চাকরিপ্রার্থীদের অভিযোগ আমলে নিন

ড. সুলতান মাহমুদ রানা |

সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) নিয়োগ প্রক্রিয়ায় নির্দিষ্ট সময় পরীক্ষা না নেওয়া, ভুল প্রশ্নে পরীক্ষা নেওয়া, প্রশ্নপত্র ফাঁস, প্রশ্নপত্র ফাঁসের পর অনুষ্ঠিত পরীক্ষা স্থগিত করতে বাধ্য হওয়া, ফলাফল প্রকাশ করার পর পুনর্মূল্যায়ন করে আবার প্রকাশ করা, নিয়োগের সময় নিয়ম লঙ্ঘনের অভিযোগ ইত্যাদি একটি স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বিসিএস পরীক্ষায় দীর্ঘসূত্রতার পাশাপাশি দীর্ঘদিন থেকেই প্রশ্নপত্রে ভুলের সংস্কৃতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হওয়ায় এর বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করে খুব বেশি সুবিধা আদায় সম্ভব হয় না। বিভিন্ন সময়ে প্রশ্নপত্রে ভুলের ইস্যুতে উচ্চ আদালত থেকে রুলনিশি জারি করেও এ বিষয়ে সুষ্ঠু ও সুন্দর সমাধান সম্ভব হয়নি। বলা যায়, পিএসসির নিয়োগ প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার সঙ্গে প্রশ্নপত্রে ভুলের মাত্রাটি এখন সমান্তরালভাবেই এগিয়ে চলেছে। এমনকি বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগও পাওয়া যায়। বিসিএসের মতো পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে ভুল এবং প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। বিভিন্ন স্তরের পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে জোরালো প্রতিবাদ থাকলেও পিএসসির ভুল প্রশ্নপত্র নিয়ে কোনো জোরালো প্রতিবাদ এখন পর্যন্ত চোখে পড়েনি।

গত ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ৩৮তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রেও মোট ১৪টি ভুল প্রশ্ন ছিল। এমন সংবাদ গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে পিএসসির চেয়ারম্যান ভুল প্রশ্নপত্রের কারণে কোনো পরীক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হবে না বলে ঘোষণা দেন। এ ঘোষণার কারণে এ বিষয়ে জোরালো কোনো প্রতিবাদ পরীক্ষার্থীরা করেনি। এমনকি পরে বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকার মাধ্যমে ওএমআর মেশিন ত্রুটিপূর্ণ ও অচল হওয়ার সংবাদটি প্রচারিত হয়। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ৩৮তম বিসিএসের ফল প্রকাশিত হয়। এতে অনেক মেধাবী ফলবঞ্চিতদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এ সূত্র ধরে গত ৪ মার্চ ফলবঞ্চিতদের স্বাক্ষর সংবলিত কয়েকটি অসঙ্গতি উল্লেখপূর্বক পিএসসির চেয়ারম্যান বরাবর একটি আবেদনপত্র জমা দেওয়া হয়। 

মূলত যেসব বিষয় উল্লেখ করে আবেদনটি দেওয়া হয়, সেগুলো হলো- ১. ৩৮তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার ফলাফলে অনেক পরীক্ষার্থী ১০০ নম্বর প্রত্যাশী হয়েও উত্তীর্ণ হয়েছে অথচ ১২০-১২৫ এমনকি ১৩০ নম্বর প্রত্যাশী হয়েও উত্তীর্ণ হয়নি, যা সঠিক তদন্তের মাধ্যমে প্রমাণযোগ্য; ২. কমিশন এ পর্যন্ত তাদের ওয়েবসাইটে ৩৮তম বিসিএসের ফল মোট চারবার প্রকাশ করেছে। প্রথমে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ৬টার সময় ফল প্রকাশ করে রাত ৮টার পরে প্রত্যাহার করে নেয়, যে ফলাফলে ২৫নং পৃষ্ঠায় ৩৭তম বিসিএস উল্লেখ ছিল। ওইদিন রাত ৯টার পরে আবার ফল প্রকাশ করে, যা ছিল সম্পূর্ণরূপে অস্পষ্ট ও অপাঠ্য। গত ১ মার্চ রাত ৩টার পরে আবার আগের মতো '৩৭তম বিসিএস লেখা'সহ ফল প্রকাশিত হয়। ৩. সাধারণ পরীক্ষার্থীদের মধ্যে সাধারণ, পেশাগত ও কারিগরি ক্যাডারে ভিন্ন ভিন্ন নম্বরে প্রার্থীরা উত্তীর্ণ হয়েছে- এ বিষয়ে যথেষ্ট প্রমাণ আছে। এ ছাড়া স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে পঠিত ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন কোয়ালিফাইং নম্বরের (কাট মার্কস) বিষয়টি সন্দেহকে তীব্রতর করেছে। ৪. গৃহীত পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে মোট ১৪টি ভুল ও দ্বিধান্বিত প্রশ্ন আছে, যা ফলাফলে চরম অসামঞ্জস্যতার সৃষ্টি করেছে। ৫. ওএমআর মেশিনে ত্রুটির কারণে পূর্ণাঙ্গ প্রযুক্তিগত প্রক্রিয়াটি সবার কাছে যৌক্তিকভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ।

উল্লিখিত অভিযোগগুলো নিঃসন্দেহে তদন্ত ও প্রমাণযোগ্য। ফলবঞ্চিতদের লিখিত এ অভিযোগগুলো কোনোভাবেই পিএসসির এড়িয়ে যাওয়া যুক্তিসঙ্গত কিংবা মানানসই হবে না। এসব সমস্যার দায় পিএসসি কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। বিশেষ করে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ত্রুটিপূর্ণ মেশিন কোনোভাবেই একটি নির্ভুল ও গ্রহণযোগ্য ফল প্রকাশের ক্ষেত্রে নিশ্চয়তা বিধান করতে পারে না।

বিসিএস পরীক্ষায় নানা জটিলতা থাকায় স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ প্রার্থী একটির বেশি দুটি বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিতে পারে না। কারণ বাংলাদেশে চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩০ বছর। যেহেতু একটি বিসিএস পরীক্ষা সম্পন্নের মাধ্যমে চূড়ান্ত নিয়োগ দিতে দুই-আড়াই বছর সময় লেগে যায়। ফলে একজন স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ প্রার্থী পরবর্তী বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ এবং আগ্রহ দুটিই হারিয়ে ফেলে। তারপর যদি একজন পরীক্ষার্থী পিএসসির গাফিলতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে সেটি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। প্রতি বছরের শুরুতে বিসিএস পরীক্ষার বিজ্ঞাপন প্রকাশ হওয়ার একটি অলিখিত প্রচলন চালু থাকলেও এ বিধান মানা হয় না যথাযথভাবে।

যে কোনো রাষ্ট্রে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে কর্মসংস্থান তৈরির সুযোগ সৃষ্টি এবং সুবিধা প্রদান উভয়ই রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই কর্মসংস্থানের বিষয়টি জাতীয় সমস্যা হিসেবে বহুল আলোচিত হয়ে আসছে। শিক্ষার হার বৃদ্ধি, শিক্ষার মান ও উচ্চশিক্ষার প্রভাবে দেশের অর্থনৈতিক পটপরিবর্তন হয়েছে অনেকটাই। প্রতি বছরই উচ্চশিক্ষা নিয়ে শ্রমবাজারে আসা শিক্ষার্থীদের প্রায় অর্ধেক বেকার থাকছেন অথবা যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পাচ্ছেন না। সরকারি তথ্যানুযায়ী দেশের শিক্ষিত জনশক্তির পরিমাণ বা শতকরা হার অনেক বেশি। তবে এর বিপরীতে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান না থাকায় কর্মশূন্য বেকার মানবসম্পদের ভারে সমাজ-সংস্কৃতি ও রাজনীতি কলুষিত হচ্ছে প্রায়ই। অর্থনৈতিক চাকার স্বাভাবিক গতিও মন্থর হয়ে পড়ছে। তাছাড়া দেশের তথ্যপ্রযুক্তিহীন অনুন্নত শিক্ষাব্যবস্থা ও কর্মসংস্থান প্রক্রিয়ার অসামঞ্জস্যতা ও অনিশ্চয়তাই বেকার সমস্যার অন্যতম প্রধান কারণ। এ ক্ষেত্রে সুযোগেরও অপর্যাপ্ততা রয়েছে যথেষ্ট। কর্মসংস্থানের সমস্যা ও সুযোগ দুটিকে পাশাপাশি রেখে তুলনা করলে এ সমস্যা সহজেই অনুধাবন করা সহজ হয়। পিএসসি সৃষ্টি করা হয়েছে সরকারি প্রশাসনে লোক নিয়োগের জন্য। কিন্তু এর কার্যপ্রক্রিয়ায় গাফিলতি কিংবা অসামঞ্জস্যতা চাকরিপ্রার্থীদের চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

একজন শিক্ষার্থী স্নাতকোত্তর পাস করার পর তার পরিবার থেকে মাসে মাসে টাকা নিয়ে বছরের পর বছর ধরে বিসিএসের প্রস্তুতি নেওয়া কতটা কষ্টকর তা শুধু নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্তের সন্তানরাই বুঝতে পারে। উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের ক্ষেত্রে বিষয়টি একটু ভিন্ন। একজন চাকরিপ্রত্যাশী প্রার্থীকে বিসিএসের প্রিলিমিনারি, লিখিত এবং মৌখিক পরীক্ষার সব ধাপ অতিক্রম শেষে যথাযথ মেধা থাকা সত্ত্বেও যখন খালি হাতে ফেরত যেতে হয়, তখন তার মতো হতভাগা পৃথিবীতে আর কেউ থাকে না। কাজেই পিএসসির উচিত ৩৮তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষার ফলাফলে যেসব অসামঞ্জস্যতার অভিযোগ এসেছে, সেগুলো আমলে নিয়ে যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা। এমনকি পিএসসির অধীনে যাবতীয় পরীক্ষায় বিদ্যমান অসামঞ্জস্যতাগুলোকে স্থায়ীভাবে সমাধান করার লক্ষ্যে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা।

সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

সৌজন্যে: সমকাল
 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0038049221038818