‘শিক্ষার সমস্যা সমাধানের চেয়ে আমরা এড়িয়ে যাওয়াই পছন্দ করি’

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

এবারে আমাদের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্ণ হলো। ইতিমধ্যেই আমরা পার করেছি ভাষা আর স্বাধীনতার মাস। ১৯৪৭ সালের প্রথম স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পর থেকেই মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা লাভ ও বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন-সংগ্রামের সূচনা হয়। এই আন্দোলনের পথ ধরেই বাঙালির জাতীয় জীবনে একটার পর একটা সফল আন্দোলন এসেছে। অবশেষে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিসংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন। বিজয়ের এ সুবর্ণজয়ন্তীতে সগর্ব চাঞ্চল্যে উত্সবমুখরিত বাংলাদেশ। কিন্তু এত আয়োজনের মধ্যেও একটি প্রশ্ন অবিরত মনকে যন্ত্রণাকাতর করে তোলে। বিজয়ের গর্বে উত্সাহিত মানুষ কি শুধু চমক সৃষ্টির জন্যই ভাষাসংগ্রামকে ভাষা আন্দোলনে রূপান্তর করে সব অর্জনকে সংকীর্ণতার বেড়াজালে আবদ্ধ করে ফেলেছে? মঙ্গলবার (৮ জুন) ইতে্তফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়,স্বাধীনতা অর্জনের পর নতুন রাষ্ট্রে বাংলা শুধু রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি পায়—তাই নয়, সর্বস্তরে বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়, বিশেষ করে প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষার স্তর পর্যন্ত শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলাকে গ্রহণ করা হয়। প্রাথমিকভাবে ভাষাসংগ্রামের অর্জন সফলতার মুখ দেখে। সংশ্লিষ্টরা জাতীয় বীর হিসেবে স্বীকৃত হয়ে সম্মানিত হওয়া শুরু করে। ইংরেজিতে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়(!) শিক্ষকরা বাংলায় বক্তৃতা দেওয়া শুরু করেন, শিক্ষার্থীরা বাংলায় পরীক্ষা দিতে থাকে। প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড বাংলায় লেখার জন্য পিকেটিং হয়। কিন্তু এখনো বাংলা সর্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। বিষয়টি খুব পরিষ্কার হয়ে যায়, যদি শিক্ষা কমিশনের বিশেষ করে মহাজোট সরকারের আমলে গঠিত দুটো কমিশনের প্রতিবেদনের দিকে দৃষ্টিপাত করা যায়। গৃহীত শিক্ষানীতি খুব সচেতনভাবে বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া থেকে সরে বিদেশি ভাষাপ্রীতির নজির রেখেছে।

কারণের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির প্রাক্কালেও বিশ্বের আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞানের বাংলা অনুবাদ আমাদের শিক্ষার্থীরা পায় না। স্বজাতির শাসনে মাতৃভাষায় শিক্ষার জন্য প্রতিটি বিষয়ের বইপত্র যদি বাংলায় পাওয়া না যায়, তবে কীসের গর্ব, কীসের অহংকার? শাসক শ্রেণি বাংলার উন্নতি অগ্রগতি যদি চাইত তাহলে কি আজ এমন অবস্থা হতে পারত? সাধারণ মানুষ ধারণা করে, শুধু ভাষার মাস এলেই শাসকশ্রেণির মনে বাংলাপ্রীতি জাগ্রত হয় এবং তার মধ্যেই তারা সীমিত থেকে যায়। ভাবখানা এমন যে, ভাষা দিবসকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত করা গেছে। আর কী চাই?

আরও পড়ুন : দৈনিক শিক্ষাডটকম পরিবারের প্রিন্ট পত্রিকা ‘দৈনিক আমাদের বার্তা’

আমাদের দার্শনিকরা নিজের ভাষায় মনোভাব প্রকাশে ব্যর্থ হলেও সাধারণ মানুষ আশাহত নয়। কারণ তাদের জন্য শিক্ষাব্যবস্থায় কিছু সুপার দার্শনিক আছেন। কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে পরিচিত করতে, বিষয়টি আয়ত্ত করতে, সর্বপরি জ্ঞানার্জনের জন্য বাংলাভাষার মাধ্যমে লিখিত বিষয়ভিত্তিক বইগুলো শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। আমাদের অর্জন খুব পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে। কিন্তু কিছু সমস্যা আছে। শিক্ষার্থীরা বাংলা ভাষায় বই পাচ্ছে কিন্তু তা বিশ্বের আধুনিক জ্ঞানভান্ডারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এতে শিক্ষার্থীরা পাশ করছে ঠিক; কিন্তু শিক্ষার মানের কোনো উন্নতি হচ্ছে না। অথচ শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, সচেতন নাগরিক, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ—কারোর মধ্যেই এ বিষয়ে কোনো উদ্বেগ দেখা যায় না। শিক্ষার সংকট ও সমস্যা সমাধানের চেয়ে আমরা এড়িয়ে যাওয়াই পছন্দ করি। দেশে আজ সামর্থ্যবানরা নিজ সন্তানদের বেশি অর্থ ব্যয়ে ইংরেজি স্কুলে পড়ানোর জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ছে। প্রচলিত যে ১১ ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে তার মধ্যে ছয়টির ওপর শিক্ষা অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণ নেই। অবস্থা বিশ্লেষণে মনে হয় দেশের সংবিধান, শিক্ষানীতি, সাধারণ মানুষের চাহিদা শাসকশ্রেণির মনে কোনো রেখাপাত করে না। বরং বর্তমান সময়ে দেশে প্রচলিত প্রাথমিক শিক্ষা ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। আমাদের বৈষম্যপূর্ণ সমাজে বৈষম্যের প্রথম পদক্ষেপ শিক্ষাব্যবস্থা থেকে শুরু হচ্ছে। তাই বাংলা মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়ার অনেক অসুবিধার কথা তারা বলেন; কিন্তু সমাধানে উদ্যোগী হন না। শিক্ষা কমিশনও একই পথে হাঁটছে। ফলে বাংলা মাধ্যমে শিক্ষায় জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। ইংরেজি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা যেভাবে কমিশন সামনে নিয়ে এসেছে তাতে বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যমে করার বিষয়টি সীমিত হয়ে পড়ছে।

দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব ও ফেসবুক পেইজটি ফলো করুন

শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে যে মানসম্পন্ন ইংরেজি লিখন-কথনের লক্ষ্যে যথাযথ কার্যক্রম শুরু থেকেই গ্রহণ করা হবে এবং ক্রমান্বয়ে ওপরের শ্রেণিসমূহে প্রয়োজনানুসারে সে কার্যক্রম জোরদার করা হবে। ফলে সব শিক্ষার্থীর জন্যই আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ইংরেজি ও ইসলাম ধর্মাবলম্বী হিসেবে আরবি শিক্ষায় জোর দেওয়া হচ্ছে। অথচ একটু অনুসন্ধান করলেই দেখা যায়, আমাদের যেসব শিক্ষার্থী বিদেশের বিভিন্ন দেশে শিক্ষা গ্রহণের জন্য এবং কর্মসংস্থানের জন্য যাচ্ছে তারা রাশিয়া, জাপান, চীন, জার্মানি, তুরস্ক ইত্যাদি দেশের ভাষা শেখার পরে পিএইচডি বা এমএসের মতো উচ্চতর ডিগ্রি সফলভাবে গ্রহণ করছে। এটা যদি সম্ভব হয়ে থাকে তবে আমরা কেন শিশুদের ওপর বিদেশি ভাষা শিক্ষার চাপ সৃষ্টি করে ঝরে পড়ার হার বৃদ্ধি করছি? সাধারণভাবে সবাই জানে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে সিংহভাগ শিক্ষার্থী এবং মাধ্যমিকের পর বাকি সিংহভাগ শিক্ষার্থী শিক্ষাজীবন শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করে থাকে। তাই শিক্ষা হতে হবে মানবসম্পদ পরিকল্পনা মোতাবেক। কর্মের জন্য যাকে যেভাবে তৈরি করা প্রয়োজন সে শুধু সেটুকুই গ্রহণ করবে। তবে উচ্চশিক্ষার সব দ্বার সবার জন্য খোলা থাকবে মেধা, যোগ্যতা আর দেশের মানবসম্পদ পরিকল্পনা অনুযায়ী। অকারণে প্রতিটা সেক্টরের জন্য বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাব শিক্ষা উন্নয়নের চেয়ে কর্তৃপক্ষকে খুশি করার প্রচেষ্টা বলেই মনে হয়।

ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে নৈতিক, মানবিক, সাংস্কৃতিক, বিজ্ঞানভিত্তিক ও সামাজিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠাকল্পে শিক্ষার্থীদের মননে, কর্মে ও ব্যাবহারিক জীবনে উদ্দীপনা সৃষ্টি করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অনুপ্রাণিত করে তোলা, চিন্তাচেতনায় দেশাত্মবোধ ও জাতীয়তাবোধ এবং চরিত্রে সুনাগরিকের গুণাবলির ন্যায়বোধ, কর্তব্যবোধ, ধর্মনিরপেক্ষতা বোধ, মানবাধিকার সচেতনতা, শৃঙ্খলা, সহজীবনযাপনের মানসিকতা, সৌহার্দ্য, অধ্যবসায় ইত্যাদির বিকাশ ঘটানোর লক্ষ্যে যে সত্যিকারের জ্ঞান অর্জন প্রয়োজন তা শুধু মাতৃভাষাতেই সম্ভব। বিশ্বের সব প্রান্তের জ্ঞানভান্ডারে সমৃদ্ধশালী করা না হলে মর্যাদাবান মানুষ তৈরি অসম্ভব হবে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনের প্রাক্কালে দেখা যায়, একদিকে বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম করা, অপরদিকে প্রয়োজনীয় পাঠ্যপুস্তক বাংলা ভাষায় না থাকায় শিক্ষাব্যবস্থায় বিপর্যয় নেমে এসেছে। কমিশন এ সমস্যার গভীরতা উপলদ্ধি করে বিশ্বের আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞানের বিষয়গুলোর বাংলা অনুবাদের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। গৃহীত শিক্ষানীতির ১০ বছর অতিক্রান্ত হলেও আজও এ বিষয়ে কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়নি। শুধু ইংরেজি নয়, বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার জ্ঞানভান্ডারে বাংলাকে সমৃদ্ধ করতে অবিলম্বে অনুবাদকের দল তৈরি করা প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বা বাংলা একাডেমি নয়, পৃথক অনুবাদক সংস্থা গঠন করতে হবে। যারা প্রতিনিয়ত বিশ্বের যে কোনো জ্ঞানসম্পর্কিত বিষয় অনুবাদ করে শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেবেন। প্রয়োজনে বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। তবেই আমাদের ভাষাসংগ্রাম পূর্ণতা পাবে। শিক্ষার মানোন্নয়ন ঘটবে।

লেখক :এম আর খায়রুল উমাম,সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইডিইবি)

দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল  SUBSCRIBE   করতে ক্লিক করুন।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
অভিযুক্ত শিক্ষা সাংবাদিকদের পক্ষে জোর তদবির - dainik shiksha অভিযুক্ত শিক্ষা সাংবাদিকদের পক্ষে জোর তদবির যৌন হয়রানি: ঢাবি শিক্ষক নাদির জুনাইদকে অব্যাহতি - dainik shiksha যৌন হয়রানি: ঢাবি শিক্ষক নাদির জুনাইদকে অব্যাহতি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে যৌ*ন হয়*রানি: ঢাবি শিক্ষক নাদির জুনাইদকে অব্যাহতি - dainik shiksha যৌ*ন হয়*রানি: ঢাবি শিক্ষক নাদির জুনাইদকে অব্যাহতি নতুন শিক্ষাক্রমের ৩১ পাঠ্যবইয়ে ১৪৭ ভুল - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রমের ৩১ পাঠ্যবইয়ে ১৪৭ ভুল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী আজ - dainik shiksha বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী আজ তত্ত্বাবধায়ককে বাধ্য করে ঢাবি শিক্ষকের পিএইচডি - dainik shiksha তত্ত্বাবধায়ককে বাধ্য করে ঢাবি শিক্ষকের পিএইচডি please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0037760734558105