সরকারি কলেজ ও মাদরাসা শিক্ষকদের পদোন্নতিসহ সব সুযোগ সুবিধা নিশ্চিতকরণ ও এর মাধ্যমে শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য শিক্ষা ক্যাডার বিলুপ্ত করে শিক্ষা সার্ভিস চালু করা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক শিক্ষাসচিব মো: সোহরাব হোসাইন।
দৈনিক শিক্ষার এক প্রশ্নের জবাবে দীর্ঘদিন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চাকরির অভিজ্ঞতা সম্পন্ন সোহরাব হোসাইন আরো বলেন, এখন যেমন জুডিশিয়াল সার্ভিস আলাদা রয়েছে এমন। তাদের কোনো কিছুতে বঞ্চিত হওয়ার অভিযোগ নেই। একইভাবে শিক্ষা সার্ভিস হলে সেখানে তাদের পদোন্নতির সুযোগ-সুবিধাসহ সকল কিছুর আলাদা বিধান থাকবে।
‘আমার দীর্ঘদিনের চাকরির অভিজ্ঞতা থেকেই শিক্ষা সার্ভিসের কথা বলছি,’ যোগ করেন তিনি।
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন বিধান রয়েছে- এমন হতে পারে। চাকরির অভিজ্ঞতা কত বছর হলে প্রমোশন হবে। পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রকাশনাসহ সার্বিক বিষয় থাকবে। এমন হলে সমস্যা কাটতে পারে। তবে চাকরির সুযোগ-সুবিধা সাধারণত নির্ধারণ করা হয় তার কর্মপরিধি অনুসারে। এটা অনেক ক্ষেত্রেই অভিন্ন হবে না। তবে বিভিন্ন স্তরে বেতন কাঠামো অভিন্ন।
তিনি বলেন, হাজার হাজার শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা পদোন্নতি না পেয়ে অবসরে চলে যান। একসময় প্রশাসন ক্যাডারেও এই সমস্যা ছিলো। তখন অনেক বেশি নিয়োগ হতো, ফলে সবাইকে পদোন্নতি দেয়া সম্ভব হতো না। এখন সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রতিটি বিসিএস-এ প্রশাসন ক্যাডারে কম নিয়োগ দেয়া হয়।
প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তা হিসেবে চাকরিজীবন শুরু করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হিসেবে অবসরে যাওয়ার পর পিএসসির চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ পাাওয়া সোহরাব হোসাইন দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, ‘প্রশাসন ক্যাডার ও শিক্ষা ক্যাডার এক না। দৈনন্দিন কাজে একজন ইউএনও ও ডিসির পিওন, গাড়ী, গার্ড ইত্যাদি দরকার হয়। সরকার সেটা দেয়। কিন্তু একজন সরকারি কলেজের শিক্ষকের তো গার্ড বা পিওন বা গাড়ীর দরকার কতটা?’ ’
দৈনিক শিক্ষার অনুসন্ধানে জানা যায়, সেনাশাসক জিয়াউর রহমান সস্তা জনপ্রিয়তার আশায় বেশ কয়েকটি নতুন ক্যাডার চালুর সিদ্ধান্ত নেন ও প্রজ্ঞাপন জারি করেন। আর জেনারেল এরশাদ সেগুলো বাস্তবায়ন করেন। তার আগে শিক্ষা সার্ভিস ছিলো এবং ১৭টি সরকারি কলেজ ছিলো। সরকারি কলেজের শিক্ষকরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রায় সমান বেতন পেতেন। সেটা নিয়ে তাদের কোনো আপত্তি বা দাবি ছিলো না। কিন্তু দুই সেনাশাসক পুরো বিষয়টা জটিল করে তুলেছে। দেখা গেছে পররাষ্ট্র, প্রশাসন, পুলিশ, কাস্টমসসহ তুখোর মেধাবীদের পছন্দের কয়েকটি ক্যাডার বাদে বাদ বাকীরা ক্যাডারের কোনো সুযোগ-সুবিধা পান না। শিক্ষাসহ কয়েকটি ক্যাডারে প্রশাসন ও পুলিশ ক্যাডারের মতো সুযোগ-সুবিধা দরকার না হলেও কতিপয় শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা সেইসব দাবির আলোচনা করে বছরের পর বছর পার করে দেন। ফলে সবচাইতে ক্ষতি হচ্ছে সরকারি কলেজ ও মাদরাসাগুলোর। এখানকার শিক্ষকদের হাতেগোণা কয়েকজন বাদে বাদবাকীরা নিজেদের শিক্ষক পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করেন। তারা নিজেদের কর্মকর্তা এবং দিনমান প্রশাসন ও পুলিশ ক্যাডারের কে কোন সুবিধা পেলেন আর তারা বঞ্চিত হলেন সেই হিসেব কষেন।
দৈনিক শিক্ষার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সরকারি কলেজের শিক্ষকরা কর্মকর্তা হিসেবে নিজেকে পরিবার ও সমাজে উপস্থাপন করতে কোনো মূল্যে শিক্ষা প্রশাসনের বিভিন্ন পদে চাকরি করেন। কলেজে বদলি হওয়াকে অবনতি মনে করেন। অথচ সরকার তাদেরকে নিয়োগ দিয়েছে সরকারি কলেজ ও মাদরাসায় শিক্ষকতা করার জন্য। তাদের এন্ট্রি লেভেলের পদের নাম প্রভাষক। সর্বোচ্চ পদ অধ্যাপক। কিন্তু তারা শিক্ষক পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করেন। ফলে সরকারি কলেজগুলোর পড়াশোনা লাটে উঠেছে। আর এই সুযোগে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে ঝুঁকছে শিক্ষার্থীরা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, শিক্ষা ক্যাডার একটি ল্যাটারাল এন্ট্রি ক্যাডার কিন্তু কতিপয় শিক্ষা ক্যাডার সদস্য তা অস্বীকার করে আসছেন। ১০ শতাংশ কোটায় নিয়োগ পেয়ে শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক নিযুক্ত হয়ে সেই ১০ শতাংশ কোটায় নিয়োগ বন্ধ রাখছেন তিনিই।
দৈনিক শিক্ষার আর্কাইভে থাকা ভিডিও ও ছবিতে দেখা যায়, সরকারি কলেজের কতিপয় শিক্ষক শ্রমিকদের মতো একরং টিশার্ট পরিধান করে জুতা পায়ে শিক্ষা ভবন ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে উঠে দাবি আদায়ে মিছিল করেন। অথচ প্রশাসন বা পুলিশ ক্যাডারের কোনো কর্মকর্তা নিজেদের কোনো দাবির জন্য শহীদ মিনারে জুতা পায়ে উঠেছেন এমন কোনো নজির নেই।
মাত্র ১৭ টি সরকারি কলেজ ছিলো এবং বিগত সরকারগুলো উপজেলা ও জেলা শহরের সেরা কলেজগুলোকে জাতীয়করণ করছেন। কিন্তু কতিপয় শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা এর বিরোধীতা করছেন। এত এত কলেজ সরকারি না হলে এত পদ থাকতো না। আর এত পদ না থাকলে তারা ক্যাডারের চাকরিই পেতেন না।
শিক্ষা ক্যাডারের সংখ্যা এত বেশি যে ক্যাডারের সংজ্ঞায় এখন আর কাভার করে না।