উন্নত দেশেও কোচিং আছে: ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ

ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ |

এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হচ্ছে ২রা ফেব্রুয়ারি। পরীক্ষাকে নিশ্ছিদ্র করার জন্য আমাদের আয়োজনের শেষ নেই। শুরু হলো সকল কোচিং সেন্টার বন্ধ ঘোষণা দিয়ে। শেষাবধি আরো কত কিছু করা হবে তার কিঞ্চিৎ হয়তো আমরা অনুমান করতে পারবো। যেমন ফেসবুকসহ যত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম রয়েছে তা বন্ধ করে দেয়া হতে পারে, ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া হতে পারে, পরীক্ষা কেন্দ্রের ত্রিসীমানায় কিংবা তার বাইরে মোবাইল ফোন নিষিদ্ধ হতে পারে, কাছে হাসপাতাল থাকলেও এবং সেখানে মোবাইল ফোন জীবন বাচানোর মতো প্রয়োজনীয় যন্ত্র হলেও। আরো কী কী আয়োজন আমরা করতে পারি জুতা আবিষ্কার সংশ্লিষ্ট তার কিছু উদাহরণ কবিগুরু প্রায় শতবর্ষ পূর্বেই দিয়ে গেছেন।

যদিও কয়েক বছর পূর্বেও আমাদের পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস মহামারি আকার ধারণ করেছিল। সুখের বিষয় এই যে বিগত দুইটি পাবলিক পরীক্ষায় এমনটি হয় নি, পরীক্ষার্থী এবং অভিভাবকেরা কিছুটা হলেও স্বস্তি পেয়েছেন। তবে এখনো কেন জানি মনে হয় মূল সমস্যাটি আমরা অন্যান্য দেশের মতো সমাধান করতে পারছিনা। এই পরীক্ষাটিকে সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য আমাদের জনজীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে ভোগান্তি তৈরি হচ্ছে। একটি সমস্যা সমাধানে যদি অন্যক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করা হয় তাহলে সমাধানটি গ্রহণযোগ্য হয় না। পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে দেশের আপামর জনসাধারণের উদ্বেগের প্রতিফলন ঘটেছিল বিচার বিভাগীয় একাধিক কমিটি তৈরির মাধ্যমে। নানা তদন্ত কমিটির রিপোর্ট থেকে প্রতীয়মান হয় যে কোচিং সেন্টারগুলোকে যেভাবে দোষী সাব্যস্ত করা হয় ততটা সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হয় নি।

প্রকৃতপক্ষে পরীক্ষাসংশ্লিষ্ট কোনো কর্মকাণ্ডেই কিন্তু কোচিং সেন্টারের সংশ্লিষ্ট কাউকে দায়িত্ব প্রদান করার কথা না। প্রশ্ন প্রণয়ন করেন শিক্ষকেরা, মডারেশন করেন শিক্ষকেরা, টাইপ করা ছাপানো, কেন্দ্রে প্রেরণ এর কোনো কিছুতেই কোচিং সেন্টারের লোকজনের সংশ্লিষ্টতা  নেই। কেন্দ্র পর্যন্ত পৌছানোর দায়িত্বও হয়তো দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের করার কথা। হয়তো প্রত্যন্ত অঞ্চলে পর্যাপ্ত দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের অভাবে শিক্ষকেরা কেন্দ্রে পৌছানোর দায়িত্ব পালন করে থাকেন। মোটের ওপর কেন্দ্রে প্রশ্নপত্র পৌছানো পর্যান্ত কোচিং সেন্টারগুলোর কোনো ভূমিকা নেই। তারপর পরীক্ষার খাতা পরীক্ষকদের মধ্যে বিতরণ, নম্বর  প্রদানসহ আরো যত কর্মকাণ্ড আছে তাতেও তাদের সম্পৃক্ততা নেই। তাহলে তাদের কেন বলির পাঠা বানানো হচ্ছে? আমরা যদি মনে করি কোচিং সেন্টারগুলো ছেলেমেয়েদের বুলি শেখাচ্ছে, কিছু বোঝাচ্ছে না তাহলে আমরা যথাযথ প্রশ্নপত্র করে, যথাযথভাবে মূল্যায়ন করে তা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হচ্ছি কেন? আমার মধ্যে এরকম শংকা তৈরি হয়েছে যে ছাত্রদের যদি স্কুল কলেজের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করা না হয় তাহলে তারা কোচিং সেন্টারেই যাবে। আমাদের যে পাঠ্যপুস্তক, প্রশ্নপত্রের ধরণ, স্কুল কলেজে পর্যাপ্ত শিক্ষকের অভাব, শিক্ষকদের বেতন কাঠামো, সামাজিক মর্যাদা, বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে ভর্তির চাপ এর সম্ভবত যৌক্তিক পরিণতিই হাজার হাজার কোটি টাকার কোচিং এবং নোট বইয়ের বিস্তার।

শিক্ষাখাতে সরকারি বিনিয়োগ যদি ৫০ টাকা হয় বেসরকারি কিংবা ব্যক্তি বিনিয়োগ সম্ভবত তার থেকে কম নয়। এমনকি উন্নত দেশসমূহেও কিন্তু কোচিং সেন্টারের বিস্তার রয়েছে। কোরিয়া, জাপান, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশও কোচিং থেকে মুক্ত হতে পারে নি যাদের স্কুল কলেজগুলো শিক্ষক,পাঠ্যপুস্তক, ল্যাবরেটরি দিয়ে অনেক সমৃদ্ধ। আমরা কীভাবে ভাবতে পারি যে আমাদের দেশ কোচিং মুক্ত হবে? আমরা কী তার জন্য শিক্ষায় যোগ্য বরাদ্দ দিচ্ছি, আমাদের স্কুল কলেজের পাঠদান কী শিক্ষায় উৎকর্ষ অর্জনের জন্য যথেষ্ট? একেতো পর্যাপ্ত বরাদ্দের অভাব তদুপরি সেই বরাদ্দের অর্থ থেকে যদি কোচিং সেন্টারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয়, ফটোকপি মেশিনের দোকানের উপর  নজরদারি রাখতে হয় তাহলে নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থা হবে। শিক্ষা নিয়ে, পরীক্ষা ব্যবস্থাপনা নিয়ে আমাদের অনেক পরীক্ষণ হয়েছে, সম্ভবত মাত্রাতিরিক্ত পরীক্ষণ হয়েছে, পরীক্ষা পদ্ধতি বারবার পরিবর্তন করে পরীক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছে। এতো পরীক্ষণের কোনও প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। আমরা অনেক গবেষণা করবো ২০ বছরে একবার পরিবর্তন করবো। প্রাথমিক, মাধ্যমিক শিক্ষায় আমাদের ছেলেমেয়েরা বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান কিংবা শিক্ষার অন্যান্য শাখায় ভিত্তি মজবুত করবো। শিক্ষা সারাজীবনের জন্য। আমাদের পদার্থ বিজ্ঞানের ছাত্ররা অত্যন্ত ব্যুৎপত্তির সঙ্গে ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে চাকুরি করতে পারে যদিও তাদের সিলেবাসে সম্ভবত ইন্সুরেন্স শব্দটির উল্ল্যেখ থাকে না, রসায়ন শাস্ত্রে পাশ করে দেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হয়েছেন। সুতরাং অহরহ সিলেবাস কিংবা পরীক্ষার ধরণ পরিবর্তন করে গোটা জাতিকে অস্বস্তিতে ফেলার কোনো প্রয়োজন নেই, সাময়িক সমাধানের বৃত্ত থেকেও আমরা বের হয়ে আসতে চাই।

কোচিং  সেন্টারের প্রতি গোটা সমাজের আগ্রহ থেকে বুঝতে হবে আমাদের স্কুল কলেজে পড়ালেখায়  ঘাটতি রয়েছে, পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই, যোগ্য শিক্ষকের অভাব রয়েছে। যতদিক এই সমস্যাগুলো যথেষ্ট ভালোভাবে মোকাবেলা করতে না পারছি ততদিন এর বিকল্প সমাধানের কথা ভাবতে হবে। যেমন খুব ভালো মানের পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ণ করতে হলে, প্রয়োজনে চার/পাঁচ বছর সময় দিয়ে। ভালো শিক্ষকদের পাঠদান থেকে যাতে সারা দেশের ছাত্ররা উপকৃত হতে পারে তার জন্য শিক্ষা টিভি চ্যানেল ব্যবহার করা যেতে পারে এবং তাতে রীতিমত সময়সুচি করে নানা বিষয়ের নানা শ্রেণির পাঠদান করানো যেতে পারে।

প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির জন্য লটারি সিস্টেম প্রবর্তন করায় সরকারকে সাধুবাদ জানাই। তবে এই পদ্ধতিকে আরো কার্যকর করার জন্য কলেজে যেমন অনলাইনে ভর্তি হচ্ছে অনুরূপ পদ্ধতি আমরা প্রতিটি শহরের জন্য বিশেষ করে মহানগরগুলোর জন্য সমন্বিতভাবে করতে পারি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছু ছাত্র-ছাত্রী এবং অভিভাবকদের যে ভোগান্তি, তাতে দেশ, জাতির যে ক্ষতি তার থেকেও জাতি মুক্তি আশা করে। জগদ্বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিনা ভর্তি পরীক্ষায় আমাদের ছাত্রদের ভর্তি করছে আর আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের ভর্তির জন্য তাদের কতো ভোগান্তি পোহাতে বাধ্য করছি। স্যাট স্কোরের মতো একটি ব্যবস্থা নিয়ে আমাদের ভাবা উচিত, অথবা একই রকম বিষয়ে ভর্তির জন্য মাত্র একটি পরীক্ষার মাধ্যমে ভর্তির ব্যবস্থা করা উচিত।

আশা করি এসএসসি পরীক্ষা নির্বিঘ্নে অনুষ্ঠিত হবে, আমাদের পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা গত বছরের মতো কিংবা তার থেকে একটি ভালো পরীক্ষার প্রত্যাশায় থাকবেন, উদ্বেগের মধ্যে কাটাবেন না, পরীক্ষার্থীরা প্রশ্নপত্র পাওয়ার আশায় নয় প্রস্তুতি নিয়েই পরীক্ষা দিবে।   

লেখক: শিক্ষাবিদ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসই বিভাগের অধ্যাপক। 

আরও দেখুন: 

যেসব কারণে শিক্ষার্থীরা কোচিংয়ে যায়

কোচিং কী অন্যায়, বাণিজ্য কী অপরাধ


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
সব মাদরাসার ওয়েবসাইট ও তথ্য হালনাগাদের নির্দেশ - dainik shiksha সব মাদরাসার ওয়েবসাইট ও তথ্য হালনাগাদের নির্দেশ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক : দুই মন্ত্রণালয় যা করবে - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক : দুই মন্ত্রণালয় যা করবে নার্সিং-মিডওয়াইফারি ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ - dainik shiksha নার্সিং-মিডওয়াইফারি ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন - dainik shiksha চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বেসরকারি শিক্ষকদের বদলির উদ্যোগ স্থগিতের নেপথ্যে - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষকদের বদলির উদ্যোগ স্থগিতের নেপথ্যে শিক্ষাখাতে অপপ্রচারে ভূয়া অভিভাবক ফোরাম, জাল সনদের অধ্যক্ষ - dainik shiksha শিক্ষাখাতে অপপ্রচারে ভূয়া অভিভাবক ফোরাম, জাল সনদের অধ্যক্ষ please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0023760795593262