বাসের রেষারেষিতে দুই কলেজশিক্ষার্থী দিয়া খানম মীম ও আবদুল করিম রাজীবের প্রাণক্ষয়ের বিনিময়েও ঢাকার রাস্তায় শৃঙ্খলা আসেনি। উল্টো তাদের মৃত্যুর জেরে সংগঠিত আন্দোলনের চাপে পাওয়া নতুন সড়ক পরিবহন আইনের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ধারার প্রয়োগ আগামী জুন পর্যন্ত স্থগিত রাখা হয়েছে। পরিবহন নেতাদের উসকে দেওয়া সর্বশেষ পরিবহন ধর্মঘটের জেরে সড়কে আইনের শাসনও প্রতিষ্ঠা করা বিলম্বিত হচ্ছে। রোববার (১ ডিসেম্বর) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন পার্থ সারথি দাস ।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, গত বছরের ২৯ জুলাই শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের ওই দুই শিক্ষার্থীর প্রাণ কেড়ে নেওয়া হয় বিমানবন্দর সড়কের পাশে জিল্লুর রহমান উড়াল সেতুর ঢালে। সেই হত্যাকাণ্ডের জেরে খুদে শিক্ষার্থীরাই শৃঙ্খলা আনতে সড়কে নেমেছিল। টানা আট দিন তাদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের অভিযানে মন্ত্রী-সংসদ সদস্য-পুলিশরাও ধরা পড়েন। ওই আন্দোলনে সরকারের কাছে শিক্ষার্থীদের সাতটি দাবির পাঁচটিই অপূর্ণ রয়ে গেছে। এ অবস্থায় আজ রবিবার দুই শিক্ষার্থীকে হত্যার রায় শুনতে উন্মুখ হয়ে আছে দেশবাসী। প্রায় ১৬ মাসের ব্যবধানে এ রায় হতে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট খাতের বিশেষজ্ঞ ও আইনজ্ঞরা বলেছেন, এ মামলার বিচারপ্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতার ছোঁয়া লাগেনি।
ওই হত্যাকাণ্ডের জেরে গত বছরের অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ১৭টি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে শুধু মোটরসাইকেলে হেলমেট পরিধানের বিষয়টি নিশ্চিত করার অগ্রগতি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। নিরাপদ সড়কের জন্য ১১১টি সুপারিশ প্রণয়ন করা হয়েছে, তার াস্তবায়ন শুধু সভার সিদ্ধান্তেই ঘুরছে।
মীম ও রাজীব হত্যাকাণ্ডের পর ৯টি দাবি বাস্তবায়নের আশ্বাস দেয় সরকার। তারপর শিক্ষার্থীরা ঘরে ফেরে। ওই আন্দোলনের জেরে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ জাতীয় সংসদে অনুমোদন হয় গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর। অনুমোদনের ১৪ মাস পর গত ১ নভেম্বর থেকে এটি কার্যকরের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয় গত ২২ অক্টোবর। তবে এক সপ্তাহ করে দুই দফায় দুই সপ্তাহ তার প্রয়োগ পেছানো হয়। এরপর প্রয়োগ শুরু হলে পরিবহন ধর্মঘট শুরু হয়। একপর্যায়ে গত ২০ নভেম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে পরিবহন নেতাদের বৈঠকে ৩০ জুন পর্যন্ত কয়েকটি ধারার প্রয়োগ স্থগিত করা হয়। শিক্ষার্থীদের দাবি অনুসারে বিতর্কিত আচরণের জন্য সাবেক নৌমন্ত্রী শাজাহান খান ক্ষমা চান।
শিক্ষার্থীদের প্রধান দাবি ছিল, বেপরোয়া চালককে ফাঁসি দিতে হবে এবং এই শাস্তি সংবিধানে সংযোজন করতে হবে। এরপর সড়কে ইচ্ছাকৃত হত্যাকাণ্ড ঘটালে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড এবং বেপরোয়া গাড়ি চালনায় সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড রেখে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ অনুমোদন করা হয়। তবে আইনে এ অপরাধে জরিমানা পাঁচ লাখ টাকা কমানো এবং এসংক্রান্ত মামলা জামিনযোগ্য করার জন্য পরিবহন নেতারা পাল্টা দাবি করেছেন সরকারের কাছে।
দুই শিক্ষার্থীকে চাপা দেওয়া বাসের চালক, সহকারী, মালিকসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। জাবালে নূর পরিবহনের রুট পারমিট বাতিল করেছিল বিআরটিএ। তবে জাবালে নূর আবার ঢাকার সড়কে ভিন্ন ভিন্ন কম্পানির নামে চলাচল করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
আন্ডারপাসের কাজ এগোচ্ছে : শিক্ষার্থীদের চলাচলে দুর্ঘটনাস্থলের কাছে ফুট ওভারব্রিজ বা বিকল্প নিরাপদ ব্যবস্থা স্থাপনের দাবি করা হয়েছিল। তার পরিপ্রেক্ষিতে বিমানবন্দর সড়কে বীরসপ্তক ক্রসিং পয়েন্টের কাছে পথচারী আন্ডারপাস নির্মাণ করা হচ্ছে। গত বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর জরুরি ভিত্তিতে এটির কাজ শুরু করা হয়। প্রকল্পের অর্ধেকের বেশি কাজ এগিয়েছে বলে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। আগামী বছরের শুরুতে এটি ব্যবহার করা যাবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন। প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনায় সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে সেনাবাহিনীর সহযোগিতায়।
গতিরোধক স্থাপনের দাবি হেলায় : প্রতিটি সড়কের দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থানে গতিরোধক স্থাপনের দাবি বাস্তবায়ন করা হয়নি পুরোপুরি। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে স্থানীয় সরকার, রাজউক, সওজ, রেলওয়েসহ বিভিন্ন সংস্থা জড়িত। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রচলিত গতিরোধক বাড়ালে সড়কে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়তে পারে। এ ক্ষেত্রে হাতিরঝিল প্রকল্প এলাকার সড়কের মতো র্যাম্বল স্ট্রিপ স্থাপন করা যায়। জানা গেছে, এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় নেই।
গতিরোধক স্থাপনের দাবির সম্পূরক হিসেবে সব স্কুলের সামনে গতিরোধক নির্মাণের পাশাপাশি বিশেষ প্ল্যাকার্ডযুক্ত বিশেষ ট্রাফিক পুলিশ নিয়োগের আশ্বাস দিয়েছিল সরকার। এ বিষয়ে অগ্রগতি খুবই কম। জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মফিজউদ্দিন আহম্মদ কালের কণ্ঠকে বলেন, স্কুল কর্তৃপক্ষ ও ট্রাফিক পুলিশের যৌথ চেষ্টায় এই কাজ শুরু হয়েছে। আগামী জানুয়ারি থেকে পুরো প্রক্রিয়ায় আরো গতি আসবে। কারণ এখন বিভিন্ন স্কুলে পরীক্ষার মৌসুম চলছে। সওজ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা জানান, মহাসড়কে দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থানে অবকাঠামোগত উন্নয়ন করার কাজ চলছে। ঢাকা-আরিচা, ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-টাঙ্গাইল ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক উন্নয়ন করা হয়েছে। নতুন মহাসড়কে ধীরগতির যান চলাচলের ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে।
শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ছাত্রছাত্রীদের দায়ভার সরকারকে নিতে হবে—ওই দুই শিক্ষার্থীর প্রাণহানির পর প্রধানমন্ত্রী তাদের পরিবারকে ২০ লাখ টাকা করে পারিবারিক সঞ্চয়পত্র দিয়েছিলেন। তিনি সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন। দুর্ঘটনায় আহত শিক্ষার্থীদের শুরু থেকেই ব্যয়ভারও বহন করছে সরকার। এ ছাড়া নতুন সড়ক পরিবহন আইনে জরিমানার মাধ্যমে আদায় করা অর্থের অংশ ও পরিবহন মালিকদের কাছ থেকে পাওয়া চাঁদা তহবিল গঠন করে তা সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় ব্যবহার করার বিধান রাখা হয়েছে।
শিক্ষার্থীরা বাস থামানোর সিগন্যাল দিলে বাস থামিয়ে তাদের বাসে তুলতে হবে—এ দাবি পূরণ হয়নি। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পর ঢাকায় ১২১টি স্থানে বাস স্টপেজ চিহ্নিত করা হয়েছিল। এসব স্থানের বেশির ভাগে বাস থামে না। কারণ এ ক্ষেত্রে ট্রাফিক পুলিশ ও পরিবহন সংশ্লিষ্টদের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। সারা দেশে শিক্ষার্থীদের জন্য বাসে হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা করার দাবিও পূরণ হয়নি। রাজধানীর বেশ কয়েকটি রুটে এ বিধান মানা হলেও প্রায় ২০০ রুটেই শিক্ষার্থীদের হয়রানি করা হয়। পরিচয়পত্র দেখালেও হাফ ভাড়া নেওয়া হয় না। ওই দুর্ঘটনার পর শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজকে পাঁচটি বাস দেওয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে।
ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় চলাচল বন্ধ ও লাইসেন্স ছাড়া চালকরা গাড়ি চালাতে পারবে না—এই দাবিও ছিল শিক্ষার্থীদের। এ দাবি পূরণ করা হয়নি। বরং যথাযথ লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালানো আগামী জুন পর্যন্ত মেনে নেওয়া হবে। বিআরটিএ লাইসেন্স দিতে পারছে না প্রায় তিন লাখ আবেদনকারীকে। ফিটনেসহীন সনদ না নিয়ে চলাচল করছে প্রায় সাড়ে তিন লাখ গাড়ি। বাসে অতিরিক্ত যাত্রী নেওয়া যাবে না—শিক্ষার্থীদের এই দাবিও পূরণ হয়নি। তবে বিআরটিএর চেয়ারম্যান ড. কামরুল আহসান বলেন, ‘আমরা ব্যবস্থাপনা আরো জোরদার করছি। ১১১ সুপারিশও বাস্তবায়ন করা হবে।’
মামলার রায় আজ : রাজধানীর শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থীকে বাসচাপা দিয়ে হত্যা এবং আরো কয়েকজনকে আহত করার ঘটনায় জাবালে নূর পরিবহনের দুই বাসের মালিক, চালক ও হেলপারদের (সহকারী) বিরুদ্ধে করা মামলার রায় ঘোষণা করা হবে আজ রবিবার। ঢাকা মহানগর দায়রা জজ কে এম ইমরুল কায়েশ এই রায় ঘোষণা করবেন।
গত ১৪ নভেম্বর উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে রায়ের তারিখ ধার্য করা হয়েছিল। এর আগে ২ অক্টোবর সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। ৭ অক্টোবর আসামিরা আত্মপক্ষ সমর্থন করে নিজেদের নির্দোষ দাবি করেছিলেন। এরপর ৪ নভেম্বর যুক্তিতর্ক শুনানি শুরু হয়।
গত বছর ২৫ অক্টোবর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছিলেন আদালত। এর আগে ৬ সেপ্টেম্বর জাবালে নূরের দুই বাসের মালিক শাহাদৎ হোসেন আকন্দ ও জাহাঙ্গীর আলম, দুই বাসচালক মাসুম বিল্লাহ ও জুবায়ের সুমন এবং দুই হেলপার এনায়েত হোসেন ও কাজী আসাদকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দেওয়া হয়েছিল। ওই ঘটনায় গ্রেপ্তার অন্য একটি বাসের চালক মো. সোহাগ আলী ও হেলপার মো. রিপন হোসেনকে অব্যাহতি দেওয়া হয় মামলা থেকে।
গত বছর ২৯ জুলাই দুপুরে শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজ ছুটি হওয়ার পর শিক্ষার্থীরা বিমানবন্দর সড়কে হোটেল র্যাডিসনের অন্য পাশে জিল্লুর রহমান ফ্লাইওভারের নিচে রাস্তায় অপেক্ষা করছিল বাসের উঠার জন্য। ওই সময় জাবালে নূর পরিবহনের তিনটি বাসের রেষারেষিতে শিক্ষার্থীদের গায়ের ওপর বাস উঠে পড়েছিল। ওই ঘটনায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের এইচএসসি প্রথম বর্ষের ছাত্রী দিয়া খানম মীম এবং দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবদুল করিম রাজীব নিহত হয়। গুরুতর আহত হয় প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী সোহেল রানা, রুবাইয়া এবং দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ইমরান চৌধুরী, মেহেদী হাসান জিসান, রাহাত, সজীব, জয়ন্তী ও তৃপ্তা। আহত আরো কয়েকজনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল।
দুই শিক্ষার্থীকে হত্যা ও কয়েকজনকে আহত করার পর সেদিনই নিহত মীমের বাবা মো. জাহাঙ্গীর বাদী হয়ে মামলা করেছিলেন ক্যান্টনমেন্ট থানায়।
‘ন্যায়বিচার পাইলে মাইয়াডার আত্মা শান্তি পাইব’ : বাসচাপায় রমিজ উদ্দিন কলেজের শিক্ষার্থী দিয়া খানম মিম ও আব্দুল করিম রাজীব নিহত হওয়ার ঘটনায় আদালতের রায়ের অপেক্ষায় তাদের স্বজনরা। বুকে শোক চেপে রাখা স্বজনরা ন্যায়বিচার পাওয়ার আশা করছে। দিয়ার বাবা জাহাঙ্গীর ফকির গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা চাই একটা ভালো বিচার হোক। ন্যায়বিচার পাইলে আমার মাইয়াডার আত্মা শানি পাইব। দেশের মানুষও এ ঘটনায় কাঁদছে। তাদের মন চায় সঠিক বিচার।’ তিনি বলেন, ‘আমি নিজেও একজন ড্রাইভার ছিলাম। পরে ছাইড়া দিছি। যেসব ড্রাইভার বাচ্চা দুইডারে মারল ওরা তো ড্রাইভার থাকল না। ওদের কি সঠিক প্রশিক্ষণজ্ঞান ছিল? থাকলে কি এইভাবে ফ্লাইওভার থেইকা পাল্লা দিয়া ধাক্কা মারে। কিছু টাকার জন্য...।’