বেসরকারি শিক্ষকের কিছু দরকারি কথা

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

সরকারের এখন শেষ বেলা। কারো কথা শোনার সময় নেই। বেসরকারি শিক্ষকের কথা হলে কোনো কথাই নেই। যখন সময় ছিল, তখনো কেউ মন দিয়ে দু'-চারটা কথা শোনেনি। এক সাথে দু' মেয়াদের দশ বছরে বেসরকারি শিক্ষকদের কথা শুনতে এগিয়ে আসেনি কেউ। এ সময়ে কেবল তাদের কষ্ট বেড়েছে। দুঃখ একটুও কমেনি। যে সরকার শিক্ষার উন্নয়নে এতো কিছু করেছে বলে দাবি করে, সে সরকার বেসরকারি শিক্ষকদের বাড়ি ভাড়া পাঁচশ' টাকার জায়গায় এক হাজার টাকা আর চিকিৎসা ভাতা একশ' টাকার জায়গায় পাঁচশ' টাকা করা ছাড়া অন্য কিছু করেনি। তাতে দ্বিগুণ আর পাঁচগুণের কতো বড়াই দেশের মানুষজনকে শুনতে হয়েছে। এক হাজার টাকায় বাসা ভাড়া দূরে থাক, বারান্দা ভাড়া নেয়াও কঠিন। অনুরূপ পাঁচশ' টাকায় একজন ডাক্তারকে একদিন দেখানোই কঠিন হয়। টেস্ট মেস্ট আর ওষুধপত্র দূরে থাক।                                      

ইচ্ছে থাকলে দুই মেয়াদের সরকার বেসরকারি শিক্ষকদের অনেকগুলো কাজ করে দিতে পারত। পদোন্নতি ও বদলির ব্যবস্থা চালু করতে পারত। যৌক্তিক বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা ও উৎসব ভাতা দিয়ে যেতে পারত। বৈশাখী ভাতা ও পাঁচ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট দিতে পারত। অবসর সুবিধা ও কল্যাণ ট্রাস্টের টাকা অবসর গ্রহণের তিন মাসের মধ্যে পাওয়ার একটা সুব্যবস্থা করে দিতে পারত। সরকারি স্কুল-কলেজের ন্যায় ম্যানেজিং কমিটি ও গভর্নিং বডি বাদ দিয়ে প্রতিষ্ঠান প্রধানের নেতৃত্বে একাডেমিক কাউন্সিল গঠন করার সার্কুলার জারি করতে পারত। সর্বোপরি যাবতীয় বৈষম্য ঘুচিয়ে সব স্কুল-কলেজ একদিনে মাত্র এক ঘোষণায় সরকারি করে দিয়ে যেতে পারত। এ সবই তাদের দিয়ে দেয়া উচিত ছিল। করে যাওয়া উচিত ছিল। এ সকল কাজ শিক্ষার মানোন্নয়নে মাইল ফলক হয়ে থাকত। যেমন কওমি মাদরাসা শিক্ষাকে স্বীকৃতি দিয়ে সরকার এক অতি উত্তম কাজ করেছে, তেমনি সব স্কুল-কলেজ এক সাথে সরকারি করে দিয়ে তারা ইতিহাসে অন্য আরেক জায়গা জুড়ে বসতে পারত। তাতে সরকারের ক্ষতি হতো না। বরং লাভ হতো বেশি। কিন্তু এ সব না দিয়ে এবং না করে ভাবসাব এরকম : 'এয়ছে করেঙ্গা, তেয়ছে করেঙ্গা' (এই করেছি, সেই করেছি)। আর এখন অবস্থা দাঁড়িয়েছে : 'মগর কুচ নাহি করেঙ্গা' (কিন্তু, কিছুই করা হয়নি)। এ দীর্ঘ সময়ে কারা যেন সুকৌশলে বেসরকারি শিক্ষকদের কোনো কথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কানে যেতে দেয়নি। কথাগুলো তার কানে গেলে বেসরকারি শিক্ষকদের কষ্টের ঝুড়িটা আজ এতো ভারি হতো না। কিছুটা হলেও লাঘব হতো। এখনও বেসরকারি অনেক শিক্ষক আশা করে বসে আছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের পূর্বে আর কিছু না হোক, তাদের জন্যে অন্তত ইনক্রিমেন্ট আর বৈশাখী ভাতাটা দিয়ে যাবেন।

দৈনিকশিক্ষাডটকমে এক আধটু লেখালেখি করি বলে অনেকে এরকম প্রশ্ন করেন, 'নির্বাচনের পূর্বে ইনক্রিমেন্ট ও বৈশাখী ভাতা পাচ্ছি তো?’ 
এ প্রশ্নে তাদের মধ্যে অন্য রকম এক আত্মবিশ্বাস খুঁজে পাই। কোনো সঠিক উত্তর দিতে পারি না। তবে আমার মনে হয় না তারা নির্বাচনের আগে কিছু পাবেন। সময় কোথায়? নির্বাচনের ধান্ধায় সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন, তাই না?  মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর প্রথম দিকের কথাবার্তায় বেসরকারি শিক্ষকরা বেশ উজ্জীবিত হয়েছিলেন। আশার বাণী শুনে শুনে বুক ভরা ভরসায় এক নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু শেষমেষ স্বপ্নটির অপমৃত্যু হতে যাচ্ছে বলে মনে হয়। স্বপ্নের সম্ভাব্য অপমৃত্যুর কথা চিন্তা করে শিক্ষক সমাজ এখন হতাশ। ছাত্রদের তারা 'আশার গুড়ে বালি' বাগধারাটি জনমভর পড়িয়েছেন। এবার এর মর্মার্থ নিজেরা বাস্তবে উপলব্ধি করতে বসেছেন। 'শিক্ষকদের জন্যে আলাদা বেতন কাঠামো হবে', শিক্ষকদের বেতন লাখ টাকা হবে', দাবি আদায়ে শিক্ষকদের কোনোদিন রাজপথে নামতে হবে না'- ইত্যাদি রকম কথা নিত্যদিন শিক্ষকদের কানে কেবল প্রতিধ্বনি হয়ে বাজে। 

দেশ স্বাধীন হবার পর বেশ ক'টি শিক্ষানীতি প্রণীত হলে ও জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে অতিমাত্রায় উৎসাহিত করে তুলেছিল। অতীতের সব শিক্ষা নীতির বিরোধিতা হলেও এটির তেমন কোনো বিরোধিতা কেউ করেনি। এটি নিয়ে সবার মনে একটা উৎসাহের সঞ্চার হয়েছিল। কিন্তু সে উৎসাহটিতে আজ ভাটার টান পড়েছে। এ কারণে আজ সবচে' বেশি পীড়িত শিক্ষক সমাজ। বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষকগণ। এ শিক্ষা নীতিটি যদি কার্যকর করা যেত, তবে এ দেশের শিক্ষা ও শিক্ষকদের সবচে' বেশি লাভ হতো। শিক্ষা ও শিক্ষকের লাভ মানেই তো দেশ ও জাতির কল্যাণ। এ সহজ সমীকরণটি কেন আমাদের কর্তাব্যক্তিদের বোধগম্য হয় না সেটি আমি বুঝি না। একটা নয়, একশ'টা পদ্মা সেতু নির্মাণের চেয়ে একটা যুগোপযোগী ও বাস্তবমুখী শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করা দেশ ও জাতির জন্যে বেশি অপরিহার্য ছিল। কিন্তু রাষ্ট্র ও সরকার এ বিষয়ে একদম নির্বিকার।                

শিক্ষকতা পেশাকে হাইলাইট করা এখন একান্ত অপরিহার্য কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাষ্ট্র কিংবা সরকার যদি এ কাজটি না করে, তা হলে দেশ ও জাতির সর্বনাশ অনিবার্য। রাষ্ট্র ও সরকারের ভাবসাব দেখে মনে হয় না, এ বিষয়ে তাদের কোনো আগ্রহ কিংবা দায় আছে। এমন হলে সেদিনটি খুব দূরে নেই যেদিন আর কেউ শিক্ষকতায় আসতেই চাইবে না। মেধাবীরা তো এ পেশায় আসা বন্ধ করেই দিয়েছে। এভাবে শিক্ষকতায় কেউ না এলে কিংবা মেধাবীরা একদম না আসতে চাইলে জাতি এমনিতেই একদিন মরে যাবে।
                                     
ইদানিং আমাদের দেশে শিক্ষক নিপীড়নের বিষয়টি বার বার ঘুরে ফিরে আলোচনায় আসে। নানা স্থানে অহেতুক শিক্ষকরা বিশেষ করে বেসরকারি স্কুল কলেজের শিক্ষকরা বিভিন্ন ভাবে নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হন। অনেক জায়গায় কমিটির রোষানলে পড়ে অপদস্থ হন। ম্যানেজিং কমিটি ও গভর্নিং বডিতে আসতে না পারলে অনেকের রাগ ও ক্ষোভ শিক্ষকের ওপরে পড়ে। কত শিক্ষক চাকরি ফিরে পেতে আদালতের শরণাপন্ন হয়ে বছরের পর বছর কোর্ট-কাছারি ঘুরে ঘুরে হয়রান। শিক্ষার্থী কিংবা অভিভাবকের কাছে ও শিক্ষকদের আজকাল এক রকম অসহায় অবস্থা। প্রশাসনের উচ্চপদস্থ অনেকে নিজেদের কেউ কেটা মনে করে। শিক্ষক যেন ছাপোষা কেরানি গোছের লোক। তাদের দাপটের সামনে কোনো কোনো শিক্ষকের মাথা উঁচু করে দু' চার কথা বলা  কঠিন হয়ে পড়ে।

 

ছাত্রদের এক আধটু শাস্তি আজকাল কোনো শিক্ষকই দিতে পারেন না। এর ফলে অধিকাংশ ছাত্র যেমন শিক্ষকের মাথায় উঠে চড়ে বসতে শুরু করেছে, তেমনি অনেক অভিভাবক শিক্ষককে কিছু বলতে এতটুকু দ্বিধা বোধ করেন না। এ কারণে আমার কেনো জানি ইদানিং মনে হয়, বর্তমান সময়টা শিক্ষকদের জন্যে খুব কঠিন এক দুঃসময়। একদিকে যুগোপযোগী কারিকুলাম ও সিলেবাসের অভাব অন্যদিকে পরীক্ষা ও প্রশ্নপদ্ধতির হ-য-ব-র-ল অবস্থা। সব মিলিয়ে শিক্ষক সমাজ আজ বিরাট এক প্রশ্নবোধক চিহ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। এর আশু অবসান একান্ত অপরিহার্য। 'সময়ের এক ফোঁড় আর অসময়ের দশ ফোড়'-এ কথাটি ভুলে গেলে চলবে না। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যে স্বপ্ন নিয়ে সুখি, সুন্দর ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছিলেন, সেটির জন্যে সব বাদ দিয়ে হলেও শিক্ষাকে সর্বাগ্রে ঢেলে সাজাতে হবে। যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে হবে। সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি যদি সৃজনশীল নাগরিক সৃষ্টি করতে না পারে, তবে সেটির পেছনে কোটি কোটি টাকা খরচ করে কী লাভ? অনেকেই বলছেন, সৃজনশীল প্রশ্নের কারণে লেখাপড়া শিকেয় উঠেছে। সে আজ ভেবে দেখা একান্ত প্রয়োজন। শিক্ষকের মর্যাদার আসনটি ফিরিয়ে দিতে হবে। 'শিক্ষা নিয়ে গড়ব দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ'-এটিকে নিছক স্লোগান মনে না করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গঠনের মূলমন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। সামনে এগিয়ে যাবার দিন ক্রমশই নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।                                        


লেখক : অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট। 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0028162002563477