নৈতিক শিক্ষাটাও কম জরুরি নয়

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

ছাত্রজীবন সুখের জীবন, যদি না হতো পরীক্ষা। কথাটি শোনেনি এমন অভিভাবক ও ছাত্র খুঁজে পাওয়া যাবে না। এ যুগের শিক্ষাব্যবস্থা বেশ আধুনিক, অগ্রসরও বটে। শিক্ষার্থীরাও জ্ঞান ও বিজ্ঞানে বেশ এগিয়ে।

তবে কোনো কোনো শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের কার্যক্রম, শিক্ষকের মান ও শিক্ষার্থীদের আচার-আচরণ অনেক সময় মননশীল মনে হয় না। মঙ্গলবার (১০ ডিসেম্বর) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা। 

নিবন্ধে আরও জানা যায়, পরিচালনা পর্ষদ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি কীভাবে পরিচালিত হবে তার দিকনির্দেশনা দেবে, শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তকের শিক্ষা ও নৈতিক শিক্ষা প্রদান করবেন এবং সর্বোপরি শিক্ষার্থীরা প্রতিষ্ঠানের নিয়ম-কানুনের মধ্যে থেকে শিক্ষকদের মান্য করে যথাযথ শিক্ষা গ্রহণ করবে, এটাই সবার কাম্য।

শিক্ষার এই যে সুশৃঙ্খল প্রবাহ, এর কোনো একটির ব্যত্যয় ঘটলেই দেখা দেয় হাজারও বিপত্তি; আর এ বিপত্তির কারণে কখনও কখনও নিভে যায় অনেক প্রতিভাবান প্রাণ। পরিবারে নেমে আসে দুঃখ আর শোকের ছায়া। এ দুঃখ-কষ্ট বোঝার বা জানার নয়। বিষয়টি একটু ভেবে দেখা দরকার।

একবার একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে একটি বোর্ডের দিকে তাকিয়ে চোখ যেন বোর্ডটিতে আটকে গেল- এ কী বোর্ডের চেহারা, লেখনী আর ছবি! মনে খুব কষ্ট পেলাম, জানার চেষ্টা করলাম। অধ্যক্ষ তার নিজের ঝুলি থেকে হাজার হাজার যুক্তি তুলে ধরলেন। বুঝলাম যুক্তি দিয়ে লাভ নেই।

এ বিদ্যালয় সব মনীষী তৈরির কাজটি নিয়ে নিয়েছে! দেশের বাকি বিদ্যাপীঠগুলো না থাকলেও চলবে এমন একটা ভাব। আসলে বোর্ডটি কী বা কিসের ছিল, তা বিস্তারিত বলার আগে বিদ্যালয়ে আমরা ছোটবেলায় যেসব বোর্ড দেখতাম সেটা একবার চিন্তা করে ভেবে বলা দরকার।

ছোটবেলায় কদমতলা পূর্ব বাসাবো উচ্চবিদ্যালয়ে পড়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। মোটামুটি বলতে পারি ১০০ না হলেও ৯৯ শতাংশ আদর্শবান শিক্ষকের দ্বারাই বিদ্যালয়টি পরিচালিত হতো।

বিদ্যালয়ের বোর্ডের কথায় ফিরে আসা যাক। তখনকার দিনে কৃতী ছাত্রছাত্রীদের বোর্ড, দেওয়াল বোর্ড, ফলাফল প্রকাশের বোর্ড, নোটিশ বোর্ড, প্রধান শিক্ষকের বোর্ড, ব্ল্যাকবোর্ড ইত্যাদি ছিল। এসব বোর্ড শিক্ষার্থীদের জন্য অত্যন্ত সুখকর ছিল।

তাহলে প্রশ্ন করা হতে পারে, এমনকি বোর্ড আমি দেখতে পেলাম যার জন্য আমার পিণ্ডি ঘোলা হয়ে গেল? বোর্ডটি ছিল অকৃতকার্য ছাত্রছাত্রীদের বোর্ড। আগেই বলেছি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল, আইনস্টাইন অথবা স্টিফেন হকিংস বানানোর দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে! শিক্ষা একটি সমন্বিত প্রয়াস।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের সম্মিলিত প্রচেষ্টা। তাই এককভাবে ভালো ছাত্র বানাতে চাইলে তা যেমন হওয়ার নয়, তেমনি এমন অদ্ভুত কাণ্ড করে বসলে তাতে শিক্ষার্থীদের মনে শিক্ষক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতি বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। কোনো কোনো আবেগপ্রবণ শিক্ষার্থীর অকালে প্রাণও ঝরে যেতে পারে, নেমে আসতে পারে পরিবারে শোকের ছায়া।

পাঠক বলতে পারেন, একটি অকৃতকার্যের ছবিসংবলিত বোর্ডের ব্যাপারে আমি আদাজল খেয়ে লিখতে বসে গেলাম কেন? বিষয়টি বোঝার জন্য একটু সময় প্রয়োজন। পুঁথিগত শিক্ষায় শিক্ষিত জাতি কখনই ভালো কিছু দিতে পারেনি, পারবেও না।

যারা পুঁথিগত শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রের সমন্বয় ঘটাতে পারে, নীতি-নৈতিকতা নিয়ে চলে, তারাই মূলত সমাজে প্রতিষ্ঠা পায় এবং জাতিকে কিছু দিতে পারে। শুধুই পুঁথিগত বিদ্যা শিক্ষার্থীদের মনে অহঙ্কারের জন্ম দেয়, খুব বেশি গড়ালে তা হতাশায়ও পরিণত হতে পারে।

তাহলে বোঝা গেল সমাজে পুঁথিগত বিদ্যা নিয়ে বেশি কিছু হওয়া যায় না, আমাদের সব মনীষী পুঁথিগত বিদ্যায় বিদ্বান ছিলেন না। তাই বলে আমি এটি বোঝাতে চাচ্ছি না যে, লিখিত পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেয়ে ভালো ছাত্রছাত্রী হওয়া যাবে না বা ভালো ছাত্রছাত্রী হওয়ার দরকার নেই।

বিষয়টি সে রকমও নয়। তাহলে একটি প্রশ্ন এসে যায়, সব ভালো ছাত্রছাত্রী কি জীবনে সফলতা পেয়েছে? সবার উদ্দেশে আমি যেটি বলতে চাই তা হল, ভালো ছাত্রছাত্রী হতে না পারলেই কেউ ব্যর্থ হয়ে গেলেন সেটি ভাবাও ঠিক নয়।

আসলে ভালো মানুষ না হতে পারলেই জীবন ব্যর্থ হয়। স্কুল থেকে বের করে দেয়া বহু মনীষী মানবসভ্যতার জন্য বহু মূল্যবান অবদান রেখে গেছেন। আজ আমরা তাদের নাম জানি, অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে তাদের স্মরণ করি।

কথা হল, শিক্ষার্থীদের বোর্ডে নাম ও ছবি থাকতে বাধা নেই, যদি সেটা কৃতী ছাত্রছাত্রীদের বোর্ডের হয়। কৃতী ছাত্রছাত্রীদের বোর্ডে নাম ও ছবি দেখে অন্যরা ভালো ছাত্রছাত্রী হতে চাইবে, অনুপ্রেরণা পাবে এটাই তো স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। আমরা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় থাকতে চাই।

অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের বোর্ডটি কি খারাপ ছাত্রদের ভালো ছাত্রে পরিণত করতে পারবে? তাহলে এরকম প্রতিষ্ঠানের কাছে কিছু প্রশ্ন করাই যায়, যা হল- আপনারা কি ১০০ ভাগ নিশ্চিত এ বোর্ড ও তার ছবি ওই শিক্ষার্থীদের ভালো ছাত্র বানাবে? এই বোর্ড কি দুর্বল ছাত্রদের প্রতি ভালো ছাত্রদের ঘৃণার জন্ম দেবে না?

এই বোর্ড কি ছাত্রছাত্রীদের মেলামেশায়, একত্রে হেসে-খেলে বড় হওয়ার অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে না? এই বোর্ড কি দুর্বল ছাত্রদের মন ভেঙে দেবে না? এই বোর্ড কি ছাত্রছাত্রীদের আত্মহত্যার কথাও ভাবতে শেখাবে না? এই বোর্ড কি নির্দোষ পিতামাতার মাথা সমাজে হেয় করবে না?

এই বোর্ড শুধু অমনোযোগী অথবা দুর্বল ছাত্র হওয়ার কারণেই লঘু পাপে গুরুদণ্ড নয় কি? আসলে শিক্ষা হল সেই অমূল্য ধন যা মানুষকে মানুষ হিসেবে ভাবতে শেখায়। জ্ঞান মানুষকে বিনয়ী করে, মানুষকে মহৎ করে, সাধারণ মার্জিত জীবনযাপন করার শিক্ষা দেয়।

আরেকটি প্রশ্ন করা যেতে পারে, যা হল- এসব দুর্বল ছাত্রছাত্রী তো স্কুলে এসেছে, অভিভাবকরা তাদের স্কুলে পাঠিয়েছে, তাহলে যারা স্কুলে আসতে পারল না তাদের ছবি কি ওয়ার্ড কমিশনাররা ওয়ার্ডের বিশাল বিশাল দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখবেন অথবা অফিসে-অফিসে, আদালতে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গিয়ে কি আমরা দুর্বল কর্মকর্তাদের নাম ও ছবি দেখতে পাব?

আসলে প্রতিষ্ঠানের বোর্ডে এ ধরনের নাম ও ছবি থাকা বাঞ্ছনীয় নয়, কাম্যও নয়। এখন যদি কোনো কোনো অভিভাবক প্রশ্ন করে বসেন- দুর্বল শিক্ষকদের বোর্ড চাই, নাম চাই, ছবি চাই, দুর্নীতিবাজ শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছবির বোর্ড চাই, তাহলে ব্যাপারটি কেমন হবে একবার কি আমরা ভেবে দেখেছি?

এ কাল বড়ই নির্দয়-নিষ্ঠুর। বেশ কিছুদিন আগের শিক্ষাব্যবস্থার কথা বলা যাক। আমরা যখন স্কুলে পড়তাম তখন ভালো শিক্ষকরা মেধাবী গরিব ছাত্রদের খুঁজে বের করে বিনা বেতনে পড়াতেন। এ যুগে এমন শিক্ষক কি পাওয়া যাবে? হয়তোবা আছেন তবে এর সংখ্যা নেহায়েতই কম অথবা আমরা তা শুনতে পাই না।

আমি শুধু স্পষ্ট করে বলতে চাই, নীতি-নৈতিকতার বাইরে গিয়ে যদি কোনো কিছুকে শিক্ষা বলে চালিয়ে দেয়া হয়, তবে তা শিক্ষা নয়। এমন শিক্ষা জাতির জন্য মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না।

আমরা সে শিক্ষায় শিক্ষিত জাতি দেখতে চাই, যে শিক্ষার কারণে মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়াবে। কেউ যদি দাঁড়াতে না পারে অন্যজন তাকে দাঁড়াতে সাহায্য করবে, মানুষ সুশিক্ষিত জাতি দেখতে চায়, শিক্ষাকে পুঁজি করে দুষ্ট প্রতিষ্ঠান, লাভবান প্রতিষ্ঠান দেখতে চায় না।

বর্তমান সরকার শিক্ষার উন্নতির জন্য নানাবিধ পদক্ষেপ নিয়েছে। বছরের শুরুতেই সব ছাত্রছাত্রীর হাতে নতুন বই তুলে দেয়ার ঘটনা এ দেশে বিরল ছিল। শিক্ষার বিষয়ে মেয়েদের এবং অনগ্রসর জনপদের বাসিন্দাদের জন্য সরকার বহু সুযোগ-সুবিধাও করে দিয়েছে।

নতুন নতুন পদক্ষেপের মাধ্যমে শিক্ষাকে যুগোপযোগী করছে। শিক্ষাক্ষেত্রে নানা রকম প্রযুক্তির ব্যবহারও নিশ্চিত করেছে যা ছাত্রছাত্রীদের জন্য খুবই কল্যাণকর।

এ সময় শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার দরকার সরকারের সঙ্গে থেকে শিক্ষাকে দুর্নীতিমুক্ত করে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। শিক্ষার সব উপকরণ দ্রুততার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেয়া। সবাই মিলে শিক্ষাকে আরও বেগবান করা।

শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে বলতে চাই- আপনারা সবাই মিলে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মনে শিক্ষার আলো, জ্ঞানের আলো, ভালোবাসার আলোর বীজ বুনে দিন, যাতে করে সব শিক্ষার্থী একে অপরকে ভালোবাসতে শিখে আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বের হয়ে দেশ গড়ায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে।

পরিশেষে একটি বিশেষ ঘটনা বলে শেষ করতে চাই। একবার এক ব্যক্তির ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে এক কর্মচারীর হাতটানের অভ্যাস হয়ে গেলে পরামর্শ নিতে ওই ব্যবসায়ী একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে গেলেন। প্রতিষ্ঠানটি তাকে সিসি ক্যামেরা লাগাতে বলল।

ওই ব্যবসায়ীর রান্নাঘরের খাবার কাজের লোকরা লুকিয়ে খেতে শুরু করল- ব্যবসায়ী আবার বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে গেলেন। ওই প্রতিষ্ঠান রান্নাঘরে সিসি ক্যামেরা লাগাতে বলল। এরপর ছেলেমেয়েরা লেখাপড়ায় ফাঁকি দিতে শুরু করলে ওই বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানটি ঘরের বেডরুমে সিসি ক্যামেরা লাগাতে বলল।

এতে করে সবাই ভয় পেল, সাময়িক চুরি ও খাবার খাওয়া বন্ধ হল এবং ছেলেমেয়েদের মধ্যে লেখাপড়ার ভান জন্ম নিল আর ব্যবসায়ীকে মাসে মাসে ওই প্রতিষ্ঠানকে টাকা দিতে হল। মাসিক খরচ বেড়েই চলল, ভালোবাসা এলো না, নৈতিক শিক্ষা এলো না, বিশ্বাস এলো না, উপদেশ এলো না, শুধুই মেশিন আর মেশিন। যন্ত্র দিয়ে নৈতিক শিক্ষা লাভ করা যায় না।

লেখক: লে. কর্নেল মো. সাইফুল ইসলাম, সেনাসদর, কিউএমজির শাখা, এসটি পরিদফতর


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0029740333557129