বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি শামসুর রাহমানের ১২তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। আধুনিক বাংলা কবিতায় সৃষ্টি ও মননের দ্যুতিময় উপস্থাপনা তাকে নিয়ে যায় অনন্য উচ্চতায়। ২০০৬ সালের এদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। পুরান ঢাকার মাহুৎটুলিতে ১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবর কবির জন্ম। নগরেই তার বেড়ে ওঠা। তাই নাগরিক কষ্ট, দুঃখ-সুখ তার কবিতায় বিশেষভাবে উঠে এসেছে। জীবনের সত্য-সুন্দরকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অনন্য। পাশাপাশি বাঙালির সব আন্দোলন-সংগ্রামের গৌরবদীপ্ত অধ্যায় ফিরে এসেছে তার কবিতায়।
শামসুর রাহমানের কবিতা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৪৯-এ, সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকায়। তিনি বিভিন্ন পত্রিকায় সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয় লিখতে গিয়ে নানা ছন্দনাম নিয়েছেন, যেমন— সিন্দবাদ, চক্ষুষ্মান, লিপিকার, নেপথ্যে, জনান্তিকে, মৈনাক প্রভৃতি। পাকিস্তান সরকারের আমলে কোলকাতার একটি সাহিত্য পত্রিকায় মজলুম আদিব (বিপন্ন লেখক) নামে কবিতা ছাপা হয়। ওই নাম দিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও সমালোচক আবু সায়ীদ আইয়ুব। শামসুর রাহমান পাকিস্তানি স্বৈরশাসক আইয়ুব খানকে বিদ্রƒপ করে ১৯৫৮ সালে সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল (পত্রিকা) পত্রিকায় লেখেন ‘হাতির শুঁড়’ নামক কবিতা। বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান যখন কারাগারে তখন তাকে উদ্দেশ করে লেখেন অসাধারণ কবিতা ‘টেলেমেকাস’। রেডিও পাকিস্তানে রবীন্দ্রসংগীত সম্প্রচার নিষিদ্ধ করলে শামসুর রাহমান তখন সরকার নিয়ন্ত্রিত পত্রিকা দৈনিক পাকিস্তান-এ কর্মরত থাকা অবস্থায় পেশাগত অনিশ্চয়তার তোয়াক্কা না করে রবীন্দ্রসংগীতের পক্ষে বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন যাতে আরও স্বাক্ষর করেছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান, আহমেদ হুমায়ুন, ফজল শাহাবুদ্দিন। ১৯৬৮ সালের দিকে পাকিস্তানের সব ভাষার জন্য অভিন্ন রোমান হরফ চালু করার প্রস্তাবে ক্ষুদ্ধ হয়ে কবি লেখেন মর্মস্পর্শী কবিতা ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’।
১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি গুলিস্তানে একটি মিছিলের সামনে একটি লাঠিতে শহীদ আসাদের রক্তাক্ত শার্ট দিয়ে বানানো পতাকা দেখে মানসিকভাবে মারাত্মক আলোড়িত হন শামসুর রাহমান এবং তিনি লিখেন ‘আসাদের শার্ট’ কবিতাটি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিবার নিয়ে চলে যান নরসিংদীর পাড়াতলি গ্রামে। এপ্রিলের প্রথম দিকে তিনি লেখেন যুদ্ধের ধ্বংসলীলায় আক্রান্ত ও বেদনামথিত কবিতা ‘স্বাধীনতা তুমি’ ও ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’। শামসুর রাহমান ১৯৮৭ সালে এরশাদের স্বৈরশাসনের প্রতিবাদে দৈনিক বাংলার প্রধান সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৮৭ থেকে পরবর্তী চার বছরের তিনি প্রথম বছরে ‘শৃঙ্খল মুক্তির কবিতা’, দ্বিতীয় বছরে ‘স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কবিতা’, তৃতীয় বছরে ‘সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কবিতা’ এবং চতুর্থ বছরে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কবিতা’ লেখেন। ১৯৯১ সালে এরশাদের পতনের পর লেখেন ‘গণতন্ত্রের পক্ষে কবিতা’। অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও জনমানুষের প্রতি অপরিসীম দরদ তার চেতনায় প্রবাহিত ছিল। শামসুর রাহমানের বিরুদ্ধে বারবার বিতর্ক তুলেছে কূপম-ুক মৌলবাদীরা। তাকে হত্যার জন্য বাসায় হামলা করেছে। এত কিছুর পরও কবি তার বিশ্বাসের জায়াগায় ছিলেন অনড়।
শামসুর রহমানের কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ৬৬। তিনি ৪টি উপন্যাসও লিখেছেন। অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন কবি। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য আনন্দ পুরস্কার, একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং যাদবপুর ও রবিন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডিলিট। শামসুর রাহমানের লেখা উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘বিধ্বস্ত নীলিমা’, ‘নিরালোকে দিব্যরথ’, ‘আমি অনাহারী’ প্রভৃতি।
বাংলাভাষার অন্যতম এই প্রধান কবির মৃত্যুবাষির্কী উপলক্ষে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন নানা কর্মসূচির আয়োজন করেছে। জাতীয় কবিতা পরিষদের পক্ষ থেকে সকাল সাড়ে দশটায় বনানী কবরস্থানে কবির সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। এ ছাড়াও কবির সমাধিতে শামসুর রাহমানের পরিবারের সদস্যরা এবং বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। কবির গ্রামের বাড়ি নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার পাহাড়তলী গ্রামেও দিবসটি বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পালিত হবে।