একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তনের দিনক্ষণ ঠিক করা হয় সম্প্রতি। রাষ্ট্রপতির অনুমতিক্রমে শিক্ষামন্ত্রীর ওই সমাবর্তনে সভাপতিত্ব করার কথা ছিল। সব প্রস্তুতিও সম্পন্ন করেছিল বিশ্ববিদ্যালয়টি। কিন্তু সমাবর্তনের আগের দিন শিক্ষামন্ত্রী জানতে পারেন, ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য (ভিসি), উপ-উপাচার্য (প্রোভিসি) ও ট্রেজারার পদে রাষ্ট্রপতির নিয়োগ দেয়া কেউই নেই। সবই চলছে ভারপ্রাপ্ত দিয়ে। তখন শিক্ষামন্ত্রী ওই সমাবর্তনে যেতে অপারগতা প্রকাশ করেন। ফলে বাতিল হয়ে যায় সমাবর্তন। বৃহস্পতিবার (৫ ডিসেম্বর) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন শরীফুল আলম সুমন।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, সরকারি বা বেসরকারি যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সার্টিফিকেটে রাষ্ট্রপতির নিয়োগ দেয়া উপাচার্যই শুধু সই করতে পারেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, দেশে বর্তমানে ১০৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ২৮টিতেই উপাচার্য নেই। এ ছাড়া ৮২টি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রোভিসি এবং ৫৫ বিশ্ববিদ্যালয়ে কোষাধ্যক্ষ নেই। আর ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি, প্রোভিসি ও ট্রেজারার—এই তিন পদের কেউই নেই। তবে মাত্র ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনটি পদই পূর্ণ আছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি নেই, সেখানে নিয়মিতই শিক্ষার্থী ভর্তি করা হচ্ছে। তাঁরা পড়ালেখা শেষ করে সার্টিফিকেট নিয়ে বেরিয়েও যাচ্ছেন। কিন্তু তাঁদের সার্টিফিকেটে সই করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের নিয়োগ দেয়া ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যরা, যার কোনো বৈধতা নেই।
সূত্র মতে, রাষ্ট্রপতির নিয়োগ দেওয়া ভিসির সই ছাড়া কোনো সার্টিফিকেট বৈধ নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের নিয়োগ দেয়া ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যের সার্টিফিকেটে সই করার এখতিয়ার নেই। এর পরও একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যরাই নিয়মিত সাময়িক সনদে সই করে যাচ্ছেন।
জানা যায়, রাজধানীর উত্তরায় অবস্থিত একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরেই ভিসি, প্রোভিসি ও ট্রেজারার নেই। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ১৮ বছরের মধ্যে একবার রাষ্ট্রপতির নিয়োগ দেয়া ভিসি চার বছরের জন্য দায়িত্ব পালন করেছেন। এরপর ১৪ বছর ধরেই চলছে ভারপ্রাপ্ত ভিসি দিয়ে। এমনকি যিনি ভারপ্রাপ্ত ভিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, তাঁর ওই পদে থাকার যোগ্যতাই নেই। ওই ভারপ্রাপ্ত ভিসিই মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক। তাঁর ছেলে বর্তমানে বোর্ড অব ট্রাস্টিজের (বিওটি) চেয়ারম্যান। আর নিয়ম ভেঙে ওই চেয়ারম্যানও একটি বিভাগের ডিনের দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়া একান্ত অনুগত শিক্ষকদেরই গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে ভারপাপ্ত হিসেবে রাখা হয়েছে। এভাবেই চলছে বিশ্ববিদ্যালয়টি।
ইউজিসি সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি, প্রোভিসি ও ট্রেজারার আছেন। সেগুলো হলো ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি, আন্তর্জাতিক ইসলামী ইউনিভার্সিটি চট্টগ্রাম, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, সিটি ইউনিভার্সিটি, সোনারগাঁও ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়া, অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও বরেন্দ্র ইউনিভার্সিটি।
গত ১৫ সেপ্টেম্বর সর্বশেষ ভিসি, প্রোভিসি ও ট্রেজারারের তালিকা তৈরি করে ইউজিসি। সেখানে যে ২০ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি, প্রোভিসি ও ট্রেজারার কেউই নেই, সেগুলোর মধ্যে আহছানউল্লা ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, ইবাইস ইউনিভার্সিটি, প্রাইম ইউনিভার্সিটি, রয়েল ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা, জেড এইচ সিকদার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, এক্সিম ব্যাংক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, খাজা ইউনুস আলী বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্রিটানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় অন্যতম। তবে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই তাদের ট্রাস্টি বোর্ডের অনুগত একজন উপাচার্য রাখলেও প্রোভিসি ও ট্রেজারার পদ পূরণ করায় তাদের আগ্রহ নেই তেমন। সে জন্য ১০৫ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৮২টিতে প্রোভিসি ও ৫৫টিতে ট্রেজারার নেই।
জানা যায়, ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে বলা আছে, ট্রাস্টি বোর্ডের কোনো সদস্যের লাভজনক পদে থাকার সুযোগ নেই। কিন্তু বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই বিওটি চেয়ারম্যান ও সদস্যরা ভিসি, ট্রেজারারসহ গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে রেখেছেন। আর ওই সব পদে দায়িত্ব পালনের জন্য নিচ্ছেন মোটা অঙ্কের অর্থসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা।
এসব বিষয়ে ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী শহীদুল্লাহ বলেন, ‘যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি, প্রোভিসি ও ট্রেজারার নেই, তাদের আমরা বারবার বলছি, চাপ দিচ্ছি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বলছে, তারা উপযুক্ত অধ্যাপক পাচ্ছে না। কিন্তু আমার কাছে চাইলে আমি দিতে পারব। যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় রয়েছে, তাদের কথা ভিন্ন। তবে যেখানে তিন বা দুই পদেই কেউ নেই তারা মূলত বিশ্ববিদ্যালয় নিজেদের কবজায় রাখতে ইচ্ছা করেই বিলম্বিত করে।’
স্থায়ী ক্যাম্পাস নিয়ে টালবাহানা : জানা যায়, অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ই নিয়মকানুনের ধার ধারছে না। কয়েক দফা সময় বাড়িয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ সময়সীমা অনুযায়ী, ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরের মধ্যে ৫২টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ২৭ বছরে মাত্র ২০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থায়ী ক্যাম্পাসে যেতে পেরেছে। বাকিরা টালবাহানা করেই সময় পার করছে।
জানা যায়, একদিকে আইনি বাধ্যবাধকতা অন্যদিকে ইউজিসির চাপে ৩২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে প্রায় অর্ধেক ঢাকা থেকে বেশ দূরে গড়ে তুলেছে দৃষ্টিনন্দন স্থায়ী ক্যাম্পাস। তবে ওই সব ক্যাম্পাসে তেমন কোনো শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে না। সেগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী, সমাবর্তনসহ বড় অনুষ্ঠানের স্পট হিসেবে। এমনকি ওই সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটেও গুরুত্ব পাচ্ছে না স্থায়ী ক্যাম্পাসের ঠিকানা।
স্থায়ী ক্যাম্পাসে না যাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ৯টি তাদের স্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য জায়গা কিনেছে, কেউ কেউ কাজও শুরু করেছে। দুটি বিশ্ববিদ্যালয় ফাউন্ডেশনের জমিতে নির্মিত স্থায়ী ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে, তবে আইন অনুযায়ী সেটিও বৈধ নয়। আর তিনটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নির্ধারিত জমির চেয়ে কম জমিতে স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণ করেছে। তাদের বারবার তাগাদা দিলেও শর্ত পূরণ করার ক্ষেত্রে খুব একটা অগ্রগতি নেই। বাকি ১৮টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থায়ী ক্যাম্পাসে না গেলেও রাজধানী থেকে বেশ দূরে ছোট বা বড় স্থাপনাসহ ক্যাম্পাস নির্মাণ করেছে।