নিজেদের ‘শপথবদ্ধ রাজনীতিবিদ’ উল্লেখ করে বক্তব্য দেওয়ায় উচ্চ আদালতের দুই বিচারপতির পদত্যাগ দাবি করেছে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম। গতকাল বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতিতে এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানানো হয়।
সুপ্রিম কোর্টের উদ্যোগে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের আলোচনা সভায় ‘বিচারপতি শপথবদ্ধ রাজনীতিবিদ’ উল্লেখ করে আপিল বিভাগের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম বলেন, ‘এ সংবিধান হলো আমাদের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক দলিল। বঙ্গবন্ধুর যে রাষ্ট্র দর্শন, রাজনৈতিক দর্শন, সামাজিক দর্শন—সব দর্শনের প্রতিফলন ঘটেছে এই সংবিধানে।’ তিনি বলেন, ‘ইদানীং সুষ্ঠু নির্বাচন, বিদেশি প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত—এসব নিয়ে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, গণতন্ত্র চাই। বঙ্গবন্ধুর শোষিতের গণতন্ত্র কী? শুধু ভোট দেওয়াই একমাত্র গণতন্ত্র নয়। ভোট দিয়ে রাজা ও মন্ত্রীর পরিবর্তনই গণতন্ত্র নয়। যে গণতন্ত্র মানুষের ভাতের নিশ্চয়তা, বেকারের চাকরির সংস্থান ও দেশের মানুষের সার্বিক মুক্তি ঘটাতে না পারে—বঙ্গবন্ধু সে গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন না।’ বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এমন হওয়া উচিত হবে না, যে ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে এ দেশের স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির উন্মেষ ঘটে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এমন হবে না, শুধু ভোট দিয়েই এখানে জঙ্গিবাদের উত্থান হবে। সংবিধান রক্ষার যে শপথ নিয়েছি, সে অবস্থায় থেকে মুক্তিযুদ্ধের আবহ ও প্রেক্ষাপট, সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ সবকিছু মাথায় নিয়ে বিচারিক দায়িত্ব পালন করতে হবে।’ বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকীও নির্বাচন ইস্যু নিয়ে কথা বলেন।
গতকাল সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বিএনপির আইন সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিগণ সংবিধানের তৃতীয় তপশিলে বর্ণিত শপথের মাধ্যমে দেশের সংবিধান ও আইনের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধানের অঙ্গীকার করে থাকেন। একই সঙ্গে ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হয়ে সবার প্রতি আইন অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ করার অঙ্গীকার করে থাকেন। তবে গত ১৫ আগস্টের আলোচনা সভায় কয়েকজন বিচারপতির বক্তব্যের কিছু কিছু অংশ বিচারপতি হিসেবে নেওয়া শপথের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন কি না, তা প্রশ্ন রাখার দাবি রাখে। সাধারণত কোনো রাজনৈতিক কর্মী তার দলীয় সভায় যে ধরনের বক্তব্য প্রদান করে থাকেন, অনেক বিচারপতির বক্তব্যে তেমনই একজন রাজনীতিবিদের বক্তব্যের প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়।’
কায়সার কামাল বলেন, ‘আলোচনা সভায় বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম শপথবদ্ধ রাজনীতিবিদ হিসেবে বিচারপতিদের চিহ্নিত করেছেন। তিনি স্পষ্টতই দেশের চলমান রাজনৈতিক বিষয়ে শাসক দলের নেতাদের মতো রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে বলেছেন, ‘ইদানীং সুষ্ঠু নির্বাচন, বিদেশি প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত—এসব নিয়ে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে... শুধু ভোট দেওয়াই একমাত্র গণতন্ত্র নয়।’ অনুষ্ঠানে বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকী নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের যে মৌলিক অধিকার জনগণের রয়েছে তার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে বলেছেন, ‘সারা পৃথিবীতে নির্বাচন হয়, কেউ তাকিয়েও দেখে না; কিন্তু নির্বাচন ঘিরে সব নজর বাংলাদেশের দিকে কেন?’ উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের এমন বক্তব্য কতটুকু বিচারকসুলভ বা রাজনৈতিক মতাদর্শের পরিচায়ক, তা সহজেই অনুমেয়। তারা বিচারপতির মহত্ত্ব ধারণ করতে পারেন কি না, তা জনমনে অনেক সংশয় ও প্রশ্ন রাখছে।’ এ পরিপ্রেক্ষিতে এসব স্বঘোষিত ‘শপথবদ্ধ রাজনীতিবিদ’ বিচারপতিকে অবিলম্বে পদত্যাগ করার আহ্বান জানান তিনি।
ওই বক্তব্যের প্রতিবাদে সারা দেশের আইনজীবী সমিতিতে মিছিল সমাবেশের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ জে মোহাম্মদ আলী, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি জয়নুল আবেদীন, সিনিয়র আইনজীবী সুব্রত চৌধুরী, বারের সাবেক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস কাজল, জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সুপ্রিম কোর্ট শাখার সভাপতি আবদুল জব্বারসহ শতাধিক বিএনপি সমর্থক আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন।