তার গণমুখী চরিত্রের প্রতিফলন ঘটেছে জনগণের নেতা হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে। অতঃপর সফল জনপ্রতিনিধি। এখন সফল রাষ্ট্রপতিও তিনি। আস্থা-বিশ্বাস, সততা ও আদর্শবান রাজনীতিবিদও। তাকে বলা যায় রাজনীতিবিদদের আদর্শ। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ সম্পর্কে এমন মূল্যায়ন করেছেন তারই সহকর্মী, বন্ধুরা। একসঙ্গে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া রাজনৈতিক সহকর্মী-বন্ধুরা রাষ্ট্রপতি সম্পর্কে আরও বলেন, দেশের সফল জনসেবক হিসেবে তিনি অদ্বিতীয়ও বলা যায়।
গতকাল রোববার ৮০-তে পা রেখেছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। গুণী এ রাজনীতিক ১৯৪৪ সালের ১ জানুয়ারি কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার কামালপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা হাজি মো. তায়েবউদ্দিন এবং মা তমিজা খাতুন। কামালপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তার শিক্ষাজীবন শুরু। এরপর ভৈরব কেবি স্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন। এসএসসি পাস করেন নিকলী উপজেলার গোড়াচাঁদ হাই স্কুল থেকে। কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক পাস করার পর ঢাকার সেন্ট্রাল ল কলেজ থেকে এলএলবি ডিগ্রি নিয়ে কিশোরগঞ্জ বারে আইন পেশায় যোগ দেন আবদুল হামিদ।
২৬ বছর বয়সে পাকিস্তান পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হওয়া আবদুল হামিদ দেশের সর্বোচ্চ সম্মান ও মর্যাদার আসন রাষ্ট্রপতি পদে আছে দ্বিতীয়বারের মতো। বড় এ দায়িত্বপালন করতে গিয়ে এখন পর্যন্ত নেতিবাচক কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার নজির নেই।
রাষ্ট্রপতির জন্মদিন উপলক্ষে তার রাজনৈতিক সহকর্মী প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ রাষ্ট্রপতিকে সফল রাজনীতিবিদ দাবি করে বলেন, ‘১৯৭০ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত পাকিস্তান পার্লামেন্টের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য ছিলেন আবদুল হামিদ। দ্বিতীয় কনিষ্ঠ ছিলাম আমি।’ তিনি আরও বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি অত্যন্ত নিরহংকারী একজন মানুষ, আমার প্রিয় একজন রাজনীতিক ব্যক্তিত্ব।’
আশিতে পা রাখা রাষ্ট্রপতি সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরীবলেন, ‘আবদুল হামিদ কর্মগুণে জনগণের নেতা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন অনেক আগে। উনি রাজনীতিবিদদের কাছে গর্বের নাম।’ তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি সবকিছুতেই রেকর্ড করেছেন। জনপ্রতিনিধি হিসেবে কখনই অকৃতকার্য হননি। তার এলাকার মানুষ সাতবার সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত করেছেন।’
বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ কর্মী আবদুল হামিদের জীবন সফল দাবি করে মতিয়া চৌধুরী আরও বলেন, সফল জনসেবক ও সফল রাষ্ট্রপতি হিসেবে মানুষের আস্থা অর্জন করেছেন। শত্রুরাও সফল ব্যক্তিত্ব বলবেন তাকে।’
১৯৬৯ সালে ছাত্রলীগে যোগদানের মাধ্যমে রাজনীতিতে আবদুল হামিদের হাতেখড়ি। পরিশ্রমের স্বীকৃতি হিসেবে অল্পদিনেই কিশোরগঞ্জ ছাত্রলীগের প্রভাবশালী নেতায় পরিণত হন তিনি। একসময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্নেহ-সান্নিধ্য লাভ করেন তিনি। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত পছন্দে বিস্তীর্ণ হাওরের দুর্গম এলাকা থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে জাতীয় পরিষদে (ময়মনসিংহ-১৮) সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন আবদুল হামিদ। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন তিনি। ভারতের মেঘালয়ে রিক্রুটিং ক্যাম্পে এবং সে সময়ে সুনামগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জে বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সের (মুজিব বাহিনী) সাব-সেক্টর কমান্ডার পদসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন আবদুল হামিদ।
১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। একে একে তার নির্বাচনী এলাকা থেকে সাতবার বিজয়ী হয়ে জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেন আবদুল হামিদ।
সত্তরের পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের আরেক সদস্য টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলুর রহমান ফারুক বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ভীষণ মনুষ্যত্ববোধ সম্পন্ন মানুষ। ছাত্রজীবন থেকেই গণমুখী রাজনীতিবিদ হিসেবে আভির্ভূত হন তিনি।’
রাষ্ট্রপতি তার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন দাবি করে প্রবীণ এ আওয়ামী লীগ নেতা আরও বলেন, ‘ছাত্রলীগ করে আবদুল হামিদ জেল খেটেছেন। আমিও তার সঙ্গে জেল খেটেছি।’ রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বহু স্মৃতি রয়েছে দাবি করে ফারুক বলেন, ‘উনি রাজনীতির জন্য, গণমানুষের জন্য নিবেদিত মানুষ ছিলেন। অন্যায়ের সঙ্গে কখনই আপস করেননি রাষ্ট্রপতি। সৎ, আদর্শবান রাজনীতিকের প্রতিকৃত তিনি।’
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যার পর চরম বৈরী রাজনৈতিক পরিবেশেও আবদুল হামিদ তার বিশ্বাস এবং আদর্শের জায়গা থেকে তিলমাত্র বিচ্যুত হননি। এ কারণে ১৯৭৬ সালে তাকে কারাবরণ করতে হয়। তবে কোনো নিপীড়নই তাকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে সরাতে পারেনি।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে আবদুল হামিদ জাতীয় সংসদে ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন। পরে একই সংসদে স্পিকারের দায়িত্ব পান। জাতীয় সংসদে সব দলের কাছেই হয়ে ওঠেন অত্যন্ত জনপ্রিয় ব্যক্তি। ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে গেলে বিরোধীদলীয় উপনেতার দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদে আবারও তিনি স্পিকার নির্বাচিত হন। দেশের ১৯তম রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের মৃত্যুর পর আবদুল হামিদ ২০তম রাষ্ট্রপতি হন। দ্বিতীয় মেয়াদে তিনি ২১তম রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন ২০১৮ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি। মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় স্বাধীনতা পদক লাভ করেন তিনি।