অর্জন ও প্রত্যাশা

ইমরান ইমন |

দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত আর দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের আজকের এই দিনে আমরা অর্জন করেছি চূড়ান্ত বিজয়, পেয়েছি স্বাধীন সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র, পেয়েছি লাল-সবুজের গৌরবান্বিত একটি পতাকা। এদেশের প্রতি বর্গকিলোমিটার অর্জিত হয়েছে শহীদদের তাজা রক্তের বিনিময়ে।

১৬ ডিসেম্বর বাঙালি জাতির মহান বিজয় দিবস। জাতির সূর্যসন্তান যাদের মহান আত্মত্যাগে এই বিজয় অর্জিত হয়েছিলো তাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করার দিন। বাংলাদেশের ইতিহাস স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য কোটি কোটি খেটে খাওয়া মানুষের সুদীর্ঘ লড়াইয়ের ইতিহাস। আজকের এই মুক্তি ও স্বাধীনতা বাঙালির দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন ও সাধনার ফসল।

১৯৭১-এর উত্তাল মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে বীর বাঙালি একটি স্বাধীন আবাসভূমির জন্য যার যা আছে তাই নিয়ে মরণ-পণ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সেদিন সবার চোখে ছিলো দীর্ঘ দিনের শোষণ-নির্যাতনের অবসান ঘটিয়ে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন একটি সুখী-সমৃদ্ধ স্বাধীন দেশ অর্জনের স্বপ্ন। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে ত্রিশ লাখ শহীদের এক সাগর রক্তের বিনিময়ে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের মধ্যদিয়ে বাংলার আকাশে উদিত হয় স্বাধীনতার সোনালী সূর্য। অর্জিত হয় বাঙালির দীর্ঘদিনের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা, স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র—বাংলাদেশ।

কিন্তু আজ স্বাধীনতা অর্জনের ৫১ বছর পর স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে, যে স্বপ্ন ও প্রত্যাশা নিয়ে সেদিন বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে জীবন বিসর্জন দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো, তার কতটুকু বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে! বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়- মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তিরা আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে নস্যাৎ করতে বিভিন্নসময়ে নানাভাবে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে এবং তা এখনও চলমান। 

২০২১ খ্রিষ্টাব্দে আমরা মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের সুবর্ণজয়ন্তী পালন করেছি। বিজয় অর্জনের এবছর ৫১ বছর পূর্ণ হয়ে ৫২-তে পা দিলো। বিজয় অর্জনের ৫১ বছর পর জাতি প্রকৃতঅর্থে কতটুকু বিজয়ের স্বাদ গ্রহণ করতে পেরেছে—সে প্রশ্নটি সঙ্গত কারণে সামনে চলে আসে।

কত অমুক্তিযোদ্ধা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সেজে সরকারি ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে যাচ্ছেন। আবার অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা আছেন যারা আজ পর্যন্ত সুযোগ-সুবিধা তো দূরে থাক নিজের মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতিটুকুও আদায় করতে পারেননি। জীবিত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা খুব দ্রুত কমে যাচ্ছে। সম্ভবত আগামী বিশ বছর পর আমরা হয়তো কোনো জীবিত মুক্তিযোদ্ধা খুঁজেই পাবো না। মুক্তিযুদ্ধের অনেক প্রকৃত ইতিহাস তখন চাপা পড়ে যাবে। বিশেষ করে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশের নারীসমাজের অবদানটি সঠিকভাবে আজ পর্যন্ত ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হয়নি। মুক্তিযুদ্ধে নারীর ইতিহাস পৃথক করে লিপিবদ্ধ করা প্রয়োজন। কতজন তারামন বিবি ও কাঁকন বিবি আমাদের আছেন সে হিসেব কারো কাছে নেই। তারা কতইনা কষ্টে তাদের জীবন অতিবাহিত করেন। তাদের কতজনের বাড়ি-ঘর নেই, কতজনে ভিক্ষা করে খায়, কতজনে রোগে-শোকে জর্জরিত সে খবরটুকুও রাখার আগ্রহ কারো নেই।

মুক্তিযুদ্ধের এতগুলো বছর অতিক্রম হওয়ার পরও আমরা মুক্তিযুদ্ধের নানা ইস্যুতে এখনো দ্বিধা-বিভক্ত। স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে আজও বিতর্কে জড়িয়ে আছি। মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতার মহান ঘোষক কে—সে নিয়ে অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে। যিনি পাঠ করেছেন তিনি পাঠক। তিনি ঘোষক হন কীভাবে? ঘোষক আর পাঠকের মধ্যকার পার্থক্যটুকু আজ পর্যন্ত আমরা বুঝে উঠতে না পারলে কে আমাদের বুঝিয়ে দেবে? আমাদের জাতির জনক প্রশ্নে আজও বিভক্তি ও বিতর্ক রয়ে গেছে। পৃথিবীর আর কোথাও তা নেই, আমাদের প্রতিবেশী ভারত কিংবা পাকিস্তানেও জাতির পিতা নিয়ে কোনো প্রকার বিতর্ক কোনোদিন শোনা যায়নি।

পাকিস্তানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ আর ভারতে মহাত্মা গান্ধী তাদের অবিসংবাদিত জাতির পিতা। আমাদের দেশের ক্ষেত্রে এ বিষয়ে এতো বিভাজন কেন?

তাছাড়া জাতীয়তা নিয়েও বিতর্ক সৃষ্টি করা হয়েছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদকে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ দিয়ে দ্বিখণ্ডিত করে দেয়ার প্রয়াস অব্যাহত আছে। আর তা আমাদের স্বাধীনতা ও বিজয়ের বড় কলঙ্ক ছাড়া আর কিছু নয়।

স্বাধীনতা পরবর্তী যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটাকে পুণর্গঠনের দায়িত্ব হাতে নেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার স্বপ্ন ছিলো সোনার বাংলা গড়ে তোলার। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর লালিত স্বপ্নকে ঘাতকের বুলেট থমকে দেয়। সোনার বাংলা গড়ে তোলার স্বপ্ন তখন কিছুটা থেমে যায়। কিন্তু ধাপে ধাপে দেশ আজ সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ। স্বপ্নের পদ্মাসেতু, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু টানেল, পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প তার জ্বলন্ত উদাহরণ।

সময়ের তুলনায় বাংলাদেশ খুব বেশি অগ্রসর কিংবা অগ্রগতির স্বাদ না পেলেও এগিয়ে চলেছে ধাপে ধাপে। বর্তমানে আমাদের কতগুলো উন্নয়ন পরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়েছে। তা হলো— আমরা ২০৪১ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হবো।

যুক্তরাষ্ট্র তাদের সমীক্ষায় বলছে, ২০৩০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ বাংলাদেশসহ ‘নেক্সট ইলেভেন’ সম্মিলিতভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি দেশকে ছাড়িয়ে যাবে। লন্ডনের একটি শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা লিখেছে, ২০৫০ খ্রিষ্টাব্দে প্রবৃদ্ধির বিচারে বাংলাদেশ পশ্চিমা দেশগুলোকে ছাড়িয়ে যাবে।

অর্থনীতির দিক দিয়ে আমরা যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছি সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সব দিক দিয়েই আমাদের সমান্তরালে এগিয়ে যেতে হবে। তাহলেই দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব হবে। দেশের শিক্ষাখাতে দিতে হবে বিশেষ গুরুত্ব। শিক্ষাব্যবস্থাকে যুগোপযোগী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষার মান বৃদ্ধি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

তাছাড়া অপরাধপ্রবণতা বন্ধে, দেশকে শান্তিপূর্ণ রাখতে রাষ্ট্রকে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে, পাশাপাশি নাগরিকদের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে সাম্প্রদায়িকতা পরিহার করে অসাম্প্রদায়িক, নৈতিক ও মানবিক হতে হবে। সর্বোপরি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শকে ধারণ করে দেশপ্রেমের মাহাত্ম্যকে লালন করে প্রত্যেক নাগরিককে যার যার অবস্থান থেকে দেশের সার্বিক কল্যাণের জন্য কাজ করে যেতে হবে। তবেই আমরা বিনির্মাণ করতে পারবো সুখী সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ। তখনই অর্জিত হবে স্বাধীনতার প্রকৃত উদ্দেশ্য।

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ধর্ম নিয়ে কটূক্তি: জবি ছাত্রী তিথির পাঁচ বছরের কারাদণ্ড - dainik shiksha ধর্ম নিয়ে কটূক্তি: জবি ছাত্রী তিথির পাঁচ বছরের কারাদণ্ড এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির আবেদন শুরু ২৬ মে - dainik shiksha একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির আবেদন শুরু ২৬ মে ভর্তি পরামর্শ: কলেজ পছন্দ জরুরি - dainik shiksha ভর্তি পরামর্শ: কলেজ পছন্দ জরুরি মৃত্যুদণ্ডাদেশ চূড়ান্ত হওয়ার আগে আসামিকে কনডেম সেলে রাখা যাবে না: হাইকোর্ট - dainik shiksha মৃত্যুদণ্ডাদেশ চূড়ান্ত হওয়ার আগে আসামিকে কনডেম সেলে রাখা যাবে না: হাইকোর্ট শিক্ষা ক্যাডারের নির্বাচনী হাটে এমপিও শিক্ষকের কপাল ফাটে - dainik shiksha শিক্ষা ক্যাডারের নির্বাচনী হাটে এমপিও শিক্ষকের কপাল ফাটে অন্ত*র্বাসে লুকানো ডিভাইস, ১০ মিনিটেই শেষ পরীক্ষা - dainik shiksha অন্ত*র্বাসে লুকানো ডিভাইস, ১০ মিনিটেই শেষ পরীক্ষা ১৩ শিক্ষকের ১৪ শিক্ষার্থী, সবাই ফেল - dainik shiksha ১৩ শিক্ষকের ১৪ শিক্ষার্থী, সবাই ফেল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জন্য সুখবর - dainik shiksha এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জন্য সুখবর please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.003000020980835