উপাচার্যশূন্য পাঁচ বিশ্ববিদ্যালয় ও কিছু পরামর্শ

রহমান রাজু, তুহিন ওয়াদুদ, রুহুল আমিন, আপেল মাহমুদ |

২০১৩ সালে দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের মেয়াদ শেষ হয়েছিল। সে সময়ে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগে বিলম্ব হওয়ার কারণে উপাচার্যশূন্য বিশ্ববিদালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম ভেঙে পড়েছিল। রাজশাহী, জগন্নাথ, উন্মুক্ত ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অনেক দিন চলেছে উপাচার্য ছাড়াই। এ বছর জগন্নাথ, উন্মুক্ত ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তাদের মেয়াদ দ্বিতীয় দফায় বৃদ্ধিকরণের ঘোষণা এসেছে। তবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবারও চলছে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ ছাড়াই। জগন্নাথ, জাতীয় ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা তাদের কাজের সুনামের মধ্য দিয়েই পরবর্তী মেয়াদের জন্য মনোনীত হয়েছেন।

দিনাজপুর হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য ছাড়াই চলেছে প্রায় ৪ মাস। সেখানকার অবস্থা এতটাই সংকটপূর্ণ হয়ে উঠেছিল যে, ভর্তি পরীক্ষা পিছিয়েছে কয়েক মাস। নতুন উপাচার্য নিয়োগ দেওয়ার পর শুরু হয়েছে ভর্তি কার্যক্রম। ২০১২ সালেও এ বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগে বিলম্ব হয়েছিল। শুধু উপাচার্য নিয়োগে বিলম্ব হওয়ার কারণে এ বছর কয়েক মাসের সেশনজট নিয়ে শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করছেন।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের মেয়াদ শেষ হওয়ার সপ্তাহখানেক পর তার দায়িত্বকাল দ্বিতীয় মেয়াদে বৃদ্ধি করা হয়। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে একদিন হরতালের কারণে বন্ধ থাকলে ছুটির দিন সেই ক্লাস নেওয়া হয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক ক্যালেন্ডার যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়। এখানে একটি দিনও খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেই খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ও উপাচার্যহীন ছিল কয়েক দিন।

গত ১৯ মার্চ শেষ হয়েছে গাজীপুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের মেয়াদ। এখন পর্যন্ত সেখানে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়নি। এতে শিক্ষা কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি সেখানে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী কেউ বেতনও পাননি। উপ-উপাচার্য পদটি এখানে নেই। ফলে মাসাধিককাল ধরে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম প্রায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। ৬ এপ্রিল যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদালয়ে উপাচার্যের মেয়াদ শেষ হয়েছে। সেখানে উপ-উপাচার্যও নেই। এখনও নতুন উপাচার্য দেওয়া হয়নি। ৩ মে থেকে মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ৬ মে থেকে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়েও নেই উপাচার্য।

উপাচার্য না থাকলে পরীক্ষার ফল, সনদ, শিক্ষকদের উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ গমনসহ বিবিধ সমস্যার সৃষ্টি হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত মেডিকেল কলেজসহ সব প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষা, ফল প্রকাশ বন্ধ হয়ে আছে। উপাচার্য না থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থাকে অরক্ষিত। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাস্কর্যগুলো তছনছ করার পরও প্রশাসন ব্যবস্থা নিতে পারছে না। সামগ্রিক ক্ষতির প্রভাব পড়ে শিক্ষার্থীদের ওপর। শিক্ষার্থীদের ক্ষতি দেশের ক্ষতিরই নামান্তর।

উপাচার্য নিয়োগের সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি না থাকার কারণে আগ্রহী অনেকেই উপাচার্য হওয়ার জন্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের দ্বারস্থ হন। উপাচার্য হওয়ার পর আবার সেসব রাজনৈতিক নেতার কাছে দায়বদ্ধতা তৈরি হয়। অনেকে কৃতজ্ঞতা স্বীকারের পথ খোঁজেন নিয়োগে সুবিধা দেওয়ার মাধ্যমে। একজন গবেষক কিংবা শিক্ষা ও শিক্ষার্থীর জন্য নিবেদিত শিক্ষকরা উপাচার্য হওয়ার জন্য মরিয়া হন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের যিনি শিক্ষক হন, তিনি গাড়ি-বাড়ি-ক্ষমতার মোহ ত্যাগ করেই এ পেশায় আসেন। এ পেশার আনন্দ শেখানোর আনন্দ। যারা সাধারণত শেখানোর কাজে বিশেষ আনন্দ লাভ করেন না, বর্তমান প্রেক্ষাপটে তারা উপাচার্য হওয়ার জন্য অতিউৎসাহ দেখান। এ কথা সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য নয়। তবে অধিকাংশের বাস্তবতা এমনই।

যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগের সুযোগ আছে, সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচন পদ্ধতির মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগ বিষয়টি চূড়ান্ত করা প্রয়োজন। যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচন পদ্ধতি নেই, সেসব ক্ষেত্রে উপাচার্য নিয়োগে একটি অনুসন্ধান কমিটি থাকা প্রয়োজন। যারা উপাচার্য হতে চান তারা অনুসন্ধান কমিটির কাছে নিজেদের বৃত্তান্ত তুলে ধরে আবেদন করবেন। অনুসন্ধান কমিটি এসব যাচাই-বাছাই করার পর কয়েকজনের নাম সরকারের কাছে পাঠাবে। যারা স্বেচ্ছায় আবেদন করবেন তাদের নাম ছাড়াও অনুসন্ধান কমিটি যোগ্য প্রার্থীদের নাম অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। সে ক্ষেত্রে যার নাম প্রস্তাব করা হবে তার সঙ্গে কথা বলে নেওয়ারও প্রয়োজন আছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যশূন্যতার ঘটনা গত চার বছরের আগে এত প্রকট আকার ধারণ করেনি। দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হচ্ছেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি। মূলত রাষ্ট্রপতি উপাচার্য, উপ-উপাচার্য এবং কোষাধ্যক্ষ নিয়োগ দেন। যতটুকু জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী মনোনয়ন দেন, তারপর রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেন। একজন উপাচার্যের ব্যক্তিগত তথ্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যায়। এ ছাড়াও কয়েক স্তরের গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমেও সরকার সম্ভাব্য উপাচার্যদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে। উপাচার্য নিয়োগ প্রক্রিয়া খুব সময়সাপেক্ষ নয়। নির্দিষ্ট কারও ওপর দায়িত্ব না থাকার কারণে উপাচার্য নিয়োগের বিষয়টি ঝুলে যাচ্ছে। এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩৮। চার বছর অন্তর একজন উপাচার্য এবং প্রায় সমসংখ্যক উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ রাষ্ট্রপতিকে নিয়োগ দিতে হচ্ছে। ফলে এই নিয়োগ প্রক্রিয়া একটি নির্দিষ্ট কাঠামোতে আনা জরুরি।

মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩ মে এবং বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫ মে উপাচার্যের মেয়াদ শেষ হয়েছে। এ দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ কেউই নেই। এ অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় দুুটির সব কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে।

অনেক সময় সামান্য কারণেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়। সেইসঙ্গে উপাচার্যশূন্যতাও যেন আর একটি কারণে পরিণত হয়েছে। অনতিবিলম্বে উপাচার্যশূন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হোক। আগামীতে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় যাতে উপাচার্যশূন্য না হয়, সে ব্যবস্থাও আগাম গ্রহণ করা জরুরি।

লেখকরা বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক

সৌজন্যে: দৈনিক সমকাল


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
কাল খুলছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শনিবারও চালু ক্লাস - dainik shiksha কাল খুলছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শনিবারও চালু ক্লাস সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি - dainik shiksha সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি - dainik shiksha উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি - dainik shiksha বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে স্মার্টফোন নয় - dainik shiksha ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে স্মার্টফোন নয় একই স্কুলের দুই ছাত্রীকে বিয়ের পর আরেক ছাত্রীকে ল্যাব সহকারীর অনৈতিক প্রস্তাব - dainik shiksha একই স্কুলের দুই ছাত্রীকে বিয়ের পর আরেক ছাত্রীকে ল্যাব সহকারীর অনৈতিক প্রস্তাব দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.011697769165039