আইবেরীয় উপদ্বীপের পশ্চিমে এবং স্পেনের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত পর্তুগাল ইউরোপের অন্যতম প্রাচীন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। প্রথমে রোমান অতঃপর মুসলিম শাসনের অবসানের পর পর্তুগাল স্পেনীয়দের দখলে যায়। দ্বাদশ শতকের মধ্যভাগে বিভিন্ন রাজ্য একত্রিত করে পর্তুগাল রাষ্ট্র গঠিত হয়। পঞ্চদশ শতকে পর্তুগাল ইউরোপের প্রধানতম সমুদ্র অভিযান কেন্দ্রে পরিণত হয়। ১৯১০ সাল পর্যন্ত রাজতন্ত্র কার্যকর থাকা দেশটিতে বিংশ শতাব্দিতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। ১৯৮৬ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেওয়া পর্তুগাল অতীতে সমুদ্র অভিযান, দস্যুবৃত্তি, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতি কারণে আলোচিত-সমালোচিত হলেও বর্তমানে দেশটি শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নতি করে বিশ্বের মাঝে বিশেষ স্থান করে নিয়েছে।
বিশ্বের ৪২তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ পর্তুগালের জিডিপি গ্রোথ ২.২ শতাংশ। ইউরোপের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পর্তুগাল আশির দশকে তার শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যাপক সংস্কার করে। দক্ষ জনগোষ্ঠী সৃষ্টি, প্রযুক্তিগত আধুনিকীকরণ ও ভবিষ্যতের মুখোমুখী হওয়ার চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ অত্যন্ত বাস্তবমুখী একটি শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণীত হয়েছে পর্তুগালে।
পর্তুগালের গড় স্বাক্ষরতার হার ৯৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ। বর্তমানে শতভাগ পর্তুগিজ শিশু স্কুলে যেয়ে থাকে। এখানে বাধ্যতামূলক শিক্ষা গ্রহণের সময়সীমা ১২ বছর। আইনত প্রত্যেক শিশুকে ৬ বছর থেকে ১৮ বছর বয়সের মধ্যে এখানে প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বাধ্যতামূলকভাবে শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়। এখানকার শিক্ষা ব্যবস্থা মূলত চার ভাগে বিভক্ত। প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক শিক্ষা, মাধ্যমিক শিক্ষা ও উচ্চ শিক্ষা।
পর্তুগালের শিক্ষা মন্ত্রণালয় দেশটির মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা পরিকল্পনা, ব্যবস্থাপনা এবং সমন্বয়ের কাজ করে। ১৯১৩ সালে গঠিত এই মন্ত্রণালয় পর্তুগালের অন্যতম প্রাচীন মন্ত্রণালয়। দেশটি প্রাক-প্রাথমিক থেকে শুরু করে মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষা নিয়ে সরাসরি কাজ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মাধ্যমিক পরবর্তী কর্মমুখী শিক্ষা তদারকির জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শ্রম, কর্মসংস্থান ও সামাজিক নিরাপত্তা মন্ত্রণালয় সম্মিলিতভাবে কাজ করে। অন্যদিকে পর্তুগালের উচ্চ শিক্ষা দেখভালের জন্য রয়েছে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও উচ্চ শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
পর্তুগালের শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষার্থীকে পয়সা গুণতে হয় না। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় ভেদে স্বল্প টিউশন ফি আরোপিত হয়। এখানে সরকারি ভাবে শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে বই প্রদান করা হয় না। বরং স্কুল নির্ধারিত দোকান থেকে শিক্ষার্থীরা বই কিনে থাকে। পর্তুগালের শিক্ষার্থীদের স্কুলে বইয়ের বোঝা বহন করে নিতে হয় না বরং স্কুলে নির্দিষ্ট বই পড়ানো হয় এবং বাসায় এসাইনমেন্টের জন্য আলাদা বই থাকে।
এখানে শিশুদের জন্মের পর থেকে ৫ বছর বয়স পর্যন্ত প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। শূন্য থেকে দুই বছর বয়স অবধি শিশুদের জন্য নার্সারি স্কুল রয়েছে যাকে পর্তুগিজ ভাষায় ‘ইনফ্যান্টারিও’ বলা হয়ে থাকে। অন্যদিকে ৩ থেকে ৫ বছর বয়সী শিশুদের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাকে ‘জারদিম দে ইনফ্যান্সিয়া’ বলে যা মূলত কিন্ডার গার্টেন শিক্ষা ব্যবস্থা। ডে-কেয়ার সার্ভিসের অন্তর্গত এই পর্যায়ে শিশুদের সামাজিকীকরণ, আচার-আচরণ, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার শিক্ষা প্রদানের পাশাপাশি ভাষা ও গণিতের প্রাক-প্রাথমিক পাঠ দেওয়া হয়। পিতামাতার আয় অনুসারে শিশুর স্কুলের বেতন নির্ধারিত হয়।
শিশুদের বয়স ৬ বছর হওয়ার পর থেকে প্রত্যেক পর্তুগিজ বাবা-মা তাদের সন্তানকে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের জন্য স্কুলে পাঠান। পর্তুগালে শিক্ষা বর্ষ শুরু হয় ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে। আইন অনুযায়ী এই তারিখের মধ্যে ৬ বছর বয়সী প্রত্যেক শিশুর বাবা/মায়ের বাসস্থান বা কর্মস্থানের নিকটবর্তী স্কুলে শিশুকে ভর্তি করতে হয় এবং ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সেই সংক্রান্ত তথ্যাবলী মিউনিসিপ্যালিটি কর্তৃপক্ষকে প্রদান করতে হয়। পর্তুগালের প্রাথমিক শিক্ষা ৯ বছর মেয়াদী, ১ম থেকে ৯ম শ্রেণি পর্যন্ত। এই প্রাথমিক শিক্ষা আবার তিন পর্যায়ে বিভক্ত। ১ম থেকে ৪র্থ শ্রেণি পর্যন্ত প্রথম সার্কেল, ৫ম থেকে ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত দ্বিতীয় সার্কেল এবং ৭ম থেকে ৯ম শ্রেণি পর্যন্ত সময়কে বলে তৃতীয় সার্কেল। প্রত্যেক সার্কেলের শেষে শিশুদের ভাষা ও গণিতে দক্ষতা যাচাই করা হয়। পর্তুগালের অধিকাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারি খরচে পরিচালিত হয়। তবে এখানে বেশ কিছু বেসরকারি স্কুলও রয়েছে যেগুলো আংশিক সরকারি খরচে কিংবা পুরোপুরি বেসরকারি খরচে পরিচালিত হয়ে থাকে। উল্লেখ্য, পর্তুগালের রাষ্ট্রীয় শিক্ষা কারিকুলামের বাইরেও রাজধানী লিসবন বা পোর্তোর মত শহরগুলোতে ব্রিটিশ কারিকুলামে পরিচালিত স্কুল চালু আছে। এছাড়া দেশটির মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষায়িত মাদ্রাসা রয়েছে। তবে মোট জনসংখ্যার মাত্র ০.২ ভাগ মুসলমানের জন্য স্থাপিত মাদ্রাসার সংখ্যা অতি নগণ্য।
স্কুলগুলোতে ১ম থেকে ৪র্থ শ্রেণি পর্যন্ত পর্তুগিজ ভাষা, সমাজ ও গণিত শেখানো হয়। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের আত্মবিকাশের জন্য বিদেশী ভাষা হিসেবে ইংরেজি শেখানো হয়। এছাড়া এই পর্যায়ে চিত্রকলা, শারীরিক শিক্ষা, সঙ্গীত, ধর্ম ও নৈতিকতা সম্পর্কেও শিশুদের ধারণা দেওয়া হয়। ৫ম থেকে ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত শিশুদের এসব বিষয়ের পাশাপাশি পর্তুগালের ইতিহাস ও ভূগোল সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়। একই সাথে তাদের সাধারণ বিজ্ঞান, ভিজ্যুয়াল আর্টস, ক্রাফটস ইত্যাদির সাথে পরিচয় করানো হয়। ৭ম থেকে ৯ম শ্রেণি অর্থাৎ প্রাথমিক শিক্ষার তৃতীয় সার্কেলে শিশুদের পর্তুগিজ ভাষা, সমাজ, গণিত শিক্ষার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষার উপরে উচ্চতর দক্ষতা অর্জন করতে হয়। এ পর্যায়ে ইংরেজির পাশাপাশি শিশুদের ফ্রেন্স, স্প্যানিশ বা জার্মান ভাষার মধ্য থেকে যে কোন একটি ভাষা শিখতে হয়। একই সাথে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, পদার্থদ্যিা, রসায়ন, ইতিহাস, ভূগোল, নাগরিকবিদ্যা ও উন্নয়ন এবং
আইটি’র উপর দক্ষতা অর্জন করতে হয়।
পর্তুগালের শিক্ষার্থীদের মাধ্যমিক শিক্ষা শুরু হয় নয় বছরের প্রাথমিক শিক্ষা শেষে। এই পর্যায়ে তাদের উচ্চতর শিক্ষা এবং কর্মমুখী শিক্ষার মধ্য থেকে একটি বেছে নিতে হয়। এ ছাড়া কলাবিদ্যা (আর্টিস্টিক প্রোগ্রাম) নামে আরেকটি শিক্ষার বিশেষায়িত শাখা রয়েছে যেখানে মননশীল শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করে থাকে।
প্রাথমিক শিক্ষা জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে শিশুদের এই পর্যায়ে যে কোন একটি শাখায় দক্ষতা অর্জনের জন্য নির্ধারণ করা হয়। যে সকল শিক্ষার্থী উচ্চতর শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হয় তাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, সামাজিক ও মানবিক বিদ্যা, সামাজিক ও অর্থশাস্ত্র অথবা ভিজ্যুয়াল আর্টসের মধ্যে যে কোন একটি শাখায় পড়াশোনা করতে হয়।
কর্মমুখী শিক্ষায় যারা অংশগ্রহণ করে তাদের ৩ বছর মেয়াদী ডিপ্লোমা করতে হয়। এখানে খেলাধুলা (স্পোর্টস), স্থাপত্য (আর্কিটেক্ট টেকনিশিয়ান), পূর্তকর্ম (সিভিল কন্সট্রাকশন), ইলেক্ট্রনিক্স, কম্পিউটিং, ইক্যুইপমেন্ট ডিজাইন, জনপ্রশাসন, পরিবেশ ও প্রতিবেশ এবং সামাজিক কর্ম ইত্যাদির উপর দক্ষতা অর্জন করতে হয়। কর্মমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত শিক্ষার্থীরা ডিপ্লোমা শেষে সরাসরি কর্মী হিসেবে কাজে যোগদান করে।
অন্যদিকে যারা উচ্চতর শিক্ষার দিকে মনোনিবেশ করে তারা একাদশ শ্রেণি শেষে একটি জাতীয় পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে যেখানে তাদের অনুষদ অনুযায়ী দুটি বিশেষ বিষয়ের উপর পরীক্ষা দিতে হয়। এরপর দ্বাদশ শ্রেণি শেষে শিক্ষার্থীরা পর্তুগিজ ভাষা ও তাদের অনুষদ অনুযায়ী মূল বিষয়ের উপর আরেকটি কেন্দ্রীয়ভাবে গৃহীত জাতীয় পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অধ্যয়নের জন্য পর্তুগিজ শিক্ষার্থীরা অনলাইন নির্ভর একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায় এবং শিক্ষা জীবনের গ্রেডিং অনুযায়ী পছন্দের বিষয়ে ভর্তির সুযোগ পায়। এখানে শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার সমস্ত পরীক্ষা ও মূল্যায়নের ফলাফল সংরক্ষণ করা হয় এবং তা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির
সময় শিক্ষার্থীর মান যাচাইয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিবেচনা করে থাকে।
পর্তুগালে উচ্চ শিক্ষার জন্য বেশ কিছু নাম করা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট রয়েছে। ১২৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত ইউনিভার্সিটি অব কোয়িম্ব্রা পর্তুগালের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়া পর্তুগালের ইউনিভার্সিটি অব লিসবন এবং ইউনিভার্সিটি অব পোর্তো অন্যতম নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়। এ সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞান, বাণিজ্য, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের উপর উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ ও গবেষণার সুযোগ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান ভিত্তিক তথ্যানুসন্ধান ও তা একত্রিত করে জ্ঞান আহরণ ও গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়।
অন্যদিকে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলোতে মূলত উচ্চতর ভোকেশনাল ও টেকনিক্যাল শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ রয়েছে। এই দু’ধরনের ব্যবস্থার বাইরেও পর্তুগালের কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বতন্ত্র পলিটেকনিক ইউনিট রয়েছে।
পর্তুগাল তার শিক্ষকদের উচ্চ হারে সম্মানী প্রদান করে থাকে। এখানে জাতীয় সর্বনিম্ন বেতন ৬৩৫ ইউরো হলেও শিক্ষকদের ক্ষেত্রে তা ৯৩০ ইউরো। তবে পর্তুগালের স্কুল পর্যায়ের শিক্ষকরা গড়ে ১৯০০ ইউরোর মত মাসিক সম্মানী পেয়ে থাকেন। ফলে মেধামী ও আগ্রহীগণ পর্তুগালে শিক্ষক পেশায় যুক্ত হন।
বাংলাদেশও শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের জন্য বেশ কিছু পর্তুগিজ মডেল অনুসরণ করতে পারে। উভয় দেশের পারস্পারিক সাহায্য-সহযোগিতার মাধ্যমে আমরা উপকৃত হতে পারি।
কায়সুল খান, পর্তুগাল প্রবাসী