাতরাইতে (সাঁতার কাটতে) হইবে না। টানা লাগবে না হাঁড়ি পাতিল। ছোট ভাইটারে লইয়া স্কুলে আইতে পারতাম।
দিয়ারচর গ্রামের শিক্ষার্থী অভিভাবক রেহেনা বেগম বলেন, ‘আমার দুই নাতি স্কুলে পড়ে মাঝেমধ্যে টাকা দিয়া জাইল্লা (জেলে) নৌকায় পার হতো। আবার অনেক সময় টাকা দিলেও নৌকায় পার করত না। এবার ওরা দুইডা নৌকা পাইছে। নিরাপদে স্কুলে আইতে যাইতে পারবে।
মাঝেরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. রুহুল আমিন বলেন, স্থানীয়দের উদ্যোগে কয়েকবার বাঁশের সাঁকো নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু নোনা জলে সাঁকো বেশিদিন টেকে না। ২০০২ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত এই স্কুলে সাঁকো থাকাকালে ৩০০-৪০০ শিক্ষার্থী ছিল। এর মধ্যে প্রায় ২০০ শিক্ষার্থী ছিল ওই দুই চরের। সাঁকো না থাকায় এখন শিক্ষার্থী কমে গেছে। এখন দুই চর থেকে ৫০ জনের মতো শিক্ষার্থী আসে। এদের কেউ কেউ নিয়মিত আসেও না। তবে জাগোনারী নামের একটি এনজিও সংস্থা ও শুভসঙ্গ নামের একটি সামাজিক সংগঠন থেকে দুটি নৌকা উপহার হিসেবে দেওয়া হয়েছে। এখন থেকে কোমলমতি শিশুরা নিরাপদে নৌকায় পারাপার হবে। খালের ওপর ব্রিজ (সেতু) নির্মাণের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে বিষয়টি অবহিত করেছি।’
এদিকে বৃহস্পতিবার দুপুরে শিশু শিক্ষার্থীদের নৌকা উপহারকালে উপস্থিত ছিলেন জাগোনারীর পরিচালক (যোগাযোগ) ডিউক ইবনে আমিন, উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা বায়েজিদ আহমেদ, রাঙ্গাবালী প্রেস ক্লাবের সভাপতি কামরুল হাসান, রাঙ্গাবালী প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এম সোহেল, মাঝেরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রুহুল আমিন প্রমুখ।
উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘দুর্গম এলাকা থেকে শিক্ষার্থীদের একটি খাল পেরিয়ে স্কুলে আসতে হতো। সেখানে একটি ব্রিজ নির্মাণের জন্য বেশ কিছুদিন আগে কর্তৃপক্ষের কাছে প্রস্তাবনা দিয়েছি। তবে ইতিমধ্যে বাচ্চাদের স্কুলে আসা-যাওয়ার জন্য একটি সংগঠন ও একটি সংস্থা থেকে দুটি নৌকা উপহার দেওয়া হয়েছে।
উপজেলা প্রকৌশলী মিজানুল কবির বলেন, ‘শিশু শিক্ষার্থী এবং জনস্বার্থে ওই খালের ওপর ব্রিজ (সেতু) নির্মাণের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে বিষয়টি অবহিত করেছি।’
এ ব্যাপারে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ডা. জহির উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এখন আর খাল সাঁতরে শিশুদের স্কুলে যেতে হবে না, এটি সত্যি আমাদের জন্য আনন্দের একটি বার্তা। কোমলমতি শিশুরা এখন থেকে নৌকায় স্কুলে আসা-যাওয়া করবে।’
বেসরকারি সংস্থা জাগোনারী পরিচালক (যোগাযোগ) ডিউক ইবনে আমিন বলেন, সম্প্রতি কয়েকটি গণমাধ্যমে শিশু শিক্ষার্থীদের পাতিলে ভেসে স্কুলে যাওয়ার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। বিষয়টি আমাদের নজরে আসে এবং আমাদের দাতা সংস্থা বোসের সহযোগিতায় একটি নৌকা উপহার হিসেবে দিয়ে থাকি। এখন থেকে ছোট শিশু শিক্ষার্থীরা নৌকায় পারাপার হবে।