নানা সংকট আর অনিয়ম-অবহেলায় স্বকীয়তা হারাচ্ছে শতবর্ষী রংপুর কারমাইকেল কলেজ। নেপথ্যের নানা কারণের অন্যতম একটি হলো দায়িত্বে শিক্ষকদের আন্তরিকতা না থাকা। অভিযোগ রয়েছে, শিক্ষার্থীদের ক্লাসমুখী করার উদ্যোগ নেই শিক্ষকদের। অনেক শিক্ষকই খেয়াল-খুশি অনুযায়ী কলেজে আসেন। তাঁরা ক্যাম্পাসে না থেকে বগুড়াসহ প্রায় শত কিলোমিটার দূর থেকে এসে ক্লাস নেন। অভিযোগ রয়েছে অতিরিক্ত ফি আদায়সহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতিরও। শুক্রবার (২৭ ডিসেম্বর) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন স্বপন চৌধুরী।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দের ১০ নভেম্বর তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার গভর্নর লর্ড থমাস ডেভিড ব্যারন কারমাইকেল এই ঐতিহাসিক কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তাঁর নামানুসারেই এর নামকরণ করা হয় কারমাইকেল কলেজ। দীর্ঘ আট বছর ধরে চারটি ছাত্রাবাস বন্ধ রাখাসহ নানা অনিয়মের কারণে আজ ঐতিহ্য হারাতে বসেছে উত্তরের অক্সফোর্ডখ্যাত প্রাচীনতম এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
দেশের উত্তরাঞ্চলের বৃহৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কারমাইকেল কলেজে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৩৫ হাজার। কিন্তু সে তুলনায় ছাত্রাবাস সংকট প্রকট। সংকট রয়েছে শিক্ষকেরও। ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের ১০ নভেম্বর শতবর্ষ পূর্ণ হলেও নানা জটিলতায় শতবর্ষ পূর্তির উৎসব আটকে আছে তিন বছর ধরে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য চলতি মাসের শেষের দিকে এই উৎসব পালনের উদ্যোগ নিয়েছে কলেজ কর্তৃপক্ষ।
কলেজ সূত্রে জানা যায়, বিভিন্ন বিভাগে পদ থাকলেও পদায়ন করা হয়নি। শিক্ষকের ১৮২টি পদের ১২টি খালি রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং ও সমাজবিজ্ঞানসহ তিনটি বিভাগে সৃষ্ট পদে শিক্ষক দেওয়া হয়নি। সাতজন শিক্ষকের প্রয়োজন থাকলেও আছেন মাত্র তিনজন। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে নতুন পদ সৃষ্টির কথা থাকলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় তা করছে না। এসব কারণে ঠিকমতো ক্লাস করানো যাচ্ছে না।
শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন, ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ছাত্র সংসদ না থাকলেও প্রতি সেশনে তাঁদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন বিভাগে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে নানা খাত দেখিয়ে ফি আদায় করা হয়। বাংলা, অর্থনীতিসহ বিভিন্ন বিভাগে ক্লাস ও পরীক্ষা নিয়মিত না হওয়ায় তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
আসমা আক্তার ও সোহরাব আলী নামের দুই শিক্ষার্থী বলেন, কলেজে ১৯ হাজার ৮৭৬ জন নিয়মিতসহ মোট ৩৫ হাজার শিক্ষার্থীর আবাসন সংকট প্রকট। মেয়েদের তিনটিসহ বর্তমানে পাঁচটি হোস্টেলে এক হাজার ৩০০ জন থাকতে পারে। বাকিরা অনেক কষ্টে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে প্রাইভেট হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করছেন।
জাতীয় ছাত্রসমাজ কারমাইকেল কলেজ শাখার সদস্যসচিব আরিফ আলী বলেন, এখানে রয়েছে নানাবিধ সমস্যা। শিক্ষক সংকটের পাশাপাশি মার্কেটিং ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগে মাস্টার্স কোর্স চালু নেই। পুলিশ ফাঁড়ি না থাকায় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের নেই নিরাপত্তা। রয়েছে পরিবহন সংকট।
ছাত্রলীগ কারমাইকেল কলেজ শাখার সভাপতি সাইদুজ্জামান সিজার বলেন, নানাবিধ সংকট রয়েছে এই কলেজে। তার পরও আগের তুলনায় বর্তমানে ভালো চলছে। ১০৩ বছরে শতবর্ষপূর্তি উৎসব হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, অনেকটাই হিমঘরে ছিল এই আয়োজন। ছাত্রলীগের চাপে চলতি মাসের শেষে উৎসবের আয়োজন করেছে প্রশাসন। শিক্ষক, পরিবহন ও হোস্টেল সংকটের কথা উল্লেখ করে তিনি জানান, একসময় শিবিরের ক্যান্টনমেন্ট হিসেবে পরিচিতি পাওয়া চারটি ছাত্রাবাস বন্ধ করে দেওয়া হয়। সম্প্রতি দুটি খুলে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া কলেজে ১০ তলা ভবন হচ্ছে।
কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. শেখ আনোয়ার হোসেন বলেন, বৃহৎ এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সমস্যা অনেক। তবে ধীরে ধীরে তা কাটছে। শিক্ষক সংকটের বিষয়টি মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। আর শিক্ষার্থীদের ক্লাসমুখী করার উদ্যোগ না থাকার অভিযোগ সত্য নয়। বন্ধ চারটি হোস্টেলের মধ্যে দুটি চালু করা হয়েছে। অল্পদিনের মধ্যে বাকি দুটিও চালু করার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
শতবর্ষপূর্তি উৎসব সম্পর্কে অধ্যক্ষ বলেন, তিন বছর আগে উদ্যোগ নেওয়া হলেও নানা জটিলতার কারণে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। রেজিস্ট্রেশনের সোয়া কোটি টাকা ব্যাংকেই জমা রয়েছে। সময়মতো উৎসব করতে না পারায় স্পন্সর করেছিলেন এমন অনেকের ২২ লাখ টাকা ফেরত দিতে হয়েছে। বর্তমান শিক্ষার্থীদেরও (তিন বছর আগে যারা কলেজে ছিল না) সুযোগ দিতে হবে। তাই দেরিতে হলেও আগামী ২৯ ও ৩০ ডিসেম্বর শতবর্ষপূর্তি উৎসব উদ্যাপনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।