একটি দেশ ও শিক্ষকদের বিভিন্ন জীবনযাত্রার মান

মো. জাহাঙ্গীর আলম |

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান; তিনি শুধু একজন ব্যক্তি ছিলেন না, ছিলেন একটি দেশের একটি জাতির নাম। তিনি ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ৭ মার্চ জাতির উদ্দেশ্যে যে বক্তব্য দিয়েছিলেন তা থেকেই গড়ে উঠেছে একটি দেশ যা আজকের বাংলাদেশ। সেখানে তিনি একটি কথা বলেছিলেন, “রক্ত যখন দিয়েছি,ররক্ত আরো দেবো, এ দেশকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ”। এই একটি কথার ভাবার্থ অনেক, যা শুনে এ জাতি উজ্জীবিত হয়েছিল এবং ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ গঠিত হয়েছিল।

দেশকে মুক্ত বলতে তিনি কি শুধু রাজনৈতিক মুক্তির কথা বলেছিলেন? আমার তা মনে হয় না। আমার মনে হয়, তিনি সর্বক্ষেত্রে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন, অর্থাৎ বৈষম্য মুক্ত, অর্থনীতি, সমাজব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা, চিকিৎসা ব্যবস্থা ইত্যাদি। সেই লক্ষ্যেই তিনি স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে একটি ভঙ্গুর অর্থনীতি গঠনে কাজ করে যাচ্ছিলেন। শিক্ষাব্যবস্থা বিনির্মাণে তিনি কেবলমাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারিকরণ দিয়ে শুরু করেছিলেন এবং তিনি থাকলে আর অল্পদিনেই বাকি শিক্ষাব্যবস্থাও সরকারিকরণ হতো এটা নিশ্চিন্তে বলা যায়। কিন্ত দুর্ভাগ্য আমাদের, কতিপয় দুষ্টু বুদ্ধির বেড়াজালে ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগস্ট আমরা শুধু বঙ্গবন্ধুকে হারাইনি, হারিয়েছি একটি সুন্দর বাংলাদেশ প্রায় ৩০ বছরের জন্য। পরবর্তী সময়ে বহু পট পরিবর্তনের পর আমরা আবার বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নপূরণের কাছাকাছি তারই সুযোগ্য কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার হাত ধরে।

কিন্ত বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যার ফলে পরবর্তী সময়ে সিস্টেমগত যে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে তা আজও পূরণ সম্ভব হয়নি। তারই একটি বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষা দেন যিনি, তিনি যদি শিক্ষক হন তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে শুরু করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সকলেই সম্মানীয়। কিন্তু জীবনযাত্রার মানে বিস্তর ফারাক। শিক্ষাগত যোগ্যতা বিবেচনা করলে প্রায় কাছাকাছি। প্রথমে আসি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যদি স্বায়ত্বশাসিত হয় তবে তাদের জীবন যাত্রার মান আর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জীবনযাত্রার মানের অনেক পার্থক্য। অথচ শিক্ষাগত যোগ্যতা ও শিক্ষাদান পদ্ধতি সমমানের। এরপরে আসি সরকারি ও বেসরকারি কলেজ যেখানে একই শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পূর্ণ শিক্ষক হওয়া সত্ত্বেও এবং সমমানের শিক্ষা প্রদান করা সত্ত্বেও জীবনযাত্রার মানে বিস্তর ফারাক।

একই কাজ করেও কারো বাড়ি ভাড়া ১০ হাজার, কারো ১ হাজার; কারো চিকিৎসা ভাতা ৪ হাজার, কারো ৫০০; কেউ পায় ১০০ শতাংশ উৎসব বোনাস, কেউ সিকি আনা। অবাক করা বিষয় হলো বেসরকারি কলেজের একজন অধ্যক্ষ ৪র্থ গ্রেডে চাকরি করে যে বাড়ি ভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা পান তার কলেজের-ই সুইপার ১৯ গ্রেড একই বাড়ি ভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা পান। এই একটি যায়গায় যেন তাদের সমতার বিধান বিদ্যমান। এটা বিশ্বে কোনো চাকরিক্ষেত্রে আছে কি না আমার জানা নেই।

আবার যারা নন-এমপিও বেসরকারি শিক্ষক তারা বছরের পর বছর শিক্ষাদান করবেন না খেয়ে। অর্থাৎ তাদের সংসার বৌ-বাচ্চা কিছুই নেই। এর পরে আসি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ও সরকারি বিধি মোতাবেক নিয়োগকৃত বেসরকারি কলেজের অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষক উনারাও সম যোগ্যতা নিয়ে শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করে। কিন্তু দুঃখের বিষয় ২৫ বছর যাবৎ আজ অবধি তারা জনবল কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত হতে পারছে না, এমপিও তো দূরের কথা। তাদেরই বা অপরাধ কি আমার বোধগম্য হয় না। আমার প্রশ্ন হলো, পারিশ্রমিক যদি না দেয়া যাবে তাহলে নিয়োগের অনুমতি কেন? যেখানে আমাদের মহানবী (সা.) বলেছেন, “শ্রমিকের ঘাম শুকানোর পূর্বেই তাদের পারিশ্রমিক দিয়ে দাও”।

এরপরে আসি সরকারি ও বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের কথায়। একই অবস্থা, অর্থাৎ কলেজের মতোই বৈষম্য। এরপরে আসি সরকারি ও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আজ এই করোনা মহামারির দুর্যোগকালে বেসরকারি উচ্চ মাধ্যমিক সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষকরা নিদারুণ কষ্টে দিনযাপন করছে। আমার কথা হলো- এদের যোগ্য মজুরি না দেয়া গেলে এদের অনুমোদনই দেয়া ঠিক হয়নি। তাহলে যে শিক্ষকটি আজ নিদারুণ কষ্টে দিনযাপন করছে সে এই পেশায় আসতই না। সমস্যারও সৃষ্টি হতো না।

একবার শিক্ষকতার মতো একটি সন্মানীয় পেশায় এসে ত্রাণের জন্য রাস্তায় দাঁড়ানো বা অন্যের কাছে হাত বাড়ানো দেশের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী একজন ব্যক্তির কাছে কতটা সন্মান হানিকর তা বোঝানো খুব কঠিন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মানবতার মা। তিনি সরকার গঠনের পর বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাস্তবায়নের পথে অনেকটাই এগিয়েছে। যেমন ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে একযোগে তিনি প্রায় ৩০০ স্কুল, কলেজ সরকারিকরণ করেছেন এবং তার এ উদ্যোগ বর্তমানেও চলমান। অর্থাৎ প্রতিনিয়ত বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সরকারিকরণ হয়ে যাচ্ছে, যা তিনি আসার পূর্বে এবং বঙ্গবন্ধুর প্রস্থানের পরে প্রায় বন্ধই ছিল।

বেসরকারি শিক্ষকরা সারাজীবন একটি ছোট ইনক্রিমেন্ট নিয়েই চুপচাপ থাকত। ফলে সরকারি কলেজের একজন পিয়নের বেতন একসময় বেসরকারি শিক্ষকের বেতন টপকে যেতো। কিন্ত এখন আর সে সুযোগ নেই। কারণ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বদৌলতে বেসরকারি শিক্ষকরাও এখন সরকারি শিক্ষকদের ন্যায় বার্ষিক ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট ও  ২০ শতাংশ বৈশাখী ভাতা পান। আমাদের আশা ছিল এই মুজিববর্ষেই আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সরকারিকরণ হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য যেন পিছু ছাড়ে না, তাই হানা দিলো করোনা। আবার আমরা পিছিয়ে পড়লাম।

সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষক নিয়োগের একটি আলাদা কমিশন গঠন হলে এবং সেই কমিশন কর্তৃক মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে প্যানেল গঠন করে যে যেই পর্যায়ে যোগ্য তাকে সেই প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দিয়ে মজুরি প্রদান নিশ্চিত করা গেলে এ বৈষম্য দূরীকরণ সম্ভব বলে আমার মনে হয়। বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একই সাথে শিক্ষাবান্ধব প্রধানমন্ত্রী। তার কাছে শিক্ষকদের এই বাকি বৈষম্যগুলো সঠিকভাবে উপস্থাপন করা গেলে দ্রুতই আমরা একটি বৈষম্যহীন শিক্ষক সমাজ দেখতে পাবো বলে আমার বিশ্বাস। তার সঙ্গে শিক্ষার সার্বিক উন্নয়নের মাধ্যমে একটি উন্নত জাতি হিসেবে গড়ে উঠবো।

লেখক : মো. জাহাঙ্গীর আলম, বিভাগীয় প্রধান, অর্থনীতি বিভাগ, কে.বি.এম.কলেজ, দিনাজপুর।

[মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন।]


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0051918029785156