শিক্ষার্থীরা নিজেরা পড়াশোনায় ফাঁকি দিলেও ফাঁকিবাজ শিক্ষকদের পছন্দ করেন না বলে মন্তব্য করেছেন শিক্ষাবিদরা।
কুমিল্লা মডার্ন স্কুলের সাবেক সহকারী প্রধান শিক্ষক মো. আবুল হোসেন বলেন, প্রায় ৪৯ বছরে তিনি ক্যাজুয়াল লিভ (সিএল) নেননি। জীবনে দেরি করে স্কুলেও যাননি। শিক্ষার্থীদের নিজের সন্তানদের মতোই দেখেছেন। নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক ময়মনসিংহের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় হাইস্কুলের সাবেক জ্যেষ্ঠ শিক্ষক আফরূজ জাহান বেগমের ভাষায়, ছাত্ররা নিজেরা ফাঁকি দিলেও ফাঁকিবাজ শিক্ষক পছন্দ করে না। অনুষ্ঠানের মাঝে ‘আমি বাংলায় গান গাই,...’ গানটি গেয়ে শোনান সংগীতশিল্পী শুভ।
টাঙ্গাইলের আউলিয়াবাদ মাজার দাখিল মাদ্রাসার জুনিয়র মৌলভি রহিমা খাতুন শুধু শিক্ষকতাই করে যাননি, শিক্ষার্থীদের নানা সমস্যার সমাধানেও এগিয়ে যান। বিশেষ করে ছাত্রীদের বাল্যবিবাহ রোধে কীভাবে ভূমিকা রাখেন, সেই কথাও তুলে ধরেন তাঁর বক্তৃতায়। যশোরের ঝিকরগাছা সরকারি এম এল মডেল হাইস্কুলের সাবেক সহকারী প্রধান শিক্ষক মো. আবদুর রশিদ বলেন, ভালো শিক্ষক হতে হলে শিক্ষার্থীদের ভালোবাসতে হবে। তারা কী চায়, সেটা জানতে হবে। সম্মাননা পাওয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গোকর্ণ পশ্চিম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক দেবী রানী দাশ অসুস্থতার কারণে অনুষ্ঠানে আসতে পারেননি। তাঁর পক্ষে সম্মাননা গ্রহণ করেন তাঁর ছেলে।
চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক মোছা. করিমা খাতুন এখন অসুস্থ। ঠিকমতো কথা বলতে পারেন না। তারপরও অসম্ভব প্রাণশক্তি থাকা এই নারীকে হুইলচেয়ারে করে তাঁর স্বজনেরা অনুষ্ঠানে নিয়ে আসেন। অনুষ্ঠানে তাঁর ছেলের স্ত্রী বললেন, তাঁকে আনা হয়েছে তিনি যেন অনুভব করেন তাঁকে এই সম্মাননা দেওয়া হয়েছে।
রাজশাহীর পিরিজপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সাবেক সহকারী শিক্ষক মো. জমিউল করিম পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের প্রেরণা হিসেবে কাজ করে গেছেন। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে সম্মাননার জন্য নির্বাচন করায় তিনি ধন্যবাদ জানান। সম্মাননা গ্রহণের পর কক্সবাজারের কাহারিয়াঘোনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক সহকারী শিক্ষক মো. ফয়েজ আহমদ বলেন, তিনি অত্যন্ত খুশি ও আনন্দিত। এই সম্মাননা তাঁর জীবনে বড় পাওয়া। অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে ভিডিও চিত্রের মাধ্যমে সম্মাননা পাওয়া শিক্ষকদের নিজের কথায় তাঁদের কর্মময় জীবন তুলে ধরেন।
অতিথিরা যা বললেন
সম্মাননা তুলে দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম সম্মাননা পাওয়া প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের উদ্দেশে বলেন, তাঁরাই মানুষ গড়ার প্রকৃত কারিগর। তিনি মনে করেন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের সবচেয়ে বেশি বেতন হওয়া দরকার। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ আক্ষেপ করে বলেন, তিনি যখন স্কুলের ছাত্র ছিলেন, তখন শিক্ষকদের বড় দাম ছিল। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে অনগ্রসর থাকলেও সামাজিকভাবে অগ্রসর ছিলেন। এখন তা নেই। ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য চৌধুরী মফিজুর রহমান বলেন, স্কুলশিক্ষকদের উত্তরাধিকারই তাঁরা এখনো বহন করে চলছেন।
ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের উপাচার্য এইচ এম জহিরুল হক অ্যাসিড–সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রথম আলোর উদ্যোগসহ বিভিন্ন উদ্যোগের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। স্বাগত বক্তব্যে আইপিডিসি ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মমিনুল ইসলাম বলেন, গত ৫০ বছরে দেশ অনেক দূর এগিয়েছে। তারপরও কিছু কিছু ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত মান অর্জনে পিছিয়ে আছে। তার একটি হলো শিক্ষা। শিক্ষার মান বাড়াতে হলে শিক্ষকদের সম্মান ও সম্মাননা—দুই দিকেই নজর দিতে হবে। এ ছাড়া সম্মাননা তুলে দেওয়া শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন মতিঝিলের আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগম ও সেন্ট যোসেফ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ব্রাদার লিও প্যারেরা।
আইপিডিসি-প্রথম আলো প্রিয় শিক্ষক সম্মাননা ২০২০ পাওয়া শিক্ষকেরা। বাঁ থেকে আফরূজ জাহান বেগম, শাহনাজ কবীর, মো.ফয়েজ আহমদ, মোছা. করিমা খানম, মো. আবদুর রশিদ, মো. জমিউল করিম, রহিমা খাতুন, মো. আবুল হোসেন। আজ বিকেলে রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে আইপিডিসি-প্রথম আলো প্রিয় শিক্ষক সম্মাননা ২০২০ পাওয়া শিক্ষকেরা। বাঁ থেকে আফরূজ জাহান বেগম, শাহনাজ কবীর, মো.ফয়েজ আহমদ, মোছা. করিমা খানম, মো. আবদুর রশিদ, মো. জমিউল করিম, রহিমা খাতুন, মো. আবুল হোসেন। আজ বিকেলে রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলেছবি: হাসান রাজা করোনা সংক্রমণের কারণে প্রায় এক বছর ধরে ভয়ংকর পরিস্থিতির কথা তুলে ধরেন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান। তিনি বলেন, তাঁদের জীবদ্দশায় এমন একটি সময় পার করবেন, তা কখনো ভাবেননি। এটি অবিশ্বাস্য ও ভয়ংকর সময়। আবার একই সঙ্গে নতুন অনেক কিছু জানাও গেল। ভবিষ্যতে কীভাবে চলতে হবে, তার অনেক কিছু্ই শিখে নেওয়া গেল।
এ সময় করোনাকালে মারা যাওয়ার জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী এবং করোনায় মারা যাওয়ার সব মানুষকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন মতিউর রহমান। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়কারী মাহবুবা সুলতানা।
গত ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবসে ভার্চ্যুয়ালি শিক্ষক বাছাইপর্বের অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল। মনোনয়ন পাওয়া মোট ৭৭৬ জন শিক্ষকের মধ্য থেকে ৯ জনকে বেছে নেন বিচারকমণ্ডলী।